সে সময় তারা হামলাও চালায়। এ হামলায় এলাকার ৫ জন নিরপরাধ মানুষ গুরুতর আহত হয়েছেন।
ওই ঘটনায় রীতিমত হতবাক খোদ দলিলদাতা রামকৃষ্ণ কৈবর্ত দাস। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমি কখনো আনসার বাহিনীকে জমি দখলের এক্তিয়ার দিইনি। টাকার লোভ দেখিয়ে তারা আমার কাছ থেকে একটি দলিল (আমমোক্তার নামা) রেজিস্ট্রি করে নেয়। কিন্তু এর মাধ্যমে তো আর জমির মালিকানা-স্বত্ব প্রমাণ হয় না! তাছাড়া ওই দলিল রেজিস্ট্রির পর আমি পুরনো একটি দলিল থেকে জানতে পারি আমার বাবা জমিটি অনেক আগেই বিক্রি করে দিয়েছেন। বাবার বিক্রি করে দেওয়া জমির আরেকটি পাওয়ার অব অ্যাটর্নি দিয়ে আমি ভুল করেছি। ’
এ প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, ‘আমরা গরিব মানুষ। মাছ ধরে বাজারে বিক্রি করে কোনোমতে সংসার চালাই। তাই আনসার সদস্যদের কোটি টাকার লোভ সামলাতে পারিনি। তাই না বুঝে অনেক আগে বিক্রি করে দেওয়া জমি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য আনসারকে একটি দলিল করে দিয়েছি। এখন দেখছি সে দলিল নিয়ে তারা অন্যের জমি দখল করার চেষ্টা করছে। এলাকাবাসীর উপর গুলিবর্ষণ করছে। এ কারণে আমি সে দলিলটি প্রত্যাহার করে প্রায়শ্চিত্ত করতে চাই। ’
রামকৃষ্ণ দাসের ছেলে বিপ্লব চন্দ্র দাস বলেন, ‘বাবা অনেক বয়স্ক মানুষ। জমিজমা নিয়ে আমাদের কিছু ঝামেলা ছিল একথা ঠিক। কিন্তু অনেক আগে আমার দাদার বিক্রি করে দেওয়া জমি আনসার বাহিনীকে রক্ষণাবেক্ষণ করার দায়িত্ব দেওয়া ঠিক হয়নি। কেননা ওই জমির মালিক তো আমরা নই। তাহলে বাবার দেওয়া দলিলটি ভুয়া। এমন একটি ভুয়া দলিল সৃষ্টির জন্য আমরা এলাকাবাসীর কাছে ক্ষমাপ্রার্থী। ভুয়া দাতার দলিল নিয়ে আনসারের মত একটি রাষ্ট্রীয় সংস্থার সদস্যরা কীভাবে সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালায় সেটাই বুঝে উঠতে পারছি না। ’
জাল দাতার রেজিস্ট্রিকৃত দলিলে এক নম্বর সাক্ষী হয়েছেন ভরতচন্দ্র দাস। তিনি রামকৃষ্ণ দাসের ভাই। এ প্রসঙ্গে তার বক্তব্য, ‘জমির মালিক সম্পর্কে আমি কোনো তথ্যই জানি না। আমার ভাই যে ওই জমির মালিক সেটাও আমার জানা নেই। আমরা জানি এসব জমি অনেক আগেই বাবা-চাচারা বিক্রি করে দিয়েছেন। আমি শুধু আনসার সদস্যদের কথামতো দলিলে সাক্ষী হয়েছি। গরীব মানুষ আমরা। সে হিসাবে বড় অংকের টাকা পাওয়ার লোভে সেটা করে ফেলেছি। এখন বুঝতে পারছি এ সাক্ষী হওয়া ছিল আমার জন্য বড় ভুল। ’
কৈবর্ত দাস পরিবারের একাধিক সদস্য জানান, মূলত আনসার সদস্যদের প্ররোচনায়ই তারা ভুয়া দাতা সেজে একটি দলিল রেজিস্ট্রি করে দিয়েছেন। একাজে তাদেরকে সহযোগিতা করেছেন আনসার কমান্ডার ফরিদ, রায়হান, কামরুজ্জামান প্রমুখ। তারাই আমাদের ফুসলিয়ে এ অন্যায় কাজ করতে বাধ্য করেছেন। তাদের সহযোগী হিসাবে ছিলেন গুলশান সাব-রেজিস্ট্রি অফিসের দলিল লেখক (সনদ নম্বর-৮০) নজরুল ইসলাম ও রহমান ভেন্ডার।
তারা আরো জানান, কোটি কোটি টাকার লোভ দেখিয়ে ভুয়া দাতার কাছ থেকে দলিল রেজিস্ট্রি করে নিলেও তাদেরকে কোনো টাকা পয়সা দেয়নি আনসার সদস্যরা। যে দিন দলিল রেজিস্ট্রি করা হয় সেদিন দুপুর বেলায় খাওয়ার দাওয়ার জন্য রামকৃষ্ণ দাসের হাতে এক হাজার টাকার একটি নোট ধরিয়ে দেওয়া হয়। দলিল রেজিস্ট্রি কার্যক্রম শেষ হওয়ার পর তাদেরকে না বলেই আনসার সদস্যরা সেখান থেকে চলে যায়। এতে তাদের মনে সন্দেহ দানা বাঁধে, জমিজমা নিয়ে হয়তো তারা বড় ধরনের কোন ঘটনা ঘটনার জন্য এটা করেছেন।
আনসারের সাবেক এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘কতিপয় আনসার সদস্য নিজেদের স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য জমি দখলের মত ন্যক্কারজনক ঘটনাটি ঘটিয়েছে। জমি দখল কিংবা সন্ত্রাসীদের মত কার্যকলাপ চালানো তাদের মানায় না। ভাটারার ঘটনার পর সাধারণ মানুষের কাছে পুরো আনসার বাহিনীর ভাবমূর্তি প্রশ্নের মুখে পড়েছে। যারা এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত অচিরেই তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার। তা না হলে মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদান রাখা এ বাহিনী দেশবাসীর কাছে বিশ্বাসযোগ্যতা হারাবে। ’
স্থানীয় সূত্র জানায়, এক সময় বেশ কয়েকটি কৈবর্ত পরিবার ভাটারা এলাকায় বসবাস করতো। তারা মাছ শিকার করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। ধীরে ধীরে এলাকায় নগরায়ণ শুরু হলে জমিজমার দাম অনেক বেড়ে যায়। এ কারনে তারা সেসব জমি বিক্রি করে অন্যত্র বসবাস শুরু করেন। এজন্যই পাকিস্তান আমলের আরএস এবং বাংলাদেশ আমলের সিটি জরিপে সেসব জমির রেকর্ড হয় পরবর্তী মালিকদের নামে।
ভাটারার স্থায়ী বাসিন্দা আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘সিএস ও এসএ রেকর্ডীয় মালিক থাকা অবস্থায় হিন্দু সম্প্রদায় ভাটারার এসব জমি বিক্রি শুরু করেন। এখানে তাদের প্রায় ২৫/৩০ বিঘা জমি ছিল। বিক্রি করতে করতে অনেকে ওয়ারিশান সম্পত্তি চেয়েও বেশি সম্পত্তি বিক্রি করে ফেলেন। একারণে তা নিয়ে অনেক মামলা-মোকদ্দমা হয়। রামকৃষ্ণ দাসের বাবা যোগেশ চন্দ্র দাস তার পাওনার চেয়ে বেশি জমি বিক্রি করে দেন। এ কারণে পরবর্তী সময়ে তাকে একটি ক্ষতি-নিস্পত্তি দলিল করে সে সমস্যার সমাধান করে দিতে হয়। এরপর তার ছেলে রামকৃষ্ণ কিভাবে আরো জমি আনসারের নামে রেজিস্ট্রি করে দেয়, সেটাই আমরা ভেবে পাই না। ’
স্থানীয় একাধিক ব্যক্তি জানান, দীর্ঘদিন ধরে জমি ভোগ দখলে থাকার পর প্রকৃত মালিকদের নামে আরএস ও সিএস রেকর্ড হয়েছে। এতো দিন সেসব জমির মালিকানা নিয়ে কোনো বিরোধ দেখা দেয়নি। হঠাৎ করেই রামকৃষ্ণ দাসের একটি সাধারণ পাওয়ার অব অ্যাটর্নি নিয়ে আনসার সদস্যরা এলাকায় সন্ত্রাসী কার্যকলাপ শুরু করে। অথচ আনসার সদস্যদের উচিত ছিল রেকর্ড সংশোধনের পর দলিল রেজিস্ট্রি করা। অন্যের রেকর্ডকৃত ভোগদখলে থাকা জমি একটি সরকারি বাহিনীর দখল করতে আসা শুধু বেআইনিই নয়, লজ্জাজনক একটি ঘটনা।
সরেজমিনে ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে বর্তমানে আনসারের কোনো সদস্য নেই। পড়ে আছে কেবল তাদের ব্যবহৃত দু’টি তাঁবু।
কৈবর্ত দাস পরিবারের কাছ থেকে ক্রয়সূত্রে সে জমির মালিক আজিজুর রহমান জানান, ১৬০১ ও ১৬০২ দাগের জমিগুলো আমাদের দখলে রয়েছে। হঠাৎ করে সেগুলো আনসার দখল নিতে আসে। এ যেন মগের মুল্লুক! এলাকাবাসী প্রতিরোধের মুখে তারা সেখান থেকে চলে যেতে বাধ্য হন।
বাংলাদেশ সময়: ০০০১ ঘণ্টা, এপ্রিল ১০, ২০১৮
জেএম