ফ্যাসিস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগের এক দফা দাবিতে গত বছর ৫ আগস্ট আন্দোলনরত অবস্থায় গাজীপুরের কোনাবাড়ীতে জুলাই অভ্যুত্থানে পুলিশের গুলিতে নিহত কলেজ ছাত্র হৃদয়ের মৃত্যুর এক বছর পার হলেও এখনও তার মরদেহ পাওয়া যায়নি। আর সে কারণে নামও ওঠেনি শহীদের তালিকায়।
বছর পার হয়ে গেছে এখনও ছেলের লাশ পাননি, তাই হাড়গোড় হলেও পেতে চান তারা। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলন ও আনন্দ মিছিলে অংশ নিতে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন হৃদয়। ঘটনার ভিডিও থাকলেও এক বছরের বেশি সময় ধরে বিভিন্ন দফতরে ঘুরেও কোনো সুরাহা পাননি তার স্বজনরা। এমনকি হৃদয়ের মরদেহেরও হদিস মেলেনি।
টাঙ্গাইলের গোপালপুর উপজেলার আলমনগর গ্রামের বাসিন্দা হৃদয়ের পরিবার আজও বিশ্বাস করতে পারেন না তারা হৃদয়কে হারিয়েছেন। হৃদয় ছিলেন পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। তিনি হেমনগর ডিগ্রি কলেজে একাদশ শ্রেণিতে পড়তেন। লেখাপড়ার পাশাপাশি গাজীপুরের কোনাবাড়ীতে ব্যাটারিচালিত ইজিবাইক চালাতেন তিনি। তার পাঠানো টাকায় কোনোরকমে চলতো সংসার। এখন সেই আয়ের পথও বন্ধ হয়ে গেছে। বৃদ্ধ বাবা ভ্যান চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করলেও শোকে আর ঠিকমতো কাজ করতে পারেন না। এনজিওর ঋণ পরিশোধ না করতে পেরে আরও সংকটে পড়েছে পরিবারটি।
জানা গেছে, ৫ আগস্ট হৃদয় কোনাবাড়ী সড়কে সরকারের বিরুদ্ধে স্লোগান দিচ্ছিলেন। এ সময় পুলিশের উপস্থিতি দেখে হৃদয় রাস্তার পাশে অবস্থান নেন। সেখানে দায়িত্ব পালন করছিলেন শিল্প পুলিশের কিছু সদস্য। তারা হৃদয়কে রাস্তার পাশ থেকে ধরে নিয়ে চড়থাপ্পড় মারেন। একপর্যায়ে পুলিশ গুলি করলে সেখানেই তিনি মারা যান। এ ঘটনায় হৃদয়ের ভগ্নিপতি মো. ইব্রাহীম বাদী হয়ে কোনাবাড়ী থানায় একটি হত্যা মামলা করেন। মামলায় সাবেক মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক, গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি আজমত উল্লা ও গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক সিটি মেয়র জাহাঙ্গীর আলমকে হুকুমের আসামি এবং অজ্ঞাত ২৫০-৩০০ জনকে আসামি করা হয়।
হৃদয়ের লাশের সন্ধানে তুরাগ নদীতে ডুবুরি দল
কলেজছাত্র হৃদয়ের মরদেহ উদ্ধারে বৃহস্পতিবার (২৪ জুলাই) গাজীপুর মহানগরীর কড্ডা ব্রিজ এলাকায় তুরাগ নদীতে উদ্ধার অভিযান চালিয়েছে ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরি দল। উদ্ধার অভিযান চলাকালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত কমিটির পরিদর্শক মাসুদ পারভেজসহ সংশ্লিষ্টরা উপস্থিত ছিলেন। এ সময় তারা উদ্ধার কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করেন।
গাজীপুর ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স উপ-পরিচালক মোহাম্মদ মামুন জানান, ডুবুরি দলের সদস্যরা সকাল ১০টা থেকে উদ্ধার কাজ শুরু করে। দুপুর ৩টা পর্যন্ত উদ্ধারের তৎপরতা করলেও নদীর স্রোত ও পানি ঘোলাটে থাকায় বেগ পেতে হয়েছে।
নিহত হৃদয়ের বড় বোন জেসমিন আক্তার বলেন, হৃদয় ছিল আমাদের একমাত্র ছোট ভাই। আমাদের অভাবের সংসারে সে কষ্ট করে লেখাপড়া করতো। হৃদয়ের লাশ পাওয়া যায়নি বলে আমার ভাই শহীদের মর্যাদাও পায়নি। সরকারের পক্ষ থেকে কোনো সহযোগিতাও পাইনি। এতদিন কোনো খোঁজ না নিলেও দীর্ঘ এক বছর পর ভাইয়ের লাশ উদ্ধারের জন্য নদীতে উদ্ধার অভিযান চালানো হলো। তাও আবার এই বিশাল বড় নদীতে।
