রাজধানীর কাজলার শতাধিক ওয়ার্কশপের কর্মীদের তাই কথা বলার সময় নেই। রোজার শুরু থেকে শুরু হওয়া এ কর্মযজ্ঞ শেষ হবে ২৭ রোজায়।
এসব গাড়ির কারণে ঈদে ঘরমুখো মানুষের রাস্তায় ভোগান্তির শিকার হতে হয়। অথচ প্রশাসনের নাকের ডগায় প্রকাশ্যে এসব অবৈধ কাজ করা হলেও নেওয়া হচ্ছে না কোনো ব্যবস্থা।
সরেজমিনে যাত্রাবাড়ী থানার কাজলা থেকে মাতুয়াইল পর্যন্ত মিতালী পরিবহন, নিউ লাইন ও তিশা কোচ পরিবহনের গাড়ি মেরামতের কয়েকটি ওয়ার্কশপে গিয়ে দেখা যায়, মিতালী ইঞ্জিনিয়ারিং মোটর ওয়ার্কস, বিসমিল্লাহ অটোমোবাইলস, মাতুয়াইল ইঞ্জিনিয়ারিং মোটর ওয়ার্কস, কবির ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কস, বেঙ্গল বডি বিল্ডার্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কস, মীম অটোমোবাইলস অ্যান্ড বডি বিল্ডার্সসহ প্রায় একশোর বেশি প্রতিষ্ঠান রয়েছে এখানে। ঢাকা শহর ও আন্তঃজেলা লং রুটের ফিটনেসবিহীন ভাঙাচোরা গাড়িগুলো জোড়াতালি ও রং দেওয়া হচ্ছে এসব ওয়ার্কশপে। ওয়ার্কশপের মিস্ত্রিরা এসব গাড়ি মেরামতে দিনরাত কাজ করে যাচ্ছেন। কোনো গাড়ির ইঞ্জিন ও ব্রেকে সমস্যা, কোনোটির সিট ছেঁড়া, আবার কোনোটির বডিতে রং নেই। ঈদের সময় বহু পুরনো এসব গাড়ি মেরামত করে নতুন সাজে রোডে নামানো হবে। বিশেষ করে ২৫-২৬ রোজার পর বাইরে ‘ফিটফাট’ এ গাড়িগুলো রোডে নামানো হবে বলে জানিয়েছেন ওয়ার্কশপের মালিক ও কর্মচারীরা।
ওয়ার্কসপের কারিগররা বলছেন, পুরনো গাড়ি যতই ঠিক করা হোক রাস্তায় নামানোর পর থেকে দুর্ঘটনার আশঙ্কা থেকেই যায়। ঈদে ত্রুটিমুক্ত যাত্রীবাহী গাড়ির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সড়ক ও মহাসড়কে ফিটনেসবিহীন শত শত যানবাহনের চাপ বেড়ে যায়।
তবে একথা মানতে রাজি না বাস মালিকরা। তারা বলেন, রোডে বাস চললে ছোটখাট ত্রুটি হতেই পারে। আমাদের একটি ইঞ্জিন ও চেসিসের মেয়াদ ন্যূনতম ২০ বছর। এর আগে তেমন কিছু হয় না। রোডে যে দুর্ঘটনাগুলো হয় সাধারণত অসচেতনতার কারণে ও ড্রাইভারদের অসম প্রতিযোগিতার কারণে।
ঢাকা-ভৈরব রোডের তিশা কোচের মালিক জাহিদুল আলম বাংলানিউজকে বলেন, সড়ক ও মহাসড়কে যেসব দুর্ঘটনা ঘটে তার বেশির ভাগ ঘটে যাত্রী, ড্রাইভার ও হেলপারদের অসচেতনতা এবং অসম প্রতিযোগিতার কারণে। তবে এখন এ ধরনের দুর্ঘটনাও অনেক কমে গেছে। কারণ মহাসড়কে সিএনজি অটোরিকশা চলাচল বন্ধ রয়েছে। আমাদের একটি গাড়ি ২০ বছর চলাচলের অনুমতি পায়। অথচ দুই বছরের মাথায় গাড়ির দিকে তাকালে দেখা যাবে ৩০ বছরের পুরনো। এটা হয় খারাপ রাস্তাঘাট, ড্রাইভারদের গফলতির জন্য। আর এর ফল ভোগ করতে হয় আমাদের।
‘পুলিশসহ প্রশাসনের হায়রানিও কম হয় না। ঈদের আগে আমরা সাধারণত গাড়ি মেরামত করি এ কারণে যে এসময় যাত্রী ও আয় কম হয়। ফলে গাড়ি অযথা বসিয়ে না রেখে গ্যারেজে পাঠিয়ে ছোটখাট ত্রুটিগুলো সারিয়ে নেই। ’
মিতালী ইঞ্জিনিয়ারিং মোটর ওয়ার্কশপের মিস্ত্রি ও গ্যারেজ ইনচার্জ আতিক তালুকদার বাংলানিউজকে জানান, ঈদ সামনে রেখে তাদের গ্যারেজে পুরনো গাড়ির কাজ বেড়ে গেছে কয়েকগুণ। গাড়িতে রং ও ইঞ্জিনের ত্রুটিগুলো সারা হচ্ছে বেশি। ২৬ রোজার আগেই এসব গাড়ির কাজ শেষ হবে। আর ২৭ রোজায় রোডে নামানো হবে।
