ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২ শ্রাবণ ১৪৩২, ১৭ জুলাই ২০২৫, ২১ মহররম ১৪৪৭

সারাদেশ

জুলাইগাথা

দুই মেয়ে নিয়ে অসহায় জীবনযাপন শহীদ আবুল কালামের পরিবারের

মুহাম্মদ মাসুদ আলম, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২:০৭, জুলাই ১৭, ২০২৫
দুই মেয়ে নিয়ে অসহায় জীবনযাপন শহীদ আবুল কালামের পরিবারের শহীদ মো. আবুল কালামের পরিবার

চাঁদপুরের হাজীগঞ্জ উপজেলার সদর ইউনিয়নের পূর্ব কাজিরগাঁও গ্রামের বড় বাড়ির মৃত সৈয়দুর রহমানের ছেলে শহীদ মো. আবুল কালাম।  

পরিবার নিয়ে থাকতেন কুমিল্লায়।

পেশায় ছিলেন আইনজীবী। ৫ আগস্ট আদালত থেকে বের হয়ে যাওয়ার সময় পেছন দিক থেকে গুলিবিদ্ধ হন। চিকিৎসাধীন থেকে ১৬ আগস্ট তিনি মারা যান।  

গ্রামের বাড়িতে কোনো বসতঘর না থাকায় তার পরিবার কুমিল্লায় ভাড়া বাসায় থাকেন। স্বামী হারিয়ে দুই মেয়েকে নিয়ে বর্তমানে অসহায় জীবনযাপন করছেন এই শহীদ পরিবারের সদস্যরা।

মো. আবুল কালাম। জন্ম ১ জানুয়ারি ১৯৬৮খ্রি.। বাবা মৃত সৈয়দুর রহমান। মা মৃত তফুরা বেগম। শহীদ আবুল কালমের ৬ ভাই ৬ বোন। বড় ভাই আবু তাহের (৬৫), মঞ্জুমা (৬১), আব্দুল মান্নান (৫৫), রৌশন আরা (৫৩), শামছুন্নাহার (৫১), আলেয়া সুলতানা (৪৯), শোরাব হোসেন (৪৭), সোহেল হোসেন (৪৫), ফরিদা ইয়াসমিন (৪৩), শাহনাজ (৪১) ও রাসেল হোসেন (৩৯)। সব বোনদের বিয়ে হয়েছে এবং গৃহিণী। ভাইদের মধ্যে চারজনই ব্যবসায়ী এবং একজন প্রবাসী।

শহীদ মো. আবুল কালাম ১৯৮৩ সালে এসএসসি পাস করেছেন হাজীগঞ্জ পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় থেকে। ১৯৮৫ সালে এইচএসসি পায়েলগাছা ডিগ্রি কলেজ এবং ১৯৮৮ সালে বিএ পাশ করেছেন হাজীগঞ্জ ডিগ্রি কলেজ থেকে। ১৯৯১ সালে এলএলবি সম্পন্ন করেছেন কুমিল্লা ‘ল’ কলেজ থেকে। ১৯৯৪ সালে তিনি কুমিল্লা আইনজীবী সমিতির সদস্যভুক্ত হন এবং আইনজীবী পেশায় যুক্ত হন।

সম্প্রতি এই শহীদের বাড়িতে গিয়ে তার স্ত্রী ও মেয়েদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।

শহীদ আবুল কালামের স্ত্রী ও দুই মেয়ে বর্তমানে কুমিল্লা নান্না দীঘির পাড়ে একটি বাড়িতে ভাড়া থাকেন। বড় মেয়ে নিশাত জাহান মম (২৪) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জাপানি স্টাডিজ সোস্যাল সায়েন্স বিষয়ে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেছেন। বর্তমানে একটি বেসরকারি ব্যাংকে অস্থায়ীভাবে চাকরি করছেন। ছোট মেয়ে তাছনিয়া অনি চলতি বছর কুমিল্লা মর্ডান স্কুল থেকে এসএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে উত্তীর্ণ হয়েছে।

শহীদ মো. আবুল কালামের গ্যাজেট নম্বর: ৩৮২ এবং মেডিকেল কেইস আইডি ২২৩৮৯। এই পর্যন্ত জুলাই ফাউন্ডেশন থেকে পেয়েছেন ৫ লাখ টাকা। জেলা প্রশাসন থেকে ২ লাখ এবং জামায়াতে ইসলামী থেকে ৫০ হাজার টাকা।  

হাজীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা অনুদান দিয়েছে ১০ হাজার টাকা। সর্বশেষ জুলাই ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে ১০ লাখ টাকা সঞ্চয়পত্র পেয়েছেন।

