ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১ শ্রাবণ ১৪৩২, ১৭ জুলাই ২০২৫, ২১ মহররম ১৪৪৭

সারাদেশ

ফেনীতে বন্যায় ক্ষতির শিকার ২৯ হাজার কৃষক

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩:৪১, জুলাই ১৬, ২০২৫
ফেনীতে বন্যায় ক্ষতির শিকার ২৯ হাজার কৃষক বাঁধ ভেঙে ঢুকছে পানি

মুহুরী, কহুয়া ও সিলোনীয়া নদীর বাঁধভাঙা পানির তোড়ে ক্ষতির শিকার হয়েছেন ফেনীর ২৯ হাজার কৃষক। জমির ফসল নষ্ট হয়ে যাওয়ায় তারা অনিশ্চয়তায় দিন কাটাচ্ছেন।

আউশ, আমন বীজতলা, গ্রীষ্মকালীন সবজি ও আদা ক্ষেত একেবারে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে।  

জেলা কৃষি বিভাগ বলছে ৭ জুলাই থেকে শুরু হওয়া বন্যায় জেলায় অন্তত ৩৮ কোটি সাত লাখ টাকার ফসল নষ্ট হয়ে গেছে, যা থেকে অন্তত ১০ হাজার টন খাদ্য উৎপাদন করা সম্ভব হতো।

জানা যায়, ৭ জুলাই সোমবার থেকে ভারী বৃষ্টি ও ৮ জুলাই থেকে নদী রক্ষা বাঁধের ভাঙন শুরু হয়। একপর্যায়ে ফেনীর ফুলগাজী ও পরশুরাম উপজেলার ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া মুহুরী, কহুয়া ও সিলোনীয়া নদী রক্ষা বাঁধের বিভিন্ন স্থানে ভেঙে লোকালয়ে পানি ঢুকতে থাকে। একের পর এক গ্রাম তলিয়ে যেতে থাকে। রাস্তাঘাট, বিদ্যুৎ সংযোগ ও যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।

অবস্থা বেগতিক দেখে মানুষ ঘর বাড়ি রেখে আশ্রয়কেন্দ্রে ছুটতে থাকে। সর্বশেষ বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের ৪১টি স্থানে ভেঙে জেলার ফুলগাজী, পরশুরাম, ছাগলনাইয়া, ফেনী সদর ও দাগনভূঞা উপজেলার ১৩৭টি গ্রাম পানির নিচে তলিয়ে যায়। বন্যার পানি গড়িয়ে জেলায় ১২৬টি সড়কের প্রায় ৩০০ কিলোমিটারে বড় বড় গর্তের সৃষ্টি হয়ে চলাচল অনুপযোগী হয়ে পড়ে।  

খামারে পানি ওঠায় অন্তত ১৫ থেকে ১৭ হাজারটি হাঁস ও মুরগি মারা যায়। শতাধিক ঘর ধসে পড়ে বন্যার পানিতে ভেসে গেছে। অন্তত আড়াই হাজার পুকুর থেকে আট কোটি টাকার মাছ ও মাছের পোনা ভেসে যায়। ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির কবলে পড়ে খাদ্য উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত কৃষি খাত।

ফুলগাজী ও পরশুরামে নদী রক্ষা বাঁধের কয়েকটি স্থানে জোড়া তালির ‘জরুরি মেরামত’ শুরু করেছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। এখনো বন্যা কবলিত বহু গ্রাম থেকে পানি নামেনি। জলাবদ্ধতায় বেড়েছে জনদুর্ভোগ।

রাস্তা ভেঙে যাওয়ায় অনেক এলাকা এখনো জেলা ও উপজেলা শহর থেকে বিচ্ছিন্ন রয়েছে। এখনো বসতভিটা পানির নিচে তলিয়ে থাকায় জেলার ছয়টি আশ্রয়কেন্দ্রে ৮৮টি পরিবারের ৩৬৩ জন সেখান থেকে যেতে পারেননি।

জেলা কৃষি বিভাগ জানায়, সম্প্রতি বন্যায় ফেনীর সব উপজেলার ফসলি জমি কম-বেশি আক্রান্ত হয়েছে। জেলায় বন্যার পানিতে কৃষিতেই অন্তত ৩৮ কোটি ৭ লাখ টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে আমন বীজতলার।  

জেলায় এক হাজার ৩২২ হেক্টর জমিতে আমনের বীজ ফেলেন কৃষকেরা। এর মধ্যে ৬৯৪ হেক্টর বীজতলা বন্যার পানিতে নিমজ্জিত হয়েছে। পানিতে তলানো ১৯৭ হেক্টর বীজতলা পুরোপুরি পচে যায়। বাকি ৪৯৭ হেক্টর বীজতলার আংশিক ক্ষতি হয়েছে। এতে করে কৃষকদের অন্তত দুই কোটি ২৪ লাখ টাকার ক্ষতি হয়। শুধু আমন বীজতলা করেই জেলায় প্রায় ১৭ হাজার কৃষক ক্ষতির কবলে পড়েছেন।

