পার্বত্য জেলা রাঙামাটি মূলত সবুজ অরণ্য ঘেরা পার্বত্য জনপদ। এ জনপদের জীবনযাত্রা, বিভিন্ন জাতিসত্ত্বার বসবাস ও সম্পর্কে যেমন বৈচিত্র রয়েছে তেমনি পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে কিংবা কাপ্তাই হ্রদের তলদেশে নানা বৈচিত্রময় ইতিহাস লুকায়িত রয়েছে।
পুরাতন এ জনপদ (কাপ্তাই হ্রদের তলদেশে ডুবে থাকা জনপদ) এক সময় চাকমা জাতির রাজারা রাজ্য শাসন করেছিল। আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা গড়ে উঠায় রাজ শাসন বিলুপ্তি ঘটে। তবে রাজাদের ইতিহাস এখনো বিলুপ্তি ঘটেনি। জনমানুষের মুখে মুখে এ ইতিহাসের কথা এখনো চলমান রয়েছে।
আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় দেশের সমতলে রাজাদের রাজ্য শাসন বিলুপ্তি ঘটলেও পার্বত্য এ জনপদে রাজার দাপট কমেনি। তবে ক্ষমতা খর্ব করা হয়েছে। এখানকার ভূমির খাজনার একটি অংশ পেয়ে থাকেন চাকমা সার্কেল চিফ। পাশাপাশি স্থানীয়দের স্থায়ী বাসিন্দার সনদও প্রদান করে থাকে রাজা।
আজকের এ কাপ্তাই হ্রদ সৃষ্টির ইতিহাস তেমন পুরোনো নয়। এক সময় রাঙামাটি ছিল সমতল নগরী এবং সমৃদ্ধ অঞ্চল (লোকমুখে শোনা) ছিল। পাহাড়ি-বাঙালি সব সম্প্রদায় মিলে-মিশে বসবাস করতো।
তৎকালীন বিট্রিশ সরকার ১৯০৬ সালে কর্ণফুলী জলবিদুৎ প্রকল্প সম্পর্কে প্রথম চিন্তা-ভাবনা করেছিল এবং সে সময়ে এ লক্ষ্যে একটি সংক্ষিপ্ত প্রাথমিক সমীক্ষা চালানো হয়। এরপর ১৯২৩ সালে এ ধরনের আরেকটি সমীক্ষা চালানো হয়েছিল।
১৯৪৬ সালে ব্রিটিশ কর্মকর্তা ই.এ. মুর কর্তৃক পেশকৃত প্রতিবেদনে বর্তমান বাঁধের অবস্থান থেকে ৬৫ কিলোমিটার উজানে বরকলে বাঁধ নির্মাণের প্রস্তাব করা হয়েছিল। পাকিস্তান শাসনামলে ১৯৫০ সালে প্রকৌশল পরামর্শক সংস্থা মার্জ রেনডাল ভ্যাটেন কাপ্তাই থেকে ৪৮ কিলোমিটার (৩০ মাইল) উজানে শিলারডাকে বাঁধ নির্মাণের প্রস্তাব করেছিল।
১৯৫১ সালে, সরকারি প্রকৌশলীরা কাপ্তাই থেকে ১১কিলোমিটার ভাটিতে চিৎমরমে বাঁধ নির্মাণের প্রস্তাব করেছিল। ১৯৫১ সালে, সেচ বিভাগের প্রধান প্রকৌশলী খাজা আজিমুদ্দিনের তত্ত্বাবধানে বাঁধ নির্মাণের স্থান হিসেবে কাপ্তাইকে নির্বাচিত করা হয়েছিলো। ১৯৫৭ সালের অক্টোবরে বাঁধের নির্মাণ কাজ শুরু হয় এবং ১৯৬২সালে কর্ণফুলী নদীতে বাঁধ দেওয়ার ফলে সুষ্টি হয়েছিলো ‘কাপ্তাই হ্রদ’।
কাপ্তাই হ্রদের অতল গহ্বরে হারিয়ে যায় চাকমা রাজ্য শাসনের ইতিহাস-ঐতিহ্য। ৬৫৫ বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে বসবাস করা পাহাড়ি-বাঙালি লাখেরও বেশি মানুষ সেই সময় উদ্বাস্ত হয়েছিল। বহু গ্রাম, ফসলি জমি তলিয়ে যায়। সেই সময় কাপ্তাই হ্রদের পানিতে ১৮হাজার পরিবার এক লাখের বেশি মানুষ তাদের বাড়ি-ঘর, সহায়-সম্পদ এবং স্বপ্ন বিলীন হয়ে যায়।
কাপ্তাই হ্রদের পানি কমায় ১৯৮৬ ও ২০০৬ সালে পুরনো সেই চাকমা রাজবাড়িটি জলের নিচ থেকে ভেসে উঠেছিল ওপরে। উৎসুক জনতা চাকমা রাজবাড়িটি এক পলক দেখতে সেই সময় ভিড় করেছিল।
ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায়, চাকমা রাজাদের আদি বাড়িটি ছিল চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ায় উপজেলায়। সেই প্রসাদে বসেই রাজত্ব করতেন বিখ্যাত চাকমা রানি কালিন্দী রায়। ১৮৭৪ সালে চাকমা রানি কালিন্দী মারা যান। এরপর রাজপুত্র হরিশ্চন্দ্র রায় রাজা হন। তিনি রাজা হওয়ার তিন বছর পর রাঙ্গুনিয়া থেকে পার্বত্য জনপদ রাঙামাটি চলে আসেন। তখন নির্মিত হয় ডুবে যাওয়া রাজ প্রাসাদটি। সেই প্রাসাদেই দীর্ঘ ৮৪ বছর রাজকার্য পরিচালনা করেছিলেন রাজা হরিশ্চন্দ্র।
পরে ১৯৬০ সালে পাকিস্তান সরকার কর্ণফুলী নদীতে কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণ করলে কালের সাক্ষি রাজবাড়িটি ডুবে যায়। এরপর পাহাড়ের পাদদেশে গড়ে উঠা নতুন রাঙামাটি শহরের রাজবাড়ি এলাকায় চাকমা রাজার নতুন প্রাসাদটি নির্মিত হয়।
চাকমা সার্কেল কার্যালয়ের কর্মকর্তা সুব্রত চাকমা বলেন, ১৯৬০ সালে কাপ্তাই বাঁধ তৈরির পর চাকমা সার্কেলের রাজবাড়ি কাপ্তাই হ্রদের গভীর পানির নিচে ডুবে যায়। ডুবে যাওয়া পর নতুন রাজবাড়ি নির্মাণ করা হয় নতুন রাঙামাটি শহরে। পুরোনো রাজবাড়ির পাশেই ছিল ঐতিহ্যবাহী বৌদ্ধবিহার। সেই বিহারের বিশাল বুদ্ধমূর্তি এখনো রয়ে গেছে, কিন্তু ডুবে গেছে মন্দিরটি। এ ছাড়া পুরনো প্রাসাদ থেকে একটি কামান নিয়ে আসা হয়। সেটিও চাকমা রাজার বর্তমান কার্যালয়ের পাশে রাখা আছে।
এএটি