এক অসম্পূর্ণ আকাঙ্ক্ষার গল্প নিয়ে আজকের লেখাটি শুরু করছি।
২০২৫ সালের নোবেল শান্তি পুরস্কার ঘোষণার পর বিশ্বজুড়ে শুরু হয়েছে তীব্র আলোচনা।
‘বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠায় সর্বাধিক অবদান রেখেছেন’ বলে দাবি করা ট্রাম্প আবারও নোবেল পুরস্কার থেকে বঞ্চিত হলেন। এই ব্যর্থতা কেবল ব্যক্তিগত নয়, বরং রাজনৈতিক, কূটনৈতিক ও বৈশ্বিক প্রতিক্রিয়ার এক গুরুত্বপূর্ণ প্রতিচ্ছবি।
নোবেল শান্তি পুরস্কারের মূল দর্শন ও প্রক্রিয়া নিয়ে কিছু আলোচনা করা যাক। নোবেল শান্তি পুরস্কার কেবল একটি সম্মান নয়, এটি বিশ্বের শান্তি, মানবাধিকার ও সহনশীলতার প্রতীক। নরওয়ের নোবেল কমিটি সাধারণত যেসব বিষয় বিবেচনায় নেয় তা হলো—
▪ আন্তর্জাতিক সংঘাতের অবসানে কার্যকর ভূমিকা।
▪ মানবাধিকারের সুরক্ষা ও গণতন্ত্র রক্ষায় অবদান।
▪ সমাজে সহিষ্ণুতা, আলোচনার পথ ও শান্তি প্রতিষ্ঠায় দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব।
এই নীতিগুলির মধ্যে ‘জনপ্রিয়তা’ বা ‘রাজনৈতিক প্রভাব’ কোনো ভূমিকা রাখে না। নোবেল পুরস্কার প্রাপকের কাজ হতে হয় বাস্তব, স্থায়ী ও বৈশ্বিকভাবে গ্রহণযোগ্য।
ট্রাম্পের নোবেল আকাঙ্ক্ষা ও স্বঘোষিত সাফল্য নিয়ে সরাসরি যে কথাটা বলা যায়, তা হচ্ছে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প কখনোই নোবেল পাওয়ার ইচ্ছা লুকাননি। বরং তিনি প্রকাশ্যেই বারবার বলেছেন, “আমি যেসব শান্তিচুক্তি করেছি, তার জন্য অন্য যে কেউ হলে অনেক আগেই নোবেল পেত।
ডোনাল্ড ট্রাম্পের দাবি করা প্রধান সাফল্যগুলো হলো—
▪ আব্রাহাম চুক্তি (Abraham Accords): ইসরায়েল ও একাধিক আরব দেশের মধ্যে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণ।
▪ উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে কূটনৈতিক সংলাপ: কিম জং-উনের সঙ্গে বৈঠক, যা সরাসরি সংঘাত ঠেকাতে সাহায্য করে।
▪ আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহার চুক্তি: তালেবানের সঙ্গে সমঝোতা করে মার্কিন সেনা প্রত্যাহার।
ট্রাম্প ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সংঘাত অবসানের কৃতিত্ব দাবি করেছেন। কিন্তু নয়াদিল্লি এই ঘটনায় ট্রাম্পের ভূমিকাকে তেমন গুরুত্ব দেয়নি।
অন্যান্য বিষয় পূর্ণাঙ্গ সংঘাতের চেয়ে উত্তেজনার পরিস্থিতির সঙ্গেই বেশি সম্পর্কিত ছিল। যেমন: গ্র্যান্ড ইথিওপিয়ান রেনেসাঁ ড্যাম নিয়ে মিসর ও ইথিওপিয়ার মধ্যে উত্তেজনা। এই ইস্যুতে ট্রাম্প কোনো সুস্পষ্ট সাফল্য পাননি।
ডোনাল্ড ট্রাম্প তাঁর প্রথম মেয়াদে সার্বিয়া ও কসোভোর মধ্যে উত্তেজনা কমাতে বড় একটি চুক্তি করার কৃতিত্বও দাবি করেছেন। যদিও সেই চুক্তির অনেক শর্তই কখনো কার্যকর হয়নি।
এই সাফল্যগুলো নিঃসন্দেহে আলোচিত, কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে— এগুলো কি ‘শান্তি প্রতিষ্ঠার স্থায়ী নজির’ নাকি ‘রাজনৈতিক কৌশল’?