আতিক আরো বলেন, ঈদ সামনে রেখে গাড়ির ফিটনেস বাড়ানোর জন্যই সবাই গাড়ি ওয়ার্কশপে পাঠায়। যাতে রাস্তায় পুলিশ সার্জানদের হয়রানি কমে। এসময় শুধু রং ও ছোটখাট ঝালাই, সিট মেরামতের কাজ বেশি হয়। ঈদ সামনে, তাই আমাদের দম ফেলার সুযোগ নেই। অন্য সময় আমাদের এখনে ১০ থেকে ১২ জন লোক কাজ করলেও এখন কাজ করছে ২২ জন। কেউ রং এর কাজ, কেউ সিট মেরামত, কেউ মেশিন মেরামত করছে। একই গ্যারেজের রংমিস্ত্রি আনোয়ার জানান, ঈদ সামনে রেখে পুরনো গাড়ি রং করে নতুন রূপে সাজানো হচ্ছে, যাতে যাত্রীরা আকৃষ্ট হয়। সময়মতো ডেলিভারি দিতে দিন-রাত গাড়িতে রঙের কাজে ব্যস্ত থাকতে হচ্ছে।
গ্যারেজে মেরামতের জন্য আনা তিশা কোচের চালক আফছার আলী বাংলানিউজকে বলেন, রোজা ও ঈদের আগে রোডে মোবাইল কোর্ট এবং রেকার বসিয়ে গাড়ির ফিটনেস চেক করা হয়। রোজা শুরুর পর থেকেই গাড়ির ফিটনেস দেখাতে রং ও মেরামত করা হয়। পাশাপাশি রোজায় সড়কে যাত্রী কম থাকে। তাই ঈদের আগেই ফিটনেস বাড়ানোর একটি সুযোগ তৈরি হয়। এছাড়া প্রত্যেক যাত্রীই চায় রং করা সুন্দর গাড়িতে উঠতে। তাই বাসের সিট, বডিতে রং ও ইঞ্জিনের কাজ করাতে গাড়িটি গ্যারেজে আনা হয়েছে।
সাজু অটোমোবাইলস অ্যান্ড বডি বিল্ডার্সে গিয়ে দেখা যায়, ভাঙাচোরা কয়েকটি বাস মেরামতে কাজ করছেন সেখানকার মিস্ত্রিরা। কেউ বাসে রং করছে আবার কেউ ইঞ্জিন খুলে বসেছেন। আবার কেউ সিট ও বডির কাজ করছেন।
নিউ লাইনের মালিক আপেল মাহমুদ বাংলানিউজকে জানান, ঈদের সময় রোডে গাড়ির ফিটনেস না থাকলে ঝুঁকি থাকে বেশি। তাই ত্রুটি সারাতে গ্যারেজে নিয়ে আসা। এছাড়া ঈদের সময় গাড়ির ফিটনেস না থাকলে পুলিশ ও সার্জেন্টরা বিরক্ত করে। তাই রঙের কাজ করানো হচ্ছে।
ঢাকা-সিলেট ও ঢাকা-ভৈরব মহাসড়কে প্রতিনিয়ত চলাচলকারী যাত্রীরা বাংলনিউজকে জানান, রোজা ও ঈদ এলেই বাসমালিকরা পুরনো গাড়িকে নতুন রূপ দিয়ে রাস্তায় নামিয়ে দেয়। ফলে ঈদে অহরহ দুর্ঘটনা ঘটছে। এসব ফিটনেসবিহীন বহু বছরের পুরনো গাড়িগুলো রং করে রোডে চলাচল করলেও রোড সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের কোনো মনিটরিং করতে দেখা যায় না। প্রশাসনের একটু নজরদারি থাকলে ঈদে পুরনো ফিটনেসবিহীন গাড়ি চলাচল নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব। এসব গাড়ি মহাসড়কে চলাচল বন্ধ করতে সরকারকে আরো সচেতন হতে হবে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটির (বিআরটিএ) একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাংলানিউজকে জানান, ঈদ সামনে রেখে বিআরটিএর পক্ষ থেকে একটি টিম সড়ক মহাসড়কে অভিযান পরিচালনা করছে। যাদের ড্রাইভিং লাইসেন্স ও গাড়ির ফিটনেস নেই, তাদের গাড়ি সঙ্গে সঙ্গে আটক করা হচ্ছে।
এছাড়া ফিটনেসবিহীন যানবাহন ও অদক্ষ চালকসহ মালিকদের আইনের আওতায় না আনা হচ্ছে বলে জানান তিনি।
বাংলাদেশ সময়: ১১০৮ ঘণ্টা, মে ১৩, ২০১৯
জিসিজি/এএ