মামলার বাদী হৃদয়ের ভগ্নিপতি মো. ইব্রাহিম বলেন, শেখ হাসিনার পদত্যাগ ও দেশ ত্যাগের পর তারা আনন্দ মিছিলে অংশ নেয়। মিছিলটি কোনাবাড়ী থানার কাছাকাছি পৌঁছালে থানার ভেতর থেকে পুলিশ গুলি ছুড়তে থাকে। একপর্যায়ে পুলিশের ১০-১২ জন তিনটি দলে ভাগ হয়ে মিছিলে অংশ নেওয়া ছাত্র জনতার ওপর হামলা চালায়। এরই অংশ হিসেবে তারা হৃদয়কে গুলি করে লাশ গুম করার উদ্দ্যেশে একটি গলিতে নিয়ে যায়। এ সংক্রান্ত একাধিক ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে।
তিনি আরও বলেন, ৫ আগস্ট সকাল থেকেই হৃদয় ও তিনি ফ্যাসিবাদ বিরোধী আন্দোলনে অংশ নেয়। এক বছর পর সরকার নিহতের লাশ উদ্ধারের জন্য তুরাগ নদীতে অভিযান চালিয়েছে। আমার ভাইয়ের একটি হাড়ও যদি পাই তাহলে সেটি নিয়ে পরিবারের সবাইকে বুঝ দিতে পারবো। বাড়ির পাশে একটি কবর দিতে পারবো।
হৃদয়ের মা রেহানা বেগম ও বাবা লাল মিয়া বলেন, আমরা শুধু আমাদের ছেলের হাড়গোড় ফেরত চাই। আর যারা এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে, তাদের ফাঁসি চাই। অন্তত শহীদদের তালিকায় যেন আমার হৃদয়ের নাম ওঠে।
উল্লেখ্য, গত বছর ৫ আগস্ট হৃদয় নিহত হওয়ার একটি ভিডিও দেশব্যাপী সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। ভাইরাল হওয়া ভিডিওতে দেখা যায়, কোনাবাড়ীর ফাঁকা রাস্তার ওপর কলেজ পড়ুয়া হৃদয়কে সশস্ত্র কয়েকজন পুলিশ সদস্য ঘিরে রেখে গুলি করছে। ভিডিওতে প্রকাশ্যে পুলিশের গুলিতে হৃদয় নিহত হওয়ার দৃশ্য দেখা গেলেও মামলার এজাহারে বা এফআইআর এ কোনো পুলিশ সদস্যের নাম ছিল না। পরে ফুটেজ দেখে থানা পুলিশ ঘটনার সময়ে ঘটনাস্থলে দায়িত্ব পালনকারী পুলিশ সদস্যদের পরিচয় শনাক্ত করে। ঘটনায় সরাসারি জড়িত কনস্টেবল আকরামকে কিশোরগঞ্জ থেকে গত ৬ সেপ্টেম্বর গ্রেপ্তার করে পুলিশ। ১০ দিন রিমান্ড শেষে গত ৯ সেপ্টেম্বর আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়। পরবর্তীতে গত ২৩ ডিসেম্বর আদালত তার জামিন মঞ্জুর করেন। পরের দিন এ বিষয়ে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রচার হয়। পরে ২৪ ডিসেম্বরই গাজীপুর জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক বেগম শামীমা আফরোজ জামিনে থাকা আসামির জামিন বাতিল করে গ্রেপ্তারের আদেশ দেন। পরে ওইদিনই গাজীপুর মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা পুলিশ আসামিকে মহানগরীর বাসন থানা এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করে।
এ মামলার তদন্ত কর্মকর্তা গাজীপুর মেট্রোপলিটন গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) উত্তরের ওসি মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, এ মামলায় এখন পর্যন্ত ১১ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এদের মধ্যে যে ব্যক্তিগত গাড়িটি ব্যবহার করে হৃদয়ের লাশ তুরাগ নদীতে ফেলা হয়েছে সেই গাড়ির চালক রহিম (২৭) আদালতে ১৬৪ দ্বারা স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। এরই অংশ হিসেবে বৃহস্পতিবার তুরাগ নদীতে অভিযান চালানো হয়েছে। আশা করছি খুব শিগগিরই হৃদয়ের মরদেহ উদ্ধার করা সম্ভব হবে।
এ বিষয়ে জানতে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত কমিটির পরিদর্শক মাসুদ পারভেজের মোবাইল ফোনে কল দেওয়া হলে ফোনটি বন্ধ পাওয়া যায়।
আরএ