ঢাকা, বুধবার, ৭ শ্রাবণ ১৪৩২, ২৩ জুলাই ২০২৫, ২৭ মহররম ১৪৪৭

জাতীয়

‘আমার খালি বাচ্চাদের জড়িয়ে ধরে কান্না পাচ্ছে’

সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬:৩৯, জুলাই ২২, ২০২৫
‘আমার খালি বাচ্চাদের জড়িয়ে ধরে কান্না পাচ্ছে’

থাকবো নাকো বদ্ধ ঘরে দেখবো এবার জগৎটাকে, কেমন করে ঘুরছে মানুষ যুগান্তরের ঘূর্ণিপাকে— এমন সংকল্প নিয়েই হয়তো বেড়ে উঠছিল ওরা। জগতটাকে দেখতে, বুঝতে বা চিনতেও চেয়েছিল।

তাই বদ্ধ ঘরে থাকেনি। গিয়েছিল স্কুলে, ঘরের পরেই যা সবচেয়ে নির্ভরতার স্থান, বিদ্যাপীঠ। কিন্তু জগতের ঘূর্ণিপাক তাদের বুঝতে হলো জীবন দিয়ে!

সোমবার রাজধানীর উত্তরায় মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ভবনে বিমানবাহিনীর এফটি-৭ বিজিআই যুদ্ধবিমান আছড়ে পড়ে ডেকে আনে এক দুর্বিষহ দুর্বিপাক। ঝলসে যাওয়া শিশুদের ছোটাছুটি, আহত-নিহতদের উদ্ধার কার্যক্রম, স্বজনদের আহাজারি; এক বিভীষিকাময় পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। পুরো দেশের মানুষ হতবিহ্বল হয়ে পড়ে। নিরাপদে থাকা সন্তানদের বাবা-মায়ের আহাজারীতেও যেন আকাশ ভারী হয়ে ওঠে। একে অপরের সঙ্গে কথা বলার সময়ও নিজের অজান্তে কেঁদে ফেলছেন অনেকে।

নিজের ঘরে নিরাপদে থাকা বাচ্চাদের কোলে জড়িয়ে ধরে বারবার কেঁদেছেন প্রভাতী নূপুর। কথা হলে তিনি বলেন, ‘আমার খালি বাচ্চাদের জড়িয়ে ধরে কান্না পাচ্ছে। এই মুহূর্তে আমি পৃথিবীর সবচেয়ে ভাগ্যবতী ও সুখী মা। দেশে যা হলো তা দেখে বাচ্চাদের কোলে নিয়ে খালি কান্না পাচ্ছে। সব বাচ্চারা সুস্থ থাকুক। মায়ের বুকে থাকুক। ’

অনেকেই তার অনুভূতি প্রকাশ করছেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। আতিকা রহমান নামে এক পেশাজীবী নিজের ফেসবুক অ্যাকাউন্টে পোস্ট করে বলেন, ‘গতকাল অফিস থেকে বাসায় যাওয়ার পর থেকে রূপকথা যখন বারবার আমাকে বলছিল— মা, স্কুলের উপর দিয়ে কেন বিমান গেল? কেউ নিষেধ করেনি কেন? কেন আগুন নেভানোর জন্য বেশি করে পানি দেয়নি?

বাচ্চাগুলোকে দেখে অনেক কষ্ট লাগছে। আমার পাঁচ বছরের মেয়ের করা প্রশ্নের কোনো উত্তর আমার জানা নেই। গতকাল অনেক রাত পর্যন্ত মেয়েকে বারবার জড়িয়ে ধরছিলাম। বুকের ভেতরটা হাহাকার করে উঠছিল। রূপকথাকে কোলের সঙ্গে জাপটে নিয়ে শুয়েছিলাম। স্কুল ড্রেস পরা বাচ্চাদের চোখে মুখে যেন নিজের সন্তানকেই দেখতে পাচ্ছিলাম। সন্তানদের কাছে ক্ষমা চাওয়া ছাড়া আমাদের করার কিছু নেই। আমরা আমাদের সন্তানদের জন্য একটি নিরাপদ শহর নিশ্চিত করতে পারি না। নানা দিক দিয়েই ঢাকা শহর মৃত্যু ফাঁদে পরিণত হয়ে আছে, এটা কেউ বোঝে না। ’

জার্মান প্রবাসী সাংবাদিক দিল আফরোজ জাহান অডিও কলে কথা বলতে পারছিলেন না। তার গলা ধরে আসছিল। বললেন— ‘কোনোভাবেই কান্না ধরে রাখতে পারছি না। আমার পাঁচ বছরের বাচ্চাটা বলছে, মা আমি তো ভালো আছি, তুমি কাঁদছ কেন?’

