ঢাকা, শুক্রবার, ৩ শ্রাবণ ১৪৩২, ১৮ জুলাই ২০২৫, ২২ মহররম ১৪৪৭

জাতীয়

জুলাই গণঅভ্যুত্থান

মুগ্ধের পথ ধরেই জয়: যেখানে মরণে এক হয়েছেন দুই শহীদ

ইফফাত শরীফ, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮:৩৪, জুলাই ১৮, ২০২৫
মুগ্ধের পথ ধরেই জয়: যেখানে মরণে এক হয়েছেন দুই শহীদ জুলাই গণঅভ্যুত্থানে রাজপথে ছিলেন জয়

বাইরের পৃথিবীর তুলনায় রাজধানীর উত্তরার কামারপাড়া (বামনারটেক) কবরস্থানের ভেতরটা বেশ নীরব। হঠাৎ হঠাৎ দূর থেকে ভেসে আসে গাড়ির হর্ন কিংবা কিছু মানুষের মৃদু কোলাহল।

বর্ষার ছোঁয়া পেয়ে কবরস্থানের অনেক জায়গায় সজীব ও সবুজ হয়ে উঠেছে ঘাস। কোথাও আবার ঘাসের বালাই নেই; ন্যাড়া লালচে মাটি দেখে বোঝাই যাচ্ছে তুলনামূলক নতুন কবর।

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) অন্তর্ভুক্ত উত্তরা মডেল টাউনের ১০ নম্বর সেক্টরের পাশে অবস্থিত কামারপাড়া কবরস্থানে মূলত এলাকার ভোটার বা বাসিন্দাদের সমাহিত করা হয়। তবে ব্যতিক্রম ঘটেছে একবার। ৪৬ বছরের পুরোনো কবরস্থানে শুয়ে আছেন জুলাই গণঅভ্যুত্থানের শহীদ মীর মাহফুজুর রহমান মুগ্ধ, যিনি এই মহল্লার বাসিন্দা নন। কোটা সংস্কার আন্দোলনে গত বছরের ১৮ জুলাই শহীদ হন তিনি। মুগ্ধ খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিতে স্নাতক হন ২০২৩ সালে এবং শেষে বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসের ব্যবসায় প্রশাসন বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি (এমবিএ) করছিলেন। সেই মুগ্ধ যিনি হাসিমুখে আন্দোলনকারী ও সহযোদ্ধাদের পানি পান করাতেন। জয়ের কবরের সামনে কবরস্থানের কর্মী

গত ১১ জুলাই মুগ্ধর সমাধি দেখতে যাই কামারপাড়া কবরস্থানে, ততক্ষণে দুপুর গড়িয়ে বিকেল। নতুন-পুরনো কবরের ভিড়ে মুগ্ধকে আলাদা করে খুঁজে পেতে কষ্ট হয়নি। কিছুদিন আগেই সাদা মার্বেল পাথরে বাঁধানো হয়েছে মুগ্ধর কবর। কবরস্থানের প্রবেশপথ দিয়ে ঢুকে কিছুটা হেঁটে মুগ্ধর সমাধির সামনে গিয়ে দাঁড়াই। বিকেলের শেষ আলো এসে পড়েছে এপিটাফের সাদা পাথরে। কবরের বুকে ঝাড়ের মতো বেড়ে উঠেছে গাঁদা ফুল গাছ।

বর্ষার বিকেলে ফুটে থাকা হলুদ গাঁদা ফুল ভালোভাবে দেখতে গিয়েই কিছুটা চমকে যাই। এখানে আসলে একসঙ্গে দুটি কবর, লম্বালম্বি অবস্থায়। দুটো কবর বাঁধানোও একসঙ্গে। বাড়ন্ত গাঁদা ফুলের গাছ যেন দুটো কবরকে এক করে রেখেছে। সেই গাঁদা ফুলের পথ ধরে লম্বালম্বি কবরের আরেক অংশে যেতেই দেখা মেলে আরেকটি এপিটাফ। সেখানে লেখা, শহীদ রিদোয়ান শরীফ রিয়াদ (জয়), জুলাই অভ্যুত্থানের সক্রিয় যোদ্ধা। একটু খবর নিতেই বেরিয়ে এলো এক অন্য গল্প; ‘মুগ্ধর পথ ধরেই জয়, মৃত্যু দুই শহীদের মধ্যে তৈরি করেছে এক পবিত্র যোগসূত্র’।

মুগ্ধর পথ ধরে জয়; যেভাবে পাশাপাশি সমাহিত হলেন দুই শহীদ
গত বছর ১৮ জুলাই কোটা সংস্কার আন্দোলনের উত্তাল সময়ে শহীদ হন মুগ্ধ। নানা জটিলতায় মুগ্ধকে কামারপাড়া কবরস্থানে সমাহিত করা হয় পরদিন ১৯ জুলাই (শুক্রবার) দুপুরে। অন্যদিকে ২০ বছর বয়সী রিদোয়ান শরীফ রিয়াদ (জয়) কামারপাড়ারই বাসিন্দা, টঙ্গী সