মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ‘শাটডাউন’ চলছে— এ নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। সরকারি শাটডাউন এক জটিল ও নাটকীয় ঘটনা, যা এক অর্থে একটি জাতির প্রশাসনিক অসহায়ত্বের প্রতিচ্ছবি।
সহজভাবে বললে, যুক্তরাষ্ট্রে (U.S. Government Shutdown) চলছে প্রশাসনিক অচলাবস্থা— যা দেশটির জন্য নিঃসন্দেহে এক কঠিন সময়। এই নিরস কিন্তু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি নিয়ে সংক্ষেপে আলোচনা করা যাক।
যুক্তরাষ্ট্রের অর্থবছর শুরু হয় ১ অক্টোবর। সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের কার্যক্রম চালাতে কংগ্রেসকে তহবিল বরাদ্দ করতে হয়। এবার নতুন বাজেট বা কন্টিনিউয়িং রেজলিউশন পাস হয়নি। সিনেটে প্রয়োজনীয় ৬০ ভোট পাওয়া যায়নি, ফলে সরকারি কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেছে। ইতিহাস বলছে, ২০১৮-১৯ সালের ৩৫ দিনের শাটডাউন ছিল সবচেয়ে দীর্ঘকালীন।
শাটডাউনে জরুরি সেবা ছাড়া বেশিরভাগ সরকারি দপ্তর বন্ধ থাকে। খোলা থাকে হোমল্যান্ড সিকিউরিটি, সীমান্ত নিরাপত্তা ও কিছু প্রতিরক্ষা ইউনিট। এসব দপ্তরের কর্মীরা কাজ চালিয়ে গেলেও, বেতন পাবেন পরে।
শাটডাউন কী, সংজ্ঞা ও আইনগত ভিত্তি
আমেরিকায় শাটডাউন ঘটে যখন কংগ্রেস (হাউস অব রিপ্রেজেন্টেটিভস ও সিনেট) সরকার পরিচালনার বাজেট (appropriations bills) বা অন্তত ব্যবসা চালিয়ে নেওয়ার জন্য সাময়িক বাজেট (continuing resolution-CR) পাস করতে ব্যর্থ হয়।
যুক্তরাষ্ট্রের আইন, বিশেষ করে Antideficiency Act অনুযায়ী, সরকার কোনো অনুদান (appropriation) ছাড়া খরচ করতে বা বাধ্যবাধকতা নিতে পারে না। অর্থাৎ অনুদান বিল পাস না হলে, অনুমোদনবিহীন খরচ বন্ধ করতে হয়।
তবে ‘শাটডাউন’ মানে সবকিছু বন্ধ নয়। জরুরি নয় এমন কাজ বন্ধ থাকে, আর জরুরি কাজ চলতে থাকে—যদিও এসব কর্মীরা বেতন পান না যতক্ষণ না বাজেট অনুমোদন হয়।
২০২৫ সালের শাটডাউনের প্রেক্ষাপট
▪ ২০২৫ সালের ১ অক্টোবর নতুন অর্থবছর শুরু হলেও কংগ্রেস ও প্রেসিডেন্ট কোনো বাজেট বা সাময়িক বিল (সিআর) পাস করতে পারেননি।
▪ হাউস একটি সাত সপ্তাহের সাময়িক বাজেট বিল পাস করলেও, সেটি সিনেটে আটকে যায়।
▪ ডেমোক্র্যাটরা তাদের প্রস্তাবিত স্বাস্থ্যবীমা ও সাবসিডি ইস্যুতে আপসহীন থাকে, যা বিতর্ক বাড়িয়েছে।
▪ এটি প্রায় সাত বছরের মধ্যে প্রথম বড় শাটডাউন।
কার্যকরী প্রভাব ও পরিণতি
ফেডারেল কর্মচারী ও অবকাঠামো: প্রায় ৭৫০,০০০ কর্মচারী ফার্লো (furlough) হবেন। অর্থাৎ তারা কাজ করবেন না এবং আপাতত বেতন পাবেন না।
বেতন ও ব্যাকপে: পূর্বের অভ্যাস অনুযায়ী শাটডাউন শেষে কর্মচারীরা ব্যাকপে পেতেন, তবে এবার প্রশাসন বলছে বাজেট অনুমোদন না থাকলে তা অনিশ্চিত।
