মিসরের শারম আল শেখে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত আঞ্চলিক নেতাদের শীর্ষ সম্মেলনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বক্তব্য ইরান ভালোভাবে নেয়নি। কারণ, সাম্প্রতিক মাসগুলোতে তিনি একদিকে যুদ্ধ অবসানের কৃতিত্ব নিচ্ছেন, অন্যদিকে ইরানের ওপর নিষেধাজ্ঞা, হুমকি ও বোমাবর্ষণের মতো কর্মকাণ্ড চালিয়ে গেছেন।
ট্রাম্পের ‘আত্মপ্রশংসা’
১৩ অক্টোবর শারম আল শেখে অনুষ্ঠিত সম্মেলনে বিশ্বের বহু রাষ্ট্রনেতা উপস্থিত ছিলেন, যদিও ইসরায়েল ও হামাস—দুই মূল পক্ষই অনুপস্থিত ছিল। ইরানও ওই অনুষ্ঠান প্রত্যাখ্যান করে। সম্মেলনে ট্রাম্প বহু অপ্রাসঙ্গিক বিষয়ে কথা বলেছেন। যেমন—মিসরীয় যুদ্ধবিমান কীভাবে তাকে পাহারা দিয়ে নিয়ে গিয়েছিল, সেই গল্প করেছেন, ইতালির প্রধানমন্ত্রীকে তিনি ‘সুন্দরী’ বলেছেন, দাবি করেছেন ‘শুধু তার মতামতই গুরুত্বপূর্ণ’, এমনকি বলেছেন তার নোবেল শান্তি পুরস্কার পাওয়া উচিত ছিল। তবে গাজা যুদ্ধবিরতির ২০ দফা চুক্তির বাস্তবায়ন-সংক্রান্ত প্রধান প্রশ্নে তিনি কোনো ব্যাখ্যা দেননি।
ট্রাম্পের কিছু বক্তব্যে স্পষ্ট হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল বর্তমানে কী এজেন্ডা সামনে রাখছে। ট্রাম্প বলেন, “আজকের এই ঐতিহাসিক অর্জন শুধু গাজার যুদ্ধের সমাপ্তি নয়; এটি এক সুন্দর, নতুন মধ্যপ্রাচ্যের সূচনা। আজ থেকে আমরা এমন এক অঞ্চল গড়ে তুলব, যা হবে শক্তিশালী, স্থিতিশীল, সমৃদ্ধ এবং চিরতরে সন্ত্রাসের পথ প্রত্যাখ্যান করবে। ”
নেসেটে ইরানকে লক্ষ্য করে ‘শান্তির বার্তা’
শারম আল শেখে পৌঁছানোর আগে ট্রাম্প কয়েক ঘণ্টা দখলিকৃত ইসরায়েলি ভূখণ্ডে অবস্থান করেন এবং সেখানে তিনি ইসরায়েল–ফিলিস্তিন ইস্যুর চেয়ে বেশি কথা বলেন ইরান নিয়ে। ইসরায়েলি সংসদ ‘নেসেটে’ দেওয়া ভাষণে তিনি ঘোষণা দেন, ইরানের সঙ্গে নতুন এক চুক্তি করার জন্য তিনি প্রস্তুত।
ইরানের সঙ্গে সম্ভাব্য এক চুক্তি নিয়ে ‘বন্ধুত্বের হাত’ বাড়াতে চান উল্লেখ করে ট্রাম্প বলেন, “বন্ধুত্ব ও সহযোগিতার হাত খোলা রয়েছে। আমি বলছি, তারা (ইরান) একটি চুক্তি করতে চায়। আমরা যদি চুক্তি করতে পারি, তা হবে দারুণ। ” তবে ট্রাম্পের এই শান্তিপূর্ণ কথাবার্তার আড়ালে তার প্রশাসন ইরানের প্রতি কঠোর অবস্থান বজায় রেখেছে। বিশ্লেষকেরা বলছেন, দুই দেশের সম্পর্কে উন্নতির পথ এখনো নানা বাধায় পরিপূর্ণ।
২০১৮ সালে ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রকে ইরানের পারমাণবিক চুক্তি (জেসিপিওএ) থেকে বের করে এনে দেশটির ওপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিলেন। আর চলতি বছর দ্বিতীয় মেয়াদে আলোচনার সময় তিনি ইসরায়েলের মাধ্যমে ইরানের বেসামরিক, সামরিক ও পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালান, পরে নিজেও সেই আগ্রাসনে অংশ নেন। এখন তিনি নতুন উপায়ে ইরানের বাণিজ্য ব্যাহত করে অর্থনীতিকে আরও শ্বাসরোধ করতে চাইছেন।