স্ত্রী ও মেয়েরা জানান, কালাম ৫ আগস্ট আদালত থেকে বাসায় ফেরার সময় বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে সড়কে এসেই গোলাগুলির মধ্যে পড়েন। ওই সময় পেছন দিক থেকে তার মেরুদণ্ডে গুলি লাগে। সেখানেই তিনি লুটিয়ে পড়লে সহকর্মী আইনজীবীরা উদ্ধার করে প্রথমে তাকে কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখান থেকে অ্যাম্বুলেন্স করে নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকা পপুলার হাসপাতালে। ওই হাসপাতালে চিকিৎসা চলে চারদিন। অবস্থার অবনতি হলে আইসিইউতে রাখা হয়। ১৬ আগস্ট তিনি চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন। এর পর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তার ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়।

এদিকে ১৬ আগস্ট কুমিল্লা জজ আদালত প্রাঙ্গণে বাদ জুমআ এই শহীদের প্রথম নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। এরপর ওই দিন বাড়িতে নিয়ে আসা হয়। বাদ আছর বাড়ির পাশের মসজিদের সামনে দ্বিতীয় নামাজে জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে বাবা-মায়ের পাশে দাফন করা হয়।

স্ত্রী হাসিনা সুলতানা বলেন, তার স্বামী খুবই সহজ সরল ছিলেন। আন্দোলনের শুরু থেকে তিনি আহত এবং নির্যাতিত শিক্ষার্থীদের পক্ষে থেকে আইনি সেবা দিয়েছেন। তিনি কুমিল্লা আইনজীবী সমিতির দুইবার নির্বাচিত যুগ্ম সম্পাদক ছিলেন।

তিনি আরও বলেন, ১৯৯৯ সালে বড় মেয়ে এবং ২০০৮ সালে ছোট মেয়ের জন্ম হয়। এরপর থেকে খুবই কষ্টের মধ্যে থেকে সংসার চালিয়েছেন। মেয়েরা যেন পড়ালেখা করে মানুষের মতো মানুষ হয় এবং তার স্বপ্ন পূরণ করে এটাই ছিল তাদের বাবার স্বপ্ন। তিনি মারা যাওয়ার পরে আমরা খুবই অসহায় হয়ে পড়েছি। অভিভাবক ছাড়া দুই মেয়েকে নিয়ে খুবই দুশ্চিন্তায় আছি। বাড়িতে জমি থাকলেও বসতঘর নেই।  

বড় মেয়ের কর্মস্থল এবং ছোট মেয়ের ভবিষ্যতের জন্য সরকারের সহযোগিতা কামনা করেন তিনি।

মেয়ে নিশাত জাহান মম বলেন, বাবার স্বপ্ন ছিল আমি বিসিএস ক্যাডার হব। সেই স্বপ্ন পূরণ করার জন্য আমি চেষ্টা করে যাচ্ছি।

ছোট মেয়ে তাছনিয়া অনি বলে, বাবা নেই এখনো মানতে পারছি না। বাবার শূন্যতা আমাকে খুবই বেদনা দেয়। কারণ আমার সব চাওয়া-পাওয়া ছিল বাবার কাছে। বাবার স্বপ্ন ছিল আমি আইনজীবী হই। সবার সহযোগিতা থাকলে বাবার ইচ্ছে পূরণ করতে পারবো।

শহীদ কালামের চতুর্থ ভাই শোয়েব হোসেন বলেন, ভাই কুমিল্লা থাকলেও যে কারো বিপদে এগিয়ে আসতেন। এলাকার গরিব মানুষদের খোঁজ খবর নিতেন। এলাকার ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের উন্নয়নে সব সময় কাজ করতেন। আমরাও চেষ্টা করবো ভাইয়ের এই কাজ অব্যাহত রাখতে।

এই শহীদের সঙ্গে সবচাইতে বেশি সখ্যতা ছিল ছোট ভাই আবু সালাত রাসেলের। ভাইয়ের সঙ্গে নিয়মিত কথা হতো। গুলিবিদ্ধ হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসার সময় রাসেল তার সঙ্গেই ছিলেন।

তিনি বলেন, বাবা-মা বেঁচে থাকা অবস্থায় সব সময় ভাই খোঁজ খবর নিতেন। কখন কী লাগবে এই নিয়ে অস্থির থাকতেন। আমাকে বলতেন-কথা কম বলবে, শুনবে বেশি। শেষ মুহূর্তে হাসপাতালে থেকেও আমাকে সর্তক হয়ে চলার জন্য বলেন।  

আরএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।