এর বাইরে জেলায় পানিতে নিমজ্জিত হয়ে ৫৫৭ হেক্টর জমির গ্রীষ্মকালীন সবজি ক্ষেত বন্যার পানিতে আক্রান্ত হয়। এতে ৩২৭ হেক্টর জমির সবজি ও গাছ সম্পূর্ণ পচে গেছে। ২৩০ হেক্টর জমির সবজি আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বন্যায় সাড়ে সাত হাজার কৃষকের গ্রীষ্মকালীন সবজির ক্ষতির পরিমাণ ২৭ কোটি ৮৫ লাখ টাকা।

৩৪৬ হেক্টর জমির আউশ আবাদ পানিতে তলিয়ে সাড়ে তিন হাজার জন কৃষকের ক্ষতি হয়েছে প্রায় ছয় কোটি টাকা। এ ছাড়া জেলায় বন্যা আক্রান্ত এলাকায় গ্রীষ্মকালীন মরিচ, আদা, হলুদ, টমেটো, বস্তায় আদার জমিতে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।  

পরশুরাম উপজেলার মির্জানগর ইউনিয়নের কৃষক আবদুস সামাদ বলেন, ধার-দেনা করে ৫০ শতক জমিতে সসিন্দা ও তিতা করলা করেছি। বাজারে সবজির দামও ভালো পাচ্ছিলাম। এরমধ্যে বন্যায় সবকিছু নিয়ে গেছে। কীভাবে মানুষের ধার-দেনা দেব জানি না। আশ্রয়কেন্দ্র থেকে বাড়িতে এসে দেখি ঘরের সব আসবাবপত্র পচে গেছে। থাকব কোথায়, যাব কোথায় তা নিয়ে অনিশ্চয়তায় পড়েছি।

চিথলিয়া ইউনিয়নের মোস্তফা মিয়া বলেন, ২০২৪ সালের বন্যায় আমার অন্তত এক একর জমির ফসল নষ্ট হয়েছে। পরে উপজেলা অফিস থেকে আমাকে কিছু সার ও বীজ দেওয়া হয়, যা ক্ষয়ক্ষতির তুলনায় কিছুই নয়। সরকার শুধু ক্ষয়ক্ষতির তালিকাই করে। কাজের কাজ তেমন কিছুই হয়নি।

ফেনী জেলা কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের উপ-পরিচালক মোহাম্মদ আতিক উল্লাহ বলেন, চলতি মাসের বন্যায় ফেনীতে ২৮ হাজার ৮৩৫ জন কৃষকের অন্তত ৩৮ কোটি টাকার ফসলের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এসব ফসল থেকে জেলায় অন্তত সাড়ে নয় হাজার টন খাদ্যশস্য উৎপাদন হওয়ার সম্ভাবনা ছিল। আমরা মাঠপর্যায়ে পাওয়া এ সংক্রান্ত ক্ষয়ক্ষতির একটি প্রতিবেদন ঊর্ধ্বতন পর্যায়ে পাঠিয়েছি। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের প্রণোদনার বিষয়ে পরবর্তী নির্দেশনার আলোকে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

তিনি জানান, বন্যায় জেলার বিভিন্ন উপজেলায় সবজি ক্ষেত নষ্ট হয়েছে। এতে করে জেলার বিভিন্ন হাট বাজারে শাক ও সবজির দাম কিছুটা বেড়েছে। অন্য জেলা থেকে সবজি সরবরাহ শুরু হলে এ সংকট কেটে যাবে।

ফেনীর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আক্তার হোসেন মজুমদার বলেন, ভারতের উজান থেকে নেমে আসা পানির চাপে মুহুরী, কহুয়া ও সিলোনীয়া নদীর বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের ৪১টি স্থান ভেঙে জেলার ১৩৭টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে।  

এখন নদীর পানি বিপৎসীমার নিচে প্রবাহিত হচ্ছে। পানি কমে আসায় কয়েকটি ভাঙনে জরুরি মেরামত শুরু হয়েছে। বৃষ্টি বন্ধ থাকলে স্বল্প সময়ের মাঝেই ভাঙনকবলিত স্থান মেরামত করা শেষ করা হবে বলে আশ্বাস দেন তিনি।

ফেনী জেলা প্রশাসক সাইফুল ইসলাম বলেন, এখনো ফেনীর সাতটি গ্রাম পানিতে নিমজ্জিত রয়েছে। বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হলেও বন্যার পানি এখনো সব জায়গা থেকে নামেনি। বিভিন্ন বিভাগ থেকে পাওয়া বন্যায় ক্ষয়ক্ষতির প্রতিবেদন ঊর্ধ্বতন পর্যায়ে পাঠানো হচ্ছে। ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসন ও প্রণোদনার বিষয়ে পরবর্তী নির্দেশনার আলোকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হবে।

আরএইচ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।