সম্প্রতি গণমাধ্যমে দেশের প্রথম সারির একটি বেসরকারি ব্যাংকের যে চিত্র তুলে ধরা হয়েছে, তা খুব একটা সুখকর নয়। সেই সংবাদে যেসব বিষয়ের উল্লেখ আছে তার মধ্যে সবচেয়ে উদ্বেগজনক তথ্য হচ্ছে—(১) মাত্র ৯ মাসের মধ্যে প্রদত্ত ঋণের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে দুই হাজার ৯০০ কোটি টাকা, (২) ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়ে ৮৫ শতাংশে দাঁড়িয়েছে, (৩) ঋণ-আমানত অনুপাত বৃদ্ধি পেয়ে ১০১ শতাংশ হয়েছে, (৪) ব্যাংকের এমডি ও চেয়ারম্যানের মধ্যকার বিরোধ চরমে এবং (৫) চাপ সহ্য করতে না পেরে এমডির পদত্যাগের সিদ্ধান্ত।
প্রথমত, একটি ব্যাংকের এমডি চেয়ারম্যান বা মালিকপক্ষের অন্যায় চাপ সহ্য করতে না পেরে অন্য ব্যাংকে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, সেটি কি নিছকই তাঁর পেশাদারির পরিচয়, না নিজের ব্যর্থতা ঢাকার চেষ্টা।
কেননা সেই ব্যাংকে চেয়ারম্যান বা মালিকপক্ষের যে অন্যায় চাপ, তা তো নতুন কিছু নয়। সবাই জানে যে মালিকপক্ষের এমন আচরণের কারণেই একসময়ের সুপ্রতিষ্ঠিত একটি ব্যাংক আজ রুগ্ণ হওয়ার উপক্রম। বিষয়টি একজন এমডি জানবেন না, তা হতে পারে না। তাহলে জেনেশুনে তিনি কেন এই ব্যাংকের এমডি পদের দায়িত্ব নিয়েছিলেন।
দ্বিতীয়ত, গত ৯ মাসে দুই হাজার ৯০০ কোটি টাকার ঋণ বৃদ্ধি পেয়েছে। যদি ঋণের সুদ যোগ এবং কিছু ঋণ আদায়ের বিষয় বিবেচনায় নেওয়া হয়, তার পরও প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকার মতো নতুন ঋণ বিতরণ করা হয়েছে বর্তমান এমডির মেয়াদকালে। তিনি যদি সত্যি পেশাদারির পরিচয় দিতেন, তাহলে তো প্রথম ঋণ বিতরণের সময়ই পদত্যাগ করতে পারতেন।
দেশের ব্যাংকিং খাতের সংকট চরমেএদিকে প্রকাশিত সংবাদের প্রতিবেদকের এক প্রশ্নের উত্তরে সেই ব্যাংকের ক্ষমতাধর মালিক এবং অলিখিত চেয়ারম্যান সবকিছু অস্বীকার করে বলেছেন যে দেশ থেকে ১২ হাজার কিলোমিটার দূরে থেকে তিনি কিভাবে ব্যাংক নিয়ন্ত্রণ করবেন।
প্রযুক্তিনির্ভর বিশ্বে ১২ হাজার কেন, ১২ লাখ কিলোমিটার দূরে থেকেও যে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করা যায় এবং করা হচ্ছে, সে কথা এখন সবাই জানে। সেই মালিকপক্ষের পরিবার যে শুরু থেকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এই ব্যাংক নিয়ন্ত্রণ করে আসছে, সে কথাও সবার জানা। এই যে ব্যাংকের চেয়ারম্যান বা মালিকপক্ষ এবং এমডি বা সিনিয়র ম্যানেজমেন্টের মধ্যকার দ্বন্দ্ব, এটি কমবেশি অনেক ব্যাংকেরই প্রধান সমস্যা। আর এই সমস্যাই আমাদের দেশের ব্যাংকিং খাতের অন্য সব সমস্যার মূল।
এই বিষয়গুলো যে শুধু একটি ব্যাংকের চিত্র তা নয়, বরং হাতে গোনা দু-একটি ব্যাংক বাদ দিলে বাকি সব ব্যাংকের হালহকিকত প্রায় একই রকম।
দেশের ব্যাংকিং খাতের সমস্যা দীর্ঘদিনের। এই সমস্যা নিয়ে প্রতিনিয়ত আলোচনা হচ্ছে। এই খাতের সমস্যা দূর করে এটিকে যে একটি মানসম্পন্ন অবস্থায় উন্নীত করতে হবে, সে ব্যাপারেও অনেকে কথা বলেছেন। আমি নিজে এসব বিষয় নিয়ে অনেক লিখেছি। এমনকি বর্তমান অর্থ উপদেষ্টা এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের বর্তমান গভর্নর এসব বিষয় নিয়ে অনেক বলেছেন। তার পরও এই খাতের সমস্যা দূর করার ক্ষেত্রে দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ নেই। নামমাত্র কিছু ব্যবস্থা গ্রহণের কথা অবশ্য আমরা অনেক দিন ধরে শুনে আসছি; যেমন—ব্যাংক একীভূত করা, নতুন ঋণ প্রদানের ওপর নিষেধাজ্ঞা, কয়েকটি ব্যাংকের সম্পদের মান নিরূপণ প্রভৃতি। কিন্তু এ রকম খণ্ডিত বা বিচ্ছিন্ন কিছু পদক্ষেপ নিয়ে দেশের ব্যাংকিং খাতের মূল সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়।
একদিকে খণ্ডিত এবং বিচ্ছিন্ন কিছু পদক্ষেপ নেওয়ার কারণে মূল সমস্যার সমাধান তো হচ্ছেই না, উল্টো সময়ক্ষেপণ হচ্ছে; অন্যদিকে দেশের ব্যাংকিং খাত খারাপ হতে হতে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে চলে এসেছে। দেশের ইতিহাসে এই প্রথম কয়েকটি ব্যাংক আমানতকারীর অর্থ ফেরত দিতে পারেনি, যা দেশের ব্যাংকিং খাতের জন্য মারাত্মক হুমকি। অনেকগুলো ব্যাংকের ৭০ থেকে ৮৫ শতাংশ ঋণ খেলাপি হয়ে গেছে। অবস্থা এমন যে খুব শিগগির এসব ব্যাংকের শতভাগ ঋণই খেলাপি হয়ে যাবে। এ রকম অবস্থায় ব্যাংকগুলো টিকে থাকতে পারবে কি না, সেটিই এখন বড় প্রশ্ন। পরিস্থিতি এমন বিপর্যয়ের দিকে চলে যেতে পারে, তখন অনেক সহযোগিতা করেও সেসব ব্যাংক রক্ষা করা যাবে না। কোনো রকম উপায়ান্তর না পেয়ে যদি বাধ্য হয়ে এ রকম কিছু ব্যাংক বন্ধ করতে হয়, তাহলে দেশের অর্থনীতি এবং সমাজে এক বিপর্যয় নেমে আসবে।
আমাদের দেশ কিন্তু আমেরিকা, ইউরোপ বা উন্নয়নশীল বিশ্বের অনেক দেশের মতো নয়। এখানে ব্যাংক বন্ধের পরিণতি হবে ভয়াবহ। যদি কোনো কারণে কিছু ব্যাংক বন্ধ হয়, তাহলে প্রথম ক্ষতিগ্রস্ত হবেন দেশের ক্ষুদ্র আমানতকারীরা, যাঁরা জীবনের শেষ সম্বল হারিয়ে একেবারে পথ বসবেন। দ্বিতীয়ত, দেশের ব্যবসায়ীরাও ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। ব্যবসায়ীদের মধ্যে যাঁরা কিছু অর্থ সঞ্চয় করে ব্যাংকে জমা রেখেছেন ভবিষ্যতে বিনিয়োগের উদ্দেশ্যে, তাঁদের সেই অর্থ খোয়া যাবে। ব্যবসায়ীরা যদি ব্যাংক থেকে ঋণ মঞ্জুর করে রাখেন সুযোগমতো কাজে লাগানোর জন্য, সেই ঋণের সুযোগও হাতছাড়া হয়ে যাবে। তদুপরি ব্যবসায়ীদের নতুন ঋণ পাওয়ার সুযোগও সীমিত হয়ে যাবে। সর্বোপরি অসংখ্য ব্যাংকার বেকার হয়ে যাবেন এবং সেই সঙ্গে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টির সুযোগও কমে যাবে। সব মিলিয়ে মারাত্মক এক সামাজিক অস্থিরতা তৈরি হবে। সবচেয়ে বড় ক্ষতি হবে দেশের ব্যাংক ও আর্থিক খাতের, যেখান থেকে মানুষের আস্থা অনেক কমে যাবে। মানুষ ব্যাংকে টাকা রাখার কথা একেবারে ভুলে যাবে এবং শত চেষ্টা করেও তাদের ব্যাংকমুখী করা যাবে না।
ব্যাংকিং নিয়ে আলোচনার সময় যত সমস্যার কথা বলা হয়, তত সমাধানের পথ দেখানো হয় না। সৃষ্টিলগ্ন থেকেই এই খাতে সমস্যা লেগে আছে এবং ক্রমান্বয়ে পুঞ্জীভূত হয়ে আজ এই পর্যায়ে এসেছে। এখন ক্রমাগত সমস্যার কথা বলে কোনো লাভ হবে না। কোনো একটি জায়গা থেকে এই খাতের সমস্যা দূর করার কাজে হাত দিতে হবে। একবার শুরু করতে পারলেই এক পর্যায়ে লক্ষ্যে পৌঁছা যাবে। যদি শুরুই করতে না পারি, তাহলে তো সমস্যা আরো জটিল হতে থাকবে এবং এক পর্যায়ে দেশের ব্যাংকিং খাতই দেউলিয়া হয়ে যাবে। এমনকি ব্যাংকিং খাতের চেইন ইমপ্যাক্টের কারণে যে কয়েকটি ব্যাংক ভালো চলছে বলে মনে করা হয়, সেগুলোও তখন একই পরিণতি বরণ করতে বাধ্য হবে, যা খুঁড়িয়ে চলা এই খাতকে একেবারেই ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেবে। এ কারণেই কোনো রকম বিলম্ব না করে অতি দ্রুত দেশের ব্যাংকিং খাতের সমস্যা দূর করে এই খাতকে ঘুরে দাঁড়ানোর পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন।
কিছু ব্যাংক একীভূত করে বা কয়েকটি ব্যাংক বন্ধ করে এই সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। এমনকি বিদেশি পরামর্শকের উপদেশ নিয়েও এই সমস্যার সন্তোষজনক সমাধান হবে না। তবে এর অর্থ এই নয় যে আমাদের দেশের ব্যাংকিং খাতের সমস্যার সমাধান নেই। অবশ্যই আছে, তবে আমাদের সমস্যা আমাদের মতো করে সমাধানের চেষ্টা করতে হবে। এ জন্য প্রয়োজন ব্যাপকভিত্তিক এক কর্মপরিকল্পনা, যার মধ্যে থাকবে—(১) তাত্ক্ষণিক ও স্বল্পমেয়াদি পদক্ষেপ, (২) মধ্যমেয়াদি পদক্ষেপ এবং (৩) দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ। বিভিন্ন মেয়াদের এসব পদক্ষেপের অধীনে কী ধরনের কার্যক্রম গ্রহণ এবং কিভাবে তার বাস্তবায়ন হতে পারে, তা ব্যাখ্যা করতে গেলে বিস্তারিত আলোচনা প্রয়োজন, যার সুযোগ এখানে নেই। কিন্তু বিষয়গুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং সংশ্লিষ্ট সব মহলের জানা প্রয়োজন। তাই বিষয়গুলো পরবর্তী সময়ে বিস্তারিতভাবে আলোচনার ইচ্ছা আছে।
লেখক: সার্টিফায়েড অ্যান্টি মানি লন্ডারিং স্পেশালিস্ট ও ব্যাংকার, টরন্টো, কানাডা