কেন নোবেল পেলেন না ট্রাম্প: বিশ্লেষক ও মিডিয়ার দৃষ্টিতে এটা নিয়ে কিছুটা আলোকপাত করা যেতে পারে। বিশ্লেষক ও মিডিয়া প্রতিবেদনে দেখা যায়, ট্রাম্পের নোবেল না পাওয়ার পেছনে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ রয়েছে— অনেক শান্তিচুক্তিই কাগজে সীমাবদ্ধ থেকেছে। আব্রাহাম চুক্তি ছাড়াও বেশ কিছু উদ্যোগ দীর্ঘস্থায়ী শান্তি আনতে ব্যর্থ হয়েছে। উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে সম্পর্কও আবার উত্তপ্ত হয়েছে। The Guardian মন্তব্য করেছে— “শান্তি কেবল বৈঠক বা ছবি তোলার মাধ্যমে আসে না। এটি আসে স্থায়ী প্রভাবের মাধ্যমে, যা ট্রাম্পের কর্মকাণ্ডে অনুপস্থিত। ”
ট্রাম্প প্রশাসনের সময় শরণার্থী নীতি, মুসলিম নিষেধাজ্ঞা, সীমান্তে শিশু বিচ্ছিন্নকরণ ইত্যাদি পদক্ষেপ কমিটির চোখে তার অবস্থান দুর্বল করেছে। Le Monde লিখেছে— “শান্তির পুরস্কার এমন নেতার হাতে যায় না, যিনি একই সাথে বিভাজন ও বিরোধের প্রতীক। ”অতিরিক্ত প্রচারণা ও লবিং লক্ষ্য করা যায়। নোবেল কমিটি সবসময় গোপনীয়তা ও বিনয়ের মূল্য দেয়। ট্রাম্প নিজে ও তার সমর্থকেরা যেভাবে প্রকাশ্যে নোবেল দাবি করেছেন, তা কমিটির কাছে নেতিবাচক বার্তা পাঠিয়েছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষক জেফরি স্টাফলো বলেন— “যখন কেউ পুরস্কার পাওয়ার জন্য এতটা জোর করে দাবি করে, তখন তা শান্তির চেয়ে আত্মপ্রচারের মতো মনে হয়। ” ট্রাম্পের মানবাধিকার ও নৈতিক মূল্যবোধে ঘাটতি রয়েছে বলে ধারণা করা হয়। নোবেল কমিটি প্রায়ই এমন নেতাকে পুরস্কৃত করে, যিনি মানবাধিকারের পক্ষে অবস্থান নেন।
আন্তর্জাতিক অস্থিরতায় ভূমিকা প্রসঙ্গে দেখা যায়, ইরান পরমাণু চুক্তি থেকে বেরিয়ে যাওয়া, জলবায়ু চুক্তি প্রত্যাহার, ন্যাটো নিয়ে বিতর্ক— এসব সিদ্ধান্ত বিশ্ব শান্তিকে অস্থিতিশীল করেছে। নোবেল কমিটি কখনো এমন সিদ্ধান্তকে পুরস্কৃত করে না, যা বৈশ্বিক উত্তেজনা বাড়ায়।
এবার জনমত ও সামাজিক মাধ্যমে প্রতিক্রিয়া এবং রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া থেকে অনুধাবন হয়, Washington Post – Ipsos এর একটি জরিপে দেখা গেছে, ৭৬% মার্কিন নাগরিক মনে করেন ট্রাম্প নোবেল শান্তি পুরস্কারের যোগ্য নন।
ট্রাম্প সমর্থকরা একে ‘রাজনৈতিক পক্ষপাত’ বলছেন। সমালোচকরা বলছেন, ‘নোবেল শান্তির পুরস্কার শান্তিকামী নেতার জন্য, নিজেকে প্রচারকারী নেতার জন্য নয়’। হ্যাশট্যাগ #IWantMyNobel ট্রেন্ড ট্রাম্পের নোবেল আকাঙ্ক্ষাকে ব্যঙ্গ করে এবং মিডিয়ার প্রতিক্রিয়া থেকে প্রতীয়মান হয় যে,
▪ The Guardian: ‘ট্রাম্পের নোবেল না পাওয়া দেখায়, পুরস্কার জনপ্রিয়তার নয়, নীতির’।
▪ Le Monde: ‘ট্রাম্পের প্রচারণা তার জন্য উল্টো ফল বয়ে এনেছে’। ”
▪ Axios: ‘এটি শুধু একটি পুরস্কার হারানো নয়— এটি বৈশ্বিক বার্তা যে শক্তি নয়, ন্যায় ও নীতি শান্তির পথ’।
আজকের লেখাটি বিশালকায় করা সম্ভব, তবে ছোট পরিসরে যা বলা যায়— ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা: ট্রাম্প কি কখনও নোবেল পাবেন?
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, ভবিষ্যতে ট্রাম্প নোবেল পেতে পারেন, তবে শর্ত হলো—
▪ তিনি যদি দীর্ঘস্থায়ী আন্তর্জাতিক শান্তি প্রতিষ্ঠার নেতৃত্ব দিতে পারেন।
▪ তার নীতি যদি মানবাধিকারের পক্ষে দাঁড়ায়।
▪ আত্মপ্রচার নয়, প্রকৃত কূটনৈতিক সমাধান তার কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রে আসে।
The Washington Post লিখেছে— “নোবেল কেবল অর্জনের পুরস্কার নয়, এটি নৈতিক নেতৃত্বের স্বীকৃতি। ট্রাম্পের সামনে সেই পথ এখনো খোলা আছে, কিন্তু কঠিন। ”সর্বশেষ একটি বার্তা, একটি শিক্ষা ডোনাল্ড ট্রাম্পের নোবেল না পাওয়া কেবল একটি ব্যর্থতা নয়, বরং একটি রাজনৈতিক শিক্ষা।
এটি দেখিয়ে দেয় যে ক্ষমতা, প্রভাব বা প্রচারণা নয়— বরং মানবিক মূল্যবোধ, নৈতিক সাহস এবং স্থায়ী শান্তির কাজই বিশ্বের সর্বোচ্চ সম্মান অর্জনের পথ। নোবেল কমিটির এই সিদ্ধান্ত বৈশ্বিক নেতৃত্বকে স্মরণ করিয়ে দেয়: শান্তি কোনো স্লোগান নয়।
শান্তি কোনো ছবি তোলা মুহূর্ত নয়। শান্তি একটি দীর্ঘমেয়াদি সংগ্রাম এবং সেই সংগ্রামে আত্মপ্রচার নয়, মানবতা জয়ী হয়। ট্রাম্প হয়তো নোবেল পাননি, কিন্তু তার এই ব্যর্থতা বিশ্ব রাজনীতিকে এক গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের সামনে দাঁড় করিয়েছে— “শক্তি ও জনপ্রিয়তা কি শান্তির বিকল্প হতে পারে?” উত্তর এখনো আগের মতোই স্পষ্ট: না।
এসব কিছুর পরও ট্রাম্পকে পুরস্কারের জন্য নির্বাচিত না করায় হোয়াইট হাউসের মুখপাত্র স্টিভেন চেউং এক্সের (সাবেক টুইটার) এক পোস্টে নোবেল কমিটির সমালোচনা করেছেন।
চেউং লিখেছেন, ‘নোবেল কমিটি প্রমাণ করেছে, তারা শান্তির চেয়ে রাজনীতিকে বেশি গুরুত্ব দেয়’।
চেউং এক্সে আরেক পোস্টে লিখেছেন, “(প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের) মানবিক হৃদয় রয়েছে। তাঁর মতো আর কেউ কখনো আসবেন না, যিনি শুধু তাঁর ইচ্ছাশক্তি দিয়ে পাহাড়ও টলিয়ে দিতে পারেন। ”
শান্তি পুরস্কার জয় নিয়ে ট্রাম্পের প্রকাশ্যে আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করার বিষয়ে সাংবাদিকেরা প্রশ্ন করলে নোবেল কমিটির চেয়ারম্যান ইয়োর্গেন ভাটনে ফ্রিডনেস বলেন, তাঁরা শুধু ‘আলফ্রেড নোবেলের কাজ ও ইচ্ছার’ ওপর ভিত্তি করে সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন।
তবে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নোবেল না পাওয়ার কারণে আমি ব্যক্তিগতভাবে কষ্ট পেয়েছি। কারণ মানুষটি এত সরাসরি তার ইচ্ছার কথা বলছেন যে, আমার ধারণা প্রতিটি আমেরিকান তার এই অপ্রাপ্তিতে আনন্দিত হওয়ার কোনো কারণ খুঁজে পাবেন না। তবে আমার ধারণা সামনে তিনি অবশ্যই নোবেল পুরস্কার বিজয়ী হবেন। এবং আমাদের প্রেসিডেন্ট তার আকাঙ্ক্ষা পূরণ করবেন, যা নোবেল কমিটির প্রত্যাশার চেয়েও অনেক বেশি।
মাহবুব আহমেদ, লেখক, উদ্যোক্তা ও মানবাধিকার কর্মী
এমজেএফ