ঢাকা, শুক্রবার, ২৮ ভাদ্র ১৪৩২, ১২ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১৯ রবিউল আউয়াল ১৪৪৭

জাতীয়

নৌপথে মানবপাচার: ফাঁদে পড়লে ফেরার সুযোগ নেই

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮:২০, মে ১৭, ২০১৯
নৌপথে মানবপাচার: ফাঁদে পড়লে ফেরার সুযোগ নেই সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য রাখছেন র‌্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার মুফতি মাহমুদ খান। ছবি: বাংলানিউজ

ঢাকা: সম্প্রতি লিবিয়া থেকে ইতালি যাওয়ার পথে ভূমধ্যসাগরে অভিবাসীবাহী একটি নৌকা ডুবে অন্তত ৩৯ জন বাংলাদেশি নিখোঁজ হয়েছেন। জীবিত উদ্ধার হয়েছেন ১৪ জন। এ ঘটনার পর আবারও আলোচনায় আসে বাংলাদেশ থেকে নৌপথে মানবপাচারের বিষয়টি।

ঘটনার তদন্তে নেমে ইউরোপে মানবপাচারের সঙ্গে দেশজুড়ে অন্তত ১০ থেকে ১৫টি চক্রের তথ্য পেয়েছে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব)। এর মধ্যে ৫ থেকে ৬টি চক্রের মাধ্যমে পাচার হওয়া বাংলাদেশিরা সেদিন নৌ-দুর্ঘটনায় পতিত হন।

দেশজুড়ে চক্রের সদস্যরা ইউরোপে যাওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে প্রথমে লোক সংগ্রহ করে। তারপর সেসব লোকদের সড়ক-বিমানপথ মিলিয়ে তিনটি রুটে লিবিয়ায় পাঠায়। সর্বশেষ লিবিয়া থেকে নৌপথে তিউনিসিয়ার উপকূল হয়ে ইউরোপে পাঠায়। ৭ থেকে ৮ লাখ টাকার অর্থের বিনিময়ে পুরো প্রক্রিয়া শেষ করতে সময় লাগে দুই মাস থেকে এক বছর পর্যন্ত।

বৃহস্পতিবার (১৬ মে) রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে দুইটি পাচারকারী চক্রের তিন সদস্যকে আটক করে র‌্যাব-১। র‌্যাবের হাতে আটক পাচারকারী চক্রের ৩ সদস্য। ছবি: বাংলানিউজআটককৃতরা হলেন- আক্কাস মাতুব্বর (৩৯), এনামুল হক তালুকদার (৪৬) ও আব্দুর রাজ্জাক ভূঁইয়া (৩৪)।

শুক্রবার (১৭ মে) দুপুরে রাজধানীর কারওয়ানবাজারে র‌্যাবের মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান র‌্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার মুফতি মাহমুদ খান।

তিনি বলেন, গত ৯ মে অবৈধভাবে ইতালি যাওয়ার পথে ভূমধ্যসাগরের নৌকা ডুবিতে প্রায় ৮৫ থেকে ৯০ জন নিখোঁজ হয়েছেন। এদের মধ্যে বাংলাদেশি ছিলেন ৩৯ জন। এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ভিকটিমের স্বজনরা শরীয়তপুরের নড়িয়া ও সিলেটের বিশ্বনাথ থানায় দুইটি মামলা দায়ের করেন।

ওই মামলার ছায়াতদন্তের পরিপ্রেক্ষিতে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে দুইটি চক্রের তিনজনকে আটক করা হয়। তারা মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে বিদেশে কর্মসংস্থানের প্রলোভন দেখিয়ে দীর্ঘদিন ধরে এই কর্মকাণ্ড চালিয়ে আসছিল। তারা প্রথমে বিদেশে গমনেচ্ছুক নির্বাচন করে, এরপরের ধাপে বাংলাদেশ থেকে লিবিয়া এবং সর্বশেষ ধাপে লিবিয়া থেকে তাদেরকে নৌপথে ইউরোপে পাঠানো হয়।

ভিকটিমদের পাসপোর্ট তৈরি, ভিসা সংগ্রহ, টিকিট ক্রয় এই সিন্ডিকেটের তত্ত্বাবধানে সম্পন্ন হয়। ইউরোপে পৌঁছে দিতে তারা ৭-৮ লাখ টাকা অর্থ নির্ধারণ করে, এর মধ্যে সাড়ে চার থেকে পাঁচ লাখ টাকা লিবিয়ায় পৌঁছানোর আগে এবং বাকি টাকা লিবিয়া থেকে ইউরোপে যাত্রার আগে পরিশোধ করতে হয়। পুরো প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে দুই মাস থেকে এক বছর পর্যন্ত সময় লাগে। এর মধ্যে অধিকাংশ টাকা পরিশোধ হয়ে যায়, ফলে ইচ্ছা থাকলেও আর ফেরত আসতে পারেন না ভুক্তভোগীরা।

সাম্প্রতিক সময়ে ইউরোপে পাচারে তিনটি রুট ব্যবহৃত হয় জানিয়ে মুফতি মাহমুদ খান বলেন, রুটগুলো, বাংলাদেশ- তুরস্কের ইস্তাম্বুল-লিবিয়া, বাংলাদেশ-ভারত-শ্রীলংকা (৪-৫ দিন অবস্থান)- ইস্তাম্বুল (ট্রানজিট)- লিবিয়া এবং বাংলাদেশ-দুবাই (৭-৮ দিন অবস্থান) -আম্মান (জর্ডান) (ট্রানজিট) - বেনগাজী (লিবিয়া) - ত্রিপলী (লিবিয়া)। এক্ষেত্রে তারা সড়ক ও বিমানপথ ব্যবহার করে লিবিয়া পৌঁছাতো। সর্বশেষ লিবিয়া থেকে নৌপথে তিউনিসিয়ার উপকূল হয়ে ইউরোপে পাচার করে থাকে।

ভিকটিমরা ত্রিপলীতে পৌঁছানোর পর ত্রিপলীতে অবস্থানরত বাংলাদেশি কথিত ‘গুডলাক ভাই’সহ আরও কয়েকজন এজেন্ট তাদের গ্রহণ করে থাকে। তাদেরকে ত্রিপলীতে বেশ কয়েকদিন অবস্থান করানো হয়। এ সময়ে ভিকটিমদের স্বজনদের কাছ থেকে অর্থ আদায় করে থাকে।

সেখানকার সিন্ডিকেট সমুদ্রপথে অতিক্রম করার জন্য নৌযান চালনা এবং দিক নির্ণয় যন্ত্র পরিচালনাসহ আনুষাঙ্গিক বিষয়ের উপর নানাবিধ প্রশিক্ষণ দেয়। একটি নির্দিষ্ট দিনে ভোর-রাতে একসঙ্গে কয়েকটি নৌযান লিবিয়া হয়ে তিউনিসিয়া উপকূলীয় চ্যানেলের হয়ে ইউরোপের পথে রওনা দেয়। এভাবে ঝুঁকিপূর্ণ পথে গমনকালে ভিকটিমরা ভূমধ্যসাগরে প্রায়ই দুর্ঘটনার শিকার হয়।

গত ৯ মে ভূমধ্যসাগরের নৌকা ডুবির ঘটনায় নিখোঁজ বাংলাদেশিরা সিলেট, মাদারীপুর, শরীয়তপুর, কিশোরগঞ্জ ও নোয়াখালীর বাসিন্দা বলে জানা গেছে। তারা ৫ থেকে ৬টি চক্রের মাধ্যমে ইউরোপে যাচ্ছিলেন।

আটক তিন সদস্যের চক্রের মাধ্যমে কতজন সেখানে গিয়েছিলেন বিষয়টি এখনও নিশ্চিত নয়। তাদেরকে রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করলে বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া যাবে। এছাড়া দেশজুড়ে ১০ থেকে ১৫টি চক্রের খবর আমরা পেয়েছি। তাদেরকে আইনের আওতায় আনতে আমাদের চেষ্টা অব্যাহত আছে।

বাংলাদেশ সময়: ১৪১৬ ঘণ্টা, মে ১৭, ২০১৯
পিএম/এএটি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।