ইসরায়েলের পার্লামেন্টে ট্রাম্প বলেন, “আমরা প্রস্তুত, যখন তোমরাও প্রস্তুত হবে। এটাই হবে ইরানের নেওয়া সবচেয়ে ভালো সিদ্ধান্ত এবং এটি ঘটবেই। ”
তেহরানের প্রতিক্রিয়া: ‘শান্তি নয়, ভণ্ডামি’
ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় দ্রুত এক প্রতিক্রিয়ায় ট্রাম্পের দাবিকে ‘তার কর্মকাণ্ডের সম্পূর্ণ বিপরীত’ বলে অভিহিত করে। বিবৃতিতে বলা হয়, “কীভাবে কেউ শান্তির কথা বলতে পারে, যখন সে একইসঙ্গে একটি দেশের আবাসিক এলাকা ও শান্তিপূর্ণ পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালিয়ে নিরীহ মানুষ হত্যা করে?”
এর আগে ট্রাম্প ইরানকে ‘মধ্যপ্রাচ্যের দুষ্কৃতকারী’ আখ্যা দিয়ে গর্বের সঙ্গে বলেন, তার পরিচালিত হামলায় ইরানের পারমাণবিক সক্ষমতা ধ্বংস হয়েছে। ফক্স নিউজকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, “মধ্যপ্রাচ্যের দাপুটে দেশটিকে আমরা নিচে নামিয়ে এনেছি। এখন সেই দাপুটে দেশটিই হয়তো অন্য দেশগুলোর এক গঠনমূলক অংশীদারে পরিণত হবে। ”
ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাগচি এ বক্তব্যের কঠোর প্রতিক্রিয়া দেখান। তিনি বলেন, ট্রাম্প আসলে ‘একটি বড় মিথ্যাচার’ করেছেন।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ‘এক্স’-এ এক বার্তায় তিনি লিখেছেন: “ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি অস্ত্রের পর্যায়ে পৌঁছেছে বলে মার্কিন প্রেসিডেন্টের দাবি একটি বড় মিথ্যাচার এবং এর কোনও প্রমাণ নেই; এমনকি মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থাগুলোও এই ধরণের কোনও বিষয় নিশ্চিত করেনি। ”
সাইয়্যেদ আব্বাস আরাগচি
ইহুদিবাদী ইসরায়েলের প্রতারণা রোধ এবং আমেরিকার অন্তহীন যুদ্ধ বন্ধ করার জন্য ট্রাম্পের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির কথা স্মরণ করে আরাগচি আরও বলেন: “যুদ্ধবাজদের দমন করার পরিবর্তে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট এখন সেইসব যুদ্ধাপরাধীদের পাশে দাঁড়িয়ে আছেন যারা ইরানি বেসামরিক নাগরিকদের ওপর বোমা হামলা চালিয়ে নারী ও শিশুসহ এক হাজারেরও বেশি মানুষের জীবন কেড়ে নিয়েছে। ”
ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জোর দিয়ে বলেন: “ইরান শান্তিপ্রিয় জাতি ও একটি প্রাচীন সভ্যতার অধিকারী দেশ এবং ইরান ভালো উদ্দেশ্যের প্রতি ভালো উদ্দেশ্য নিয়ে সাড়া দেয়, কিন্তু তারা কখনও জুলুম-নিপীড়ন ও চাপিয়ে দেওয়া নীতির কাছে আত্মসমর্পণ করবে না। ইরানি জাতির প্রতিরোধের অভিজ্ঞতা থেকে প্রমাণিত হয়েছে যে প্রতিটি আগ্রাসী শক্তি অবশেষে তার সিদ্ধান্তের জন্য অনুতপ্ত হয়েছে। ”
শান্তির প্রেসিডেন্ট নাকি যুদ্ধের প্রেসিডেন্ট?
ইরানিদের আবারও যুক্তরাষ্ট্রের ওপর আস্থা রাখা কঠিন উল্লেখ করে আরাগচি বলেন, “যে হাত মাত্র চার মাস আগে আমাদের ঘরবাড়ি ও দপ্তরে বোমা ফেলেছে, সেই হাত থেকেই এখন জয়তুন শাখা বাড়ানো হচ্ছে—এটা কি বিশ্বাসযোগ্য? কেউ একই সঙ্গে শান্তির প্রেসিডেন্ট ও যুদ্ধের প্রেসিডেন্ট হতে পারে না। ”
আরাগচি কিছু দেশের সাথে ইসরায়েলের সম্পর্ক স্বাভাবিক করার বিষয়টিও উল্লেখ করে বলেন: “আমরা একটি বিষয়ে ট্রাম্পের সাথে একমত; ইরান কখনই ইসরায়েলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করবে না। তাই কোনও দেশ গণহত্যাকারী ইসরায়েলের সাথে মিত্রতা করার সিদ্ধান্ত নেয় তাদের অবশ্যই তার নিজস্ব জনগণের সামনে এই কর্মকাণ্ডের দায়ী থাকতে হবে। ”
দ্বিমুখী কূটনীতির মুখোশ
মার্কিন প্রেসিডেন্ট একাধিকবার ইরানের পরমাণু কর্মসূচি ধ্বংস করার দাবি করলেও বিশ্লেষকদের মতে, ইরান সম্ভবত তার পারমাণবিক সক্ষমতার বড় অংশ ধরে রাখতে পেরেছে, কারণ ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ এখনও স্পষ্ট নয়। তাছাড়া ইরানের পারমাণবিক শিল্প পুরোপুরি দেশীয় প্রযুক্তিনির্ভর হওয়ায় প্রয়োজনে তারা খুব দ্রুতই কর্মসূচি পুনরায় শুরু করতে পারবে।
গত মাসে দেওয়া এক ভিডিও বার্তায় ইসলামি বিপ্লবের নেতা আয়াতুল্লাহ সাইয়্যেদ আলি খামেনি বলেন, ইরানের অসংখ্য নিবেদিত পারমাণবিক বিজ্ঞানী ও বিশেষজ্ঞ দেশের সেবায় নিয়োজিত আছেন। তিনি স্পষ্ট করে বলেন, “বর্তমান পরিস্থিতিতে যখন যুক্তরাষ্ট্র আলোচনায় ইরানের সামরিক ও আঞ্চলিক নীতিও টানতে চায় এবং হুমকি-নিষেধাজ্ঞা চালিয়ে যাচ্ছে—তখন তেহরান ও ওয়াশিংটনের মধ্যে কোনো আলোচনা সম্ভব নয়। “
ট্রাম্পের ‘শান্তির বার্তা’র পেছনে যুক্তরাষ্ট্র এখনো ইরানের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা, আর্থিক অবরোধ ও সামরিক প্রস্তুতি বজায় রেখেছে। তেহরান এটিকে ‘দ্বিমুখী কূটনীতি’ বলে অভিহিত করেছে। ইরানিরা মনে করেন, ট্রাম্পের ‘বন্ধুত্বের হাত’ আসলে নেকড়ের দাঁতের ফাঁকে ধরা জয়তুন শাখার মতো—যা শান্তির প্রতীক হলেও দাঁতের ফাঁকে ধরা অবস্থায় তার প্রকৃত অর্থ হয়ে ওঠে ভয়, দ্বিচারিতা ও নিছক রাজনৈতিক প্রদর্শনী।
এমজেএফ