ঢাকা, শুক্রবার, ২০ আষাঢ় ১৪৩২, ০৪ জুলাই ২০২৫, ০৮ মহররম ১৪৪৭

সারাদেশ

চাঁদপুর বিআরটিএ যেন অনিয়মের আখড়া!

মুহাম্মদ মাসুদ আলম, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০:০৩, জুলাই ৪, ২০২৫
চাঁদপুর বিআরটিএ যেন অনিয়মের আখড়া!

চাঁদপুর: বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ) চাঁদপুর কার্যালয়ে গাড়ির নিবন্ধন, ড্রাইভিং লাইসেন্স, নম্বর প্লেট লাগানো ও মালিকানা হস্তান্তরসহ বিভিন্ন সেবা নিতে এসে গ্রাহকরা পদে পদে ভোগান্তিতে পড়েন।  

এ কার্যালয়ে এলে দালালদের দেখলে মনে হবে তারা দপ্তরেরই কর্মচারী।

কর্মচারীদের সঙ্গে বাইরের লোকরা মিলে অনিয়মের আখড়ায় পরিণত করেছে এ দপ্তর। কর্তৃপক্ষ বলছে, এসব অনিয়ম পর্যায়ক্রমে সমাধান করার চেষ্টা চলছে।

এ কার্যালয়ে কয়েকদিন অবস্থান করে সেবা নিতে আসা লোকজন, দালাল চক্রের সদস্য ও কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।

এ দপ্তরে সরকারি জনবলের সংখ্যা তিন। কর্মকর্তাদের মধ্যে একজন মোটরযান পরিদর্শক এবং অপরজন সহকারী পরিচালক (ইঞ্জিনিয়ার)। এছাড়া দৈনিক হাজিরা ভিত্তিক একজন কর্মচারী কাজ করেন। এদের বাইরে দালাল হিসেবে অফিসের চেয়ার টেবিল ব্যবহার করে কাজ করেন মো. শহীদ, মো. শাহজাহান, মো. মানিক ও মোহাম্মদ আলী।

তারা ছাড়াও টাকার বিনিময়ে কাজ করিয়ে দেন অটোরিকশাচালক শ্রমিক ইউনিয়নের নেতা রিপন ও ট্রাক লরি শ্রমিক ইউনিয়ন নেতা মন্টু।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দৈনিক হাজিরা ভিত্তিক কর্মচারী জিয়া হক হলেন অফিসের সব অনিয়মের ‘সমন্বয়ক’। তাকে সহযোগিতা করেন শহীদ, শাহজাহান, আলী ও মানিক।

মঙ্গলবার (১ জুলাই) ভোরে ড্রাইভিং লাইসেন্সের ফিঙ্গারপ্রিন্ট দিতে আসেন প্রায় দুই শতাধিক মানুষ। তাদের মধ্যে নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক ব্যক্তি বলেন, সরকারি ফি পরিশোধ করার পরও নানা রকম ভুল দেখিয়ে ভোগান্তিতে ফেলা হয়। দালালদের মাধ্যমে টাকা দিলে খুব সহজেই কাজ হয়ে যায়।

ফরিদগঞ্জ থেকে আসা একজন গ্রাহক বলেন, চাঁদপুরের সুমাইয়া মোটরসের মাধ্যমে তিনি ড্রাইভিং লাইসেন্সের জন্য ১২ হাজার টাকা দিয়েছেন। তার লাইসেন্স পাওয়ার জন্য সব কাজ তারা করে দেবেন।

এছাড়া শহরের যে কয়েকটি মোটরসাইকেলের শোরুম রয়েছে, সবগুলোর বিক্রয় কর্মী কিংবা ম্যানেজারই হচ্ছেন এ দপ্তরের দালাল। তারা মোটরসাইকেলের নিবন্ধন প্রতি অতিরিক্ত এক হাজার টাকা দেন বিআরটিএর দপ্তরে। বিআরটিএর কার্যালয়ে পাওয়া গেছে শহরের স্টেডিয়াম রোডের হিরো নিলয় মোটরসাইকেল শোরুমের ম্যানেজার নয়নকে।

এ বিষয়ে একাধিক মোটরসাইকেল বিক্রয় কেন্দ্রের বিক্রয় কর্মীরা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, বিআরটিএর অফিস অতিরিক্ত টাকা নেওয়ার বিষয়ে তারাও প্রতিকার চান।

ফিঙ্গারপ্রিন্ট নিতে আসা লোকজন প্রতি সপ্তাহের নির্ধারিত দিনে এ কার্যালয়ে আসেন। সেখানে থাকে একাধিক দালাল। নম্বর প্লেট লাগানোর কাজ করেন মোহাম্মদ আলী। তিনি হলেন দালালদের একজন। জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের কপ্লেক্সের ভেতরে উপআনুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরো অফিসের পিয়ন এবায়েদুল হক। তিনি ফ্রিঙ্গারপ্রিন্ট দিতে আসা লোকদের কোন ঝামেলা ছাড়া লাইসেন্স করে দেওয়ার চুক্তি করেন।  

এ কাজ করার সময়ই কথা হয় এবায়েদুল হকের সঙ্গে। তিনি বলেন, আমি ভোর ৬টায় আসি। এখানে যারা আসেন তাদের কাজের চুক্তি করে দিলে ২০০ টাকা করে পাই।  

এরপর তিনি সরকারি টেলিফোন ব্যবহার করে দালাল আলীকে নিয়ে আসেন দ্বিতীয় তলায়। আলী সাংবাদিক দেখে কেটে পড়েন।

দুদিন এ দপ্তরে অবস্থান করলে দপ্তরের অধিকাংশ দালাল স্থান ত্যাগ করে বিভিন্ন স্থানে চলে যান। দালালদের মধ্যে মানিকের সঙ্গে কথা হয়। তিনি বলেন, আমি এখন কাজ করি না। চিকিৎসার জন্য আসছি। এমনিতে অফিসের সামনে বসে আছি।

দপ্তর ছেড়ে চলে যান দালাল শহীদ। তিনি বলেন, ভাই আমার বিষয়ে কিছু লেইখেন না।  

আরেক দালাল শাহজাহান। তিনি প্রাইভেটকার দিয়ে পরীক্ষা নেন। সেখানে জনপ্রতি নেন ২০০ টাকা করে। তিনি আবার ক্ষমতাধর আত্মীয় স্বজনের পরিচয় দেন।  
 
আরেক দালাল মোহাম্মদ আলীকে জিজ্ঞাসা করা হয় আপনি এ দপ্তরের কোন পদে চাকরি করেন। তিনি এলোমেলো উত্তর দিয়ে কেটে পড়েন। মূলত তিনি কাজ করেন নম্বর প্লেট লাগানোর। সেখানেও লোকদের জিম্মি করে ২০০ টাকার স্থলে নেন ৪০০ টাকা করে।

এ অফিসের দৈনিক হাজিরার কর্মচারী জিয়া হক। তথ্য নেওয়ার সময় তিনি বার বার এ প্রতিবেদককে থামিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন। তিনি আরেক সাংবাদিক দিয়ে ফোন করান, কেন বিআরটিএর দপ্তরে যাওয়া হয়েছে। সেখানে সাংবাদিকের কাজ কী?

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এ দপ্তরের অনিয়মের চিত্র তুলে আনতে গেলে সাংবাদিকদের ম্যানেজ করেন জিয়া হক। সব অনিয়ম তার কাছে স্পষ্ট। দালালদের মাধ্যমে জিয়া হকই সব কাজ সম্পন্ন করেন। তার শক্তি হিসেবে আছে কথিত কয়েকজন সাংবাদিক। তাদের নিজস্ব সিএনজি চালিত অটোরিকশা ও গাড়ি আছে। সেগুলো নিবন্ধন ছাড়া গাড়ি।  

জিয়া হক বলেন, আমি কোনো অনিয়মে নাই। আমি সবার সঙ্গে খুব ভালো আচরণ করি।

দপ্তরের অধিকাংশ সময় উপস্থিত থাকেন মোটরযান পরিদর্শক আলা উদ্দিন। তিনি বলেন, আমি পাঁচ মাস আগে এ কার্যালয়ে যোগ দিয়েছি। অনিয়ম থাকতে পারে। তবে আমার চোখে পড়ে না।

বিআরটিএ চাঁদপুর কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক মো. কামরুজ্জামান বলেন, আমি দুই জেলার দায়িত্বে। লক্ষ্মীপুর জেলায় কাজ করতে হয়। আবার চাঁদপুর কার্যালয়ে আসি। এ কার্যালয়ের যেসব অনিয়মের কথা জানতে পেরেছি, খোঁজ খবর নিয়ে সমাধান করার চেষ্টা করব।

এসআই
 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।