জরুরি সেবা: রেল, বিমানবন্দর নিরাপত্তা, সীমান্ত সুরক্ষা, জরুরি স্বাস্থ্যসেবা চলবে, তবে কর্মীরা বেতন না পেয়ে কাজ চালাবেন। সীমান্ত এলাকায় জনবল সংকট দেখা দিতে পারে।
পার্ক ও জনউদ্যান: ন্যাশনাল পার্ক, স্মিথসোনিয়ান মিউজিয়ামসহ বহু প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে বা সীমিতভাবে চালু থাকবে।
অর্থনৈতিক প্রভাব: রাজস্ব কমে যাওয়া, সরকারি চুক্তি বিলম্ব ও প্রাইভেট খাতে অনিশ্চয়তা তৈরি হবে। ২০১৩ সালের শাটডাউনে যুক্তরাষ্ট্রের জিডিপি প্রবৃদ্ধি প্রায় ০.১-০.২ শতাংশ কমেছিল।
নাগরিক জীবনে প্রভাব: পাসপোর্ট ও ভিসা প্রক্রিয়া বিলম্ব হবে; সামাজিক সুরক্ষা ও অনুদান কর্মসূচিও প্রভাবিত হতে পারে।
বিশেষ আপডেট ও চ্যালেঞ্জ
▪ প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প নির্দেশ দিয়েছেন, অবশিষ্ট তহবিল (যেমন গবেষণা ও উন্নয়ন বাজেট) থেকে সামরিক বাহিনীর বেতন অক্টোবরের ১৫ তারিখে দেওয়া হোক।
▪ তবে এই সিদ্ধান্ত কেবল সামরিক কর্মীদের জন্য; সাধারণ ফেডারেল কর্মচারীদের বেতন এখনও অনিশ্চিত।
▪ আইআরএস (IRS) কর্মীদের প্রায় অর্ধেক ফার্লো হবে, ফলে করদাতাদের কল সেন্টার, নথি প্রক্রিয়াকরণ ইত্যাদি কাজ ব্যাহত হবে।
▪ শাটডাউন দীর্ঘায়িত হওয়ার আশঙ্কা আছে, কারণ সমঝোতার কোনো লক্ষণ নেই।
শাটডাউনের সীমাবদ্ধতা ও অনিশ্চয়তা
শাটডাউনের প্রকৃত ফলাফল সাধারণত পরে বোঝা যায়— কত কর্মচারী ক্ষতিগ্রস্ত হলেন, কত রাজস্ব হারাল— এসব হিসাব সময়সাপেক্ষ। ফলাফল নির্ভর করে রাজনীতির নমনীয়তা ও কংগ্রেস-প্রেসিডেন্টের সমঝোতার ওপর। অর্থনৈতিক ক্ষতি কিছুটা পুনরুদ্ধারযোগ্য হলেও সময় ও ব্যয়ের প্রয়োজন হয়।
২০২৫ সালের এই শাটডাউন আবারও দেখিয়ে দিল, বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী গণতন্ত্রেও রাজনৈতিক অচলাবস্থা রাষ্ট্রযন্ত্রকে থামিয়ে দিতে পারে। এটি শুধু প্রশাসনিক কাঠামোকেই নয়, সাধারণ নাগরিকের জীবন ও বৈশ্বিক অর্থনীতিকেও গভীরভাবে নাড়া দিয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের শাটডাউনের প্রভাব ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বের প্রায় সব দেশে। প্রত্যাশা করি, যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক নেতৃত্ব দ্রুত সমঝোতায় পৌঁছাবে এবং রাষ্ট্রযন্ত্রকে স্বাভাবিক করবে, কারণ শাটডাউন কারো জন্যই লাভজনক নয়।
‘আমেরিকা ফার্স্ট’ চিন্তা বা ‘গ্লোবালিজম’ যাই হোক না কেন, প্রয়োজন রাষ্ট্রকে রাজনৈতিক অচলাবস্থা থেকে রক্ষা করার দূরদৃষ্টি। ওয়াশিংটনে ‘লাল-নীল’ লড়াইয়ের মাঝে আটকে পড়া আমেরিকা যেন দ্রুত মুক্ত হয়।
মাহবুব আহমেদ: লেখক, উদ্যোক্তা ও মানবাধিকার কর্মী
এমজেএফ