সাদিয়া আফরোজ তার ফেসবুকে লিখেছেন, ‘হয়তো মিড টার্ম পরীক্ষার রুটিন হয়ে গিয়েছিল। স্কুলে চলছিল শেষ সময়ের পরীক্ষার প্রস্তুতি! হয়তো বাবা স্কুলে দিয়ে গিয়েছিল, মা আনতে গিয়েছিলেন! হয়তো টেবিলে বাচ্চার পছন্দের খাবার ঢেকে রেখে এসেছিলেন! নতুবা ফ্রিজে রাখা ছিল।

সকালে রেখে আসা গায়ের কাপড়টা হয়তো ধোয়া হয়েছে, ঝুলছে বারান্দায়! বাসায় ফিরেই মোবাইলে গেম খেলবে জেনে মা একটু টেনশনেই হয়তো ছিলেন চোখের সমস্যা বাড়বে বলে! হয়তো বাবার কাছে নতুন কোনো গিফট পাওয়ার কথা ছিল পরীক্ষায় ভালো করলে! বড় ভাই বা বোনের সঙ্গে খুনসুটি শেষে একসাথেই হয়তো হতো খাওয়া! মা-বাবার কষ্টের টাকা থেকে সন্তানের ভবিষ্যতের জন্য হয়তো জমছিল ডিপিএস!

ঘরের আনাচে কানাচে যে সন্তান ছড়িয়ে, তাকে ছাড়া পৃথিবীটা আর ঘুরছে না, থমকে গেছে যেন। আল্লাহ তুমি সহায় থেকো এই জীবনখেকো রাষ্ট্রের সন্তানদের। ’

মাইলস্টোন দুর্ঘটনায় শোকের সাগরে ভাসছে দেশ। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, এ পর্যন্ত অন্তত ৩১ জন নিহত হয়েছে। হাসপাতালে ভর্তি আছেন ৬৯ জন। এ ঘটনায় পালিত হচ্ছে রাষ্ট্রীয় শোক। স্থগিত করা হয়েছে দুটি বিষয়ের এইচএসসি পরীক্ষা।

এদিকে স্কুলে বিমানবাহিনীর প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত হয়ে হতাহতের ঘটনায়, শিক্ষাখাতে নানা অব্যবস্থাপনা এবং আইন ও শিক্ষা উপদেষ্টার পদত্যাগ দাবি জানিয়েছে শিক্ষার্থীরা।

এর আগে নিহতদের সঠিক নাম ও তথ্য প্রকাশ, আহতদের সম্পূর্ণ ও নির্ভুল তালিকা প্রকাশ, শিক্ষকদের গায়ে সেনাবাহিনীর সদস্যদের হাত তোলার ঘটনায় নিঃশর্ত ক্ষমা চাওয়া, নিহত প্রতিটি শিক্ষার্থীর পরিবারকে বিমানবাহিনীর পক্ষ থেকে ক্ষতিপূরণ দেওয়া, বিমানবাহিনীর ব্যবহৃত ঝুঁকিপূর্ণ ও পুরনো প্লেনগুলো বাতিল করে আধুনিক প্লেন চালু করা এবং বিমানবাহিনীর প্রশিক্ষণ পদ্ধতি ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র পরিবর্তন করে আরও মানবিক ও নিরাপদ ব্যবস্থা চালুর দাবিতে আন্দোলনে নেমেছিলেন মাইলস্টোনের শিক্ষার্থীরা। তবে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে উপদেষ্টারা আলোচনার পর অন্তর্বর্তী সরকার এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, শিক্ষার্থীদের সবগুলো দাবিই যৌক্তিক।

আলোচনা শেষে উপদেষ্টা আসিফ নজরুল সাংবাদিকদের বলেন, মাইলস্টোন স্কুলে একটি তথ্যকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এতে নিহত ও আহতদের তথ্য থাকছে। কেউ নিখোঁজ থাকলে সেই তথ্যও থাকছে। এখান থেকে তথ্য নিয়মিত হালনাগাদ করা হচ্ছে। নিহত ও আহত পরিবারের ক্ষতিপূরণ, পুনর্বাসন এবং ট্রমা ম্যানেজমেন্ট সাপোর্টের ব্যবস্থা করা হচ্ছে।

জনগণের ভিড় নিয়ন্ত্রণের সময় সেনাবাহিনীর কর্তব্য পালনকালে কয়েকজন সেনাসদস্য কর্তৃক শিক্ষার্থীদের ওপর মারধরের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের পক্ষ থেকে দুঃখ প্রকাশ করা হয়েছে এবং উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সেনা কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হবে বলে জানান তিনি।

আইন উপদেষ্টা বলেন, জনবহুল এলাকায় প্রশিক্ষণ বিমান না চালানোর ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য বিমানবাহিনীকে প্রয়োজনীয় নির্দেশনাও দেওয়া হবে।

ইইউডি/এমজে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।