‘বৈসাবি’। ত্রিপুরাদের ‘বৈসু’ মারমাদের ‘সাংগ্রাই’ আর চাকমাদের ‘বিজু’।
অরণ্যঘেরা জনপদের প্রত্যন্ত পল্লীর ঘরে ঘরে চলছে ‘বৈসাবি’ উৎসব আনন্দের প্রস্তুতি। দরিদ্র, হতদরিদ্র ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্টীর এসব পরিবারগুলো জীবিকার সকল অবলম্বনের প্রাণান্তকর শেষ চেষ্টাটুকু করে যাচ্ছে উৎসব উদযাপনের জন্য। জেলায় সরকারি বেসরকারি উদ্যোগে প্রতিবছর বর্ণিল আয়োজনে এই উৎসব উদযাপিত হলেও তৃণমূল জনগোষ্ঠির উৎসব আনন্দের নান্দনিকতায় থাকে ভিন্ন মাত্রা।
দরিদ্রের ঘরেও ছোট্ট আয়োজনে পরম আনন্দে প্রতিবছর এই উৎসব উদযাপিত হয়ে থাকে। যেখানে বর্ণিলতার ছাপ থাকে না, শহুরে আনন্দের ঢাক-ঢোল বাজে না। সেসকল দরিদ্রপল্লীতে বৈসাবি আনন্দ যেন এক গুচ্ছ পাহাড়ি ফুলের আনন্দশোভাযাত্রা। মনের উচ্ছাসে স্বপ্নে তুষ্ট হয়েই উৎসব উদযাপন করে থাকে পোড়খাওয়া চেহারার এই মানুষগুলো।
উৎসবের বায়না মেটাতে বাবার হাত ধরে ছোট্ট মনিরা আসছে হাটবাজারে। আর দরিদ্র শিশুদের বায়নার আনন্দ যেন অভাবের সংসারে গুমড়ে কাঁদছে। এদিকে প্রতিবছর উৎসবকে ঘিরে সরকারের বিশেষ বরাদ্দ থাকলেও সরকারি অনুদান পৌছে না এসকল তৃণমূল দরিদ্র পরিবারগুলোর কাছে। জেলা-উপজেলায় সরকারি অর্থে নামমাত্র শোভাযাত্রা, মেলা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়ে থাকে। প্রতিবছর পাহাড়ে ধনী-দরিদ্রের এমন বৈষম্যের মাঝেই এই বৈসাবি উদযাপন হয়ে থাকে। নিয়ে আসে আনন্দের বারতা।
বৈসু- ত্রিপুরা সম্প্রদায় তিনদিনব্যাপী এই বৈসু উৎসব করে থাকে। প্রথম দিন হারি বৈসু, দ্বিতীয় দিন বৈসু এবং শেষ দিন বিছিকাতাল। হারি বৈসুতে ত্রিপুরা তরুণ তরুণীরা বনজঙ্গল থেকে ফুল সংগ্রহ করে। বাড়িঘর পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে সেই ফুলের শোভায় ভরিয়ে তোলে ঘরের দরজা-জানালা। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করা এবং সাজানো থেকে বাদ পড়ে না গৃহপালিত পশু পাখিও। দ্বিতীয় দিন বৈসুতে সকালে ছোটরা বড়দের প্রণাম করে আশির্বাদ নেয়। তারপর চলে অতিথি আপ্যায়ন। তৃতীয় দিন অর্থ্যাৎ ১৫ এপ্রিল ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের দিনপঞ্জি অনুযায়ী নতুন বছর। ঐদিন ছোটরা বড়দের গোসল করিয়ে বস্ত্র দান কর এবং মন্দিরে মন্দিরে পূজা দিয়ে থাকে।
সাংগ্রাই- মারমা সম্প্রদায়ের এই সাংগ্রাই উৎসব চলে ৪ দিন ধরে। প্রথম দিন সাংগ্রাই, আক্যে, আতাদা এবং আতং। এই ৪ দিনই বিভিন্ন ঐতিহ্যবাহী খেলাধুলা, অতিথি আপ্যায়ন,বিশেষ পাচঁন রান্নাসহ বিভিন্ন কিছু দিয়ে চলে উৎসব উদযাপন।
বিজু-চাকমা জাতিগোষ্ঠি ৩ দিন ধরে এই বিজু উৎসব উদযাপন করে থাকে। ফুল বিজু, মূল বিজু, এবং গজ্জাপজ্জা। বিজুর দিন সকালে চাকমা তরুণ তরুণীরা বনজঙ্গল থেকে ফুল এনে সবার মঙ্গল কামনায় নদীতে ভাসিয়ে দেয়। সাজিয়ে তোলে ঘরবাড়ি, প্রিয় গৃহকোণ। বাকি দুইদিন বিভিন্ন সামাজিক আনুষ্ঠানিকতায় উদযাপন করা হয় বিজু উৎসব।
খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান কংজরী চৌধুরী বলেন, উৎসব ঘিরে আমরা র্যালী, বিভিন্ন প্রতিযোগিতা, গুণীজন সংবর্ধনার আয়োজন করেছি। আমরা চাই এই উৎসব ঘিরে সবাই আনন্দে মেতে উঠুক, সবার সৌহার্দ্যপূর্ণ সহাবস্থান নিশ্চিত হোক।
এদিকে বৈসাবি উৎসব ঘিরে নিরাপত্তা জোরদার করেছে পুলিশ প্রশাসন। গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলোতে থাকছে বিশেষ নিরাপত্তা।
খাগড়াছড়ির পুলিশ সুপার আলী আহম্মেদ খান জানান, শহরের গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলোতে ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা বসানো হয়েছে। পর্যটকদের কথা মাথায় রেখে হোটেল-মোটেলে বিশেষ নজরদারি থাকবে। আশা করি উৎসবমুখর পরিবেশে বৈসাবি ও বাংলানববর্ষ উদযাপিত হবে।
এদিকে পাহাড়ে বাংলা নববর্ষ এবং বৈসাবি উৎসব উপলক্ষে জেলা প্রশাসন, ক্ষুদ্র নৃ জনগোষ্ঠির সাংস্কৃতিক ইনিস্টিটিউট, মারমা উন্নয়ন সংসদ ও মারমা যুব কল্যাণ সংসদের পক্ষ থেকেও ব্যাপক প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়েছে।
বাংলাদেশ সময়: ০৬১৩ ঘণ্টা, এপ্রিল ১০, ২০১৮
এডি/জেএম