রাজধানীর পুরান ঢাকায় একটি শ্লোক খুব প্রচলিত। সেটি হলো—‘নখ নিয়া যেমন-তেমন, চোখ নিয়া ঢং না।
বাংলাদেশের জন্য তা আরো বেশি প্রযোজ্য। কিন্তু এখানে সময়ে সময়ে কেবল হেলাফেলা নয়, বিতর্কেও টেনে আনা হয় সেনাবাহিনীকে। জাতিগত ঐক্য ও সংহতির এই প্রতীককে বিতর্কের ঊর্ধ্বে না রাখলে ভরসার জায়গাও অবশিষ্ট থাকে না। কখনো তা না বুঝে, কখনো জেনে-বুঝেও সেনাবাহিনীকে বিরক্ত-বিব্রত করার অপচেষ্টা চলে।
কোনো না কোনো ইস্যুতে বা অসিলায় সেনাবাহিনীকে চটানোর সূক্ষ্ম চেষ্টা দৃশ্যমান।
এ চেষ্টায় সফল হলে দেশে একটি নৈরাজ্য বা ভজকট পাকানোর আশাবাদী গোষ্ঠীই লাভবান হয়। সম্প্রতি এরা যারপরনাই আদাজল খেয়ে নেমেছে। হালে পানি না পেলেও এরা হাল ছাড়ছে না।
সেনাবাহিনী নিয়ে অবান্তর কথা, আজেবাজে ন্যারেটিভ তৈরি, হালকা কথা চালাচালি তাদের কাছে বাতিকের মতো। চব্বিশের জুলাই-আগস্ট বিপ্লবের পর রোগটি সেরে যেতে পারত। কিন্তু মাঝেমধ্যেই তা মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। সেই সঙ্গে রাতের ঘুম নষ্ট করা গুজবের হাট। গত রাতে সেনানিবাসে ছাটখাটো ক্যু একটা হয়ে গেছে, সামনে বড় রকমের একটা হবে, সেনাপ্রধানকে ঘেরাও করে ফেলা হয়েছে, জাহাঙ্গীর গেটসহ বিভিন্ন জায়গা দিয়ে ট্যাংক বেরিয়ে পড়েছে—এ ধরনের তথ্য রটাতেও বিবেকে বাধছে না গুজববাজদের।
আঁঁকাবাঁকা ন্যারেটিভ আলোচিত গুম কমিশনকে বানিয়ে ফেলা হচ্ছে সেনাবাহিনীর বিচারের কমিশন। একটা নিখুঁত ন্যারেটিভ তৈরি করে বলা হচ্ছে, শেখ হাসিনার শাসনামলে কুকর্মে জড়িত সেনা সদস্যদের বিচার হবে। সেনা সদর থেকে বিষয়টি ঝরঝরেভাবে পরিষ্কার করা হয়েছে আনুষ্ঠানিক ব্রিফিংয়ে। লাউড অ্যান্ড ক্লিয়ারে জানানো হয়েছে, গুমে জড়িত অভিযোগে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে তিনটি মামলায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারীকৃত ২৫ কর্মকর্তার মধ্যে ১৫ জন এখনো সেনাবাহিনীতে কর্মরত। একজন অবসর প্রস্তুতির ছুটিতে। এই ১৬ জনের মধ্যে মাত্র একজন ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাবেক সামরিক সচিব মেজর জেনারেল কবীর আহাম্মদ আত্মগোপনে। তাঁর বিষয়েও বিচারিক পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে সেনাবাহিনী থেকে। তাঁকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ‘ইলিগ্যাল অ্যাবসেন্ট’ ঘোষণা করা হয়েছে। খুঁজে বের করার চেষ্টাও চালাচ্ছে। তাঁরা অভিযুক্ত। অভিযোগ প্রমাণের বাকি। এর পরও সেনাবাহিনী বিচারে বাগড়া দেয়নি। সাফকথায় জানানো হয়েছে, ‘নো কম্প্রোমাইজ উইথ ইনসাফ’। ট্রাইব্যুনাল আইন ও সেনা আইনকে মুখোমুখিও করেনি সেনাবাহিনী। বরং আইনকে তার নিজস্ব গতিতে চলতে সহায়তা দিচ্ছে। গুমসংক্রান্ত অভিযোগ তদন্তের জন্য গঠিত জাতীয় কমিশনকে সেনাবাহিনী শুরু থেকেই সর্বাত্মক সহযোগিতা দিয়ে আসছে। কমিশনের চাহিদা অনুযায়ী তথ্য সংগ্রহে সহযোগিতা করেছে। নথি সরবরাহও করেছে। সাক্ষাৎকার নেওয়ার ব্যবস্থাও করেছে। বিচারপ্রক্রিয়া শুরুর পর অভিযুক্তদের পরিবার থেকে আলাদা করে সেনা হেফাজতে এনে সেনাবাহিনী এই বিচারে সহায়তা করছে। গুমের শিকার পরিবারগুলোকে গভীর সমবেদনাও জানিয়েছে। অথচ বিচার বা রায়ের আগেই মিডিয়া ট্রায়াল, পাবলিক ট্রায়াল সব করে ফেলা হচ্ছে। ব্যক্তির অপরাধে গোটা বাহিনীকেই কাঠগড়ায় নিয়ে আসার ন্যারেটিভ চর্চা হচ্ছে নিদারুণভাবে। ডিজিএফআইসহ গোয়েন্দা সংস্থাকে হয় বিলুপ্ত, নইলে অকর্মণ্য ঘোষণার ছবকও দেওয়া হচ্ছে।
