ঢাকা, শুক্রবার, ১৩ ভাদ্র ১৪৩২, ২৯ আগস্ট ২০২৫, ০৫ রবিউল আউয়াল ১৪৪৭

জাতীয়

‘আফ্রিদির কথায় যম টুপি পরিয়ে ডিবি অফিসে অমানবিক নির্যাতন’

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২২:১৪, আগস্ট ২৮, ২০২৫
‘আফ্রিদির কথায় যম টুপি পরিয়ে ডিবি অফিসে অমানবিক নির্যাতন’ গ্রেপ্তারের পর রিমান্ডের জন্য আদালতে নেওয়া হয় তৌহিদ আফ্রিদিকে

ঢাকা: বিতর্কিত কন্টেন্ট ক্রিয়েটর তৌহিদ আফ্রিদির সঙ্গে ভাতের হোটেলের হারুনের যে অবৈধ লেনদেনের হট কানেকশন ছিল এবং হারুনের প্রশ্রয়ে সে যে বেপরোয়া হয়ে উঠেছিল, বিষয়টি এখন ওপেন সিক্রেট। হারুনের ভয় দেখিয়ে সে রাতের বেলা হেন অপরাধ নেই যা করতো না।

আর দিনের বেলায় সাজতো কন্টেন্ট ক্রিয়েটর।  

আলোচিত মুনিয়া হত্যায় অভিযোগের তীর এখন অপরাধ জগতের ব্যাডবয় তৌহিদ আফ্রিদির দিকে। ফাঁস হওয়া একাধিক ফোনালাপ থেকে জানা যাচ্ছে, মুনিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক ছিল অফ্রিদির। বিভিন্ন সময় মুনিয়ার বাসায় গিয়ে তিনি সময় কাটাতেন। তাদের ঘনিষ্ঠতা কেবল ব্যক্তিগত সম্পর্কেই সীমাবদ্ধ ছিল না— ফলে মুনিয়ার মৃত্যুর রহস্য এখন নতুন দিকে মোড় নিয়েছে।  

সম্প্রতি এক ভুক্তভোগী নারী অভিযোগ করেছেন, দীর্ঘদিন শারীরিক সম্পর্ক করার পর অফ্রিদি তাকে ছুঁড়ে ফেলে দেয়। পরে তাকে ডিবি অফিসে ডেকে গায়েব করে দেওয়ার হুমকি দেওয়া হয়। অফ্রিদিও তাকে হুমকি দিয়ে বলেন, মুনিয়ার যে অবস্থা হয়েছে, তারও সেই অবস্থা হবে।  

‘ক্রাইম এডিশন’ প্রকাশিত একটি ভিডিও প্রতিবেদনে ওই নারী কথা বলেছেন। প্রতিবেদনে উঠে এসেছে— ইউটিউবার ও ব্লগারদের আওয়ামী লীগের পক্ষে জোরপূর্বক কাজ করানো থেকে শুরু করে আফ্রিদির নানা কুকীর্তির বিস্তারিত। তবে সবচেয়ে আলোচিত বিষয় মুনিয়ার সঙ্গে তার সম্পর্ক।  

ওই নারী বলেন, ‘আমি জানতে পারি, বিভিন্ন মেয়ের সঙ্গে তার (আফ্রিদি) সম্পর্ক আছে। মুনিয়া নামের একটা মেয়ের সঙ্গেও তার সম্পর্ক ছিল। এগুলো জেনে ওর সঙ্গে আমি একটু রাগারাগি করি। এটা স্বাভাবিক, আমার একটু খারাপ লাগতেই পারে। আমি যেহেতু ওকে ভালোবেসে ফেলেছি। তো, ওকে আমি বলার পরে খুব বাজেভাবে রিঅ্যাক্ট নেয়। এক সময় এরকমও বলে, মুনিয়ার যেরকম অবস্থা হয়েছে, আমারও ঠিক সেরকম অবস্থা হবে। মানে, ইনডিরেক্টলি ও আমাকে হত্যার হুমকিই দেয়।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, জুলাই আন্দোলন চলাকালে তৌহিদ আফ্রিদি দেশের কনটেন্ট ক্রিয়েটরদের হুমকি দিয়ে সরকারের পক্ষে কাজে লাগানোর চেষ্টা চালিয়েছেন। তাছাড়া আফ্রিদির বিরুদ্ধে বেশ কয়েকজন নারীকে বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে শারীরিক সম্পর্ক করার অভিযোগও উঠেছে।

আফ্রিদির বাবা নাসিরুদ্দিন সাথী একটি টিভি চ্যানেল দখল করে মালিক বনে গেছেন তাকে ব্যবহার করেই। হাসিনার মন্ত্রী আনিসুল হক আর আসাদুজ্জামান কামালরা কীভাবে বাপ-ছেলেকে অপরাধের ফুয়েল দিয়েছে তাও এখন আর অজানা নয়। আফ্রিদি নিয়মিত তাদের কাছে নারী সরবরাহ করতেন।  

সুন্দরী তরুণী-নারীদের বিভিন্নভাবে ব্ল্যাক মেইল করে কব্জায় নিয়ে আনিসুল-কামাল-হারুনদের কাছে পাঠাতেন আফ্রিদি। জনপ্রিয় কন্টেন্ট ক্রিয়েটরদের বাধ্য করতে হাসিনা সরকারের পক্ষে কন্টেন্ট বানাতে। কেউ তার অবাধ্য হলে ডিবিতে নিয়ে যেতেন, আর সেখানে হারুনের নির্দেশে চলতো অমানবিক নির্যাতন।

এমনই এক লোমহর্ষক নির্যাতনের বর্ণনা দেন জনপ্রিয় কন্টেন্ট ক্রিয়েটর সায়েম। নিজ চ্যানেলে এ নিয়ে একাধিক ভিডিও আপলোড করেন। যেখানে উঠে আসে আড়াই বছর আগের ডিবি কার্যালয়ে তার ওপর চালানো নির্যাতনের ঘটনা।  

সায়েম বলেন, তৌহিদ আফ্রিদিকে নিয়ে আমি একটি ভিডিও বানাই। এটা ছিল সামান্য একটা ভিডিও। যেই ভিডিওতে তৌহিদ আফ্রিদি তার একটি ভ্লগে তার মায়ের শরীরের ওপরে উঠে বসে বসে লাফাচ্ছিল। সেটা নেগেটিভলি ছড়ানো হয়েছিল অনলাইনে। আমি সেটা বললাম, একটা সন্তানের সাথে মা দুষ্টামি করতেই পারে। এই ভিডিওটা আমি পজিটিভলি প্রেজেন্ট করেছি। কিন্তু যেহেতু ভিডিওটা ভাইরাল হয়ে গিয়েছিল, তাই সেটা তার কাছে খারাপ লেগেছে। আর সেটাকে কেন্দ্র করে আমাকে ডিবি অফিসে নিয়ে নির্মমভাবে নির্যাতন করা হয়।  

নির্যাতনের বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, ডিবি অফিসে ঢুকেই দেখি একজন পুলিশ কর্মকর্তা তৌহিদ আফ্রিদির সঙ্গে ভিডিও কলে কথা বলছেন। তখন সে ক্যামেরাটা আমার দিকে ঘুরাইয়া বলতেছে, এইটা কি সেই মালটা না? তৌহিদ আফ্রিদি শুধু কনফার্ম করছে 'হ্যাঁ’। সাথে সাথে দুজন এসে আমার হাত পেছনে নিয়ে হ্যান্ডকাফ পরায় এবং মাথায় একটি কালো টুপি পরায়। যেই টুপি আসামিকে ফাঁসির মঞ্চে পরানো হয় (যম টুপি)। সাথে সাথে আমি অনেক আতঙ্কে পড়ে যাই। আর কিছু জিজ্ঞাসাবাদের আগেই আমাকে তারা মারধর শুরু করে। পেছনে একই জায়গায় প্রায় ১৫ থেকে ২০টা বারি মারে। আপনারা দেখেছেন আমার পেছনে নীল হয়ে গিয়েছিল, আমি চেয়ারে বসতে পারিনি অনেকদিন।  

সায়েম আরও বলেন, সবচেয়ে বড় কথা হলো, আমার নামে কোনো অভিযোগ নাই, কোনো জিডি নাই, কোনো মামলা নাই। একজন পুলিশ তো কোনো মামলাহীন অবস্থায় আমার ওপর হাত তুলতে পারে না।  তাও সেটা আবার ডিবি অফিসে আমাকে ডেকে নেওয়া হয়েছে। সেখানে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আমাকে নিয়ে নির্যাতন করা হয়েছে। সেখানে তৌহিদ আফ্রিদির টিমের সদস্যরাও ছিল। তারা সেটা দেখেছে এবং ভিডিও কলে তৌহিদিকে সরাসরি দেখানো হয়েছে। একপর্যায়ে তারা আমার গোপনাঙ্গে কারেন্টের শক পর্যন্ত দিতে চেয়েছে। আমার চোখে পিস্তল দিয়ে আঘাত করা হয়েছে।

তিনি বলেন, ডিবি অফিসের মতো জায়গায় শুধু ওর একটা ফোন কলে আমাকে এভাবে পেটায়! তাই শেখ হাসিনাকে যেমন বাঙালি ভয় পায়, তার চেয়েও বেশি ভয় আমি তৌহিদ আফ্রিদিকে পাই। একটা গাঁজাখোর, ভেন্ডিখোর, রাস্তার মধ্যে থাকে, তার চেয়ে অনেক সুন্দর।

প্রসঙ্গত, গত ২৪ আগস্ট সন্ধ্যায় বরিশাল থেকে প্রতারক-ব্ল্যাকমেইলার তৌহিদ আফ্রিদিকে গ্রেপ্তার করেছে সিআইডির একটি টিম। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে রাজধানীর যাত্রাবাড়ী থানার আসাদুল হক বাবু হত্যা মামলায় তাকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। পুলিশ তাকে পাঁচ দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছে। জিজ্ঞাসাবাদে তার কাছ থেকে পুলিশ নানা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেয়েছে বলে জানা গেছে। তার তিনটি ডিভাইস জব্দ করা হয়েছে। সেগুলোতে রাষ্ট্রবিরোধী ভয়ঙ্কর সব তথ্য আছে বলে প্রাথমিক আলামত পাওয়া গেছে।  

এর আগে একই মামলায় তার বাবা মাই টিভির চেয়ারম্যান নাসির উদ্দিন সাথীকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।  

কেআই 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।