এসব সবক দেওয়া ব্যক্তিরাও ভালো করে জানেন, প্রতিষ্ঠান হিসেবে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী এই ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল না। এটি কতিপয় ব্যক্তির বিরুদ্ধে অভিযোগ, প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে নয়। আরো জানেন, ঘটনাকালে অভিযুক্তদের কেউই সেনাবাহিনীর সরাসরি কমান্ডের অধীনে কর্মরত ছিলেন না। ডিজিএফআই বা র্যাবে ছিলেন ডেপুটেশনে। এ বাহিনীগুলো সেনাবাহিনীর অধীনে নয়। বিশেষ করে ডিজিএফআই সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর অধীনে। সেনাবাহিনীর কমান্ড কাঠামোর অন্তর্ভুক্ত নয়। অভিযুক্তদের কর্মকাণ্ড সেনাবাহিনীর প্রাতিষ্ঠানিক কমান্ডের বাইরে। তাঁদের সম্পর্কে সেনা সদরের পক্ষে অবগত হওয়া বা নজরদারির ব্যবস্থাই নেই। আর র্যাব স্বরাষ্ট্রের অধীনে। তা জেনে-বুঝেও গোটা সেনাবাহিনীকে কখনো সরকারের, কখনো জনগণের মুখোমুখি করে দেওয়ার অশুভ প্রবণতা চলছে। ডিজিএফআইকে পারলে বিলুপ্ত করে দেওয়ার বায়নাও ধরা হচ্ছে। এ প্রবণতায় কবে কে কখন দেশের বিচার বিভাগই বিলুপ্ত করে দেওয়ার বায়না ধরে বসে কে জানে! বলা যাবে, প্রধান বিচারপতিসহ বিচারকদের কয়েকজনও পালিয়েছেন, বিগত সরকারের নানা ফরমায়েশি কাজ করেছেন, তাই বিচার বিভাগই আর রাখার দরকার নেই। স্বয়ং খতিব পালিয়েছেন, তাহলে বায়তুল মোকাররমই বিলুপ্ত করে দেওয়া হোক। এভাবে বায়না ধরতে ধরতে এবং মনগড়া কথা বলতে বলতে একসময় যদি কেউ ন্যারেটিভ দিয়ে বসে—দেশে ভেজালের পর ভেজাল হচ্ছে, তাই ভেজালের এ দেশটাই আর রাখার দরকার নেই। বিলুপ্ত করে দেওয়া হোক বাংলাদেশকেই? বিশ্বের কোথাও এমন বায়নানামার নজির নেই। তিউনিশিয়া, শ্রীলঙ্কা, নেপালসহ কয়েকটি দেশেও বাংলাদেশ ধাঁচে অভ্যুত্থান হয়েছে। সেখানে এখানকার মতো এমন বাতিল-রহিত, বিলোপ-বিলুপ্ত বায়না ধরার কাণ্ডকীর্তি নেই। যুক্তরাষ্ট্রের সিআইএ, এফবিআই, ভারতের র বা পাকিস্তানের আইএসআই নিয়েও নিজ নিজ কথা হয় মাঝেমধ্যে। কিন্তু বিলোপ-বিলুপ্ত-সীমিত করার কথা শোনা যায়নি কখনো।
বাংলাদেশে আরেকটি ব্যতিক্রমও লক্ষণীয়। এখানে ডিজিএফআই, এনএসআই বা র্যাবের কাজ বিশাল। অপরাধ বিচেনায় নিলে দেখা যায়, তাদের কাজের ভলিউম বিবেচনায় অপকর্মে লিপ্তর সংখ্যা ডিবি, এসবি, সিআইডিসহ পুলিশের চেয়ে কম। মনিরুল-হাবিবুর-হারুন-বিপ্লব-প্রলয়দের গুমসহ কীর্তিকাহিনি অনেক বেশি। ভুক্তভোগী হিসেবে ট্রাইব্যুনালের শীর্ষজন অ্যাডভোকেট তাজুল ইসলাম, গুম কমিশনের নূর খান, এমনকি নাহিদ, হাসনাত, সারজিসসহ বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সমন্বয়করা তা ভালো করে জানেন। সাক্ষী দরকার পড়ে না, তাঁরা নিজেরাই তো ভুক্তভোগী। কিন্তু দৃষ্টিপাত সেদিকে না করে সেনাবাহিনী, ডিজিএফআইয়ের দিকে তীর ছোড়া বিচারের জন্য, না কেবলই মতলবি ন্যারেটিভের জন্য? সেনাবাহিনীর মনোবল নষ্ট করা, তাদের বিব্রত বা উত্তেজিত করতে খোঁচানো মোটেই কাম্য নয়।
অবস্থাটা একদম আজব। বাংলাদেশের মতো দুর্যোগ-দুর্বিপাকসহ জাতীয় নানা প্রয়োজনে সেনাবাহিনীর ওপর ভরসা করার দৃষ্টান্ত বিশ্বে কম দেশেই আছে। আন্তর্জাতিকভাবে গর্ব ও গৌরবের এ অংশীজনরা দেশের প্রতিটি সংকটে প্রচলিত কমান্ড উপেক্ষা করে গণমানুষের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। সংকট উত্তরণের পথ দেখিয়ে দিয়েছে। ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্টে বিশ্বস্বীকৃত এই সেনাবাহিনীকে সব বিতর্কের ঊর্ধ্বে না রাখলে দেশের আস্থা-ভরসার স্থল বলতে আর কিছু থাকে না। দেশের অতন্দ্র প্রহরীর চোখ নষ্ট করে দিতে পারলে জাতির সর্বনাশ হতে আর কিছু লাগে না।
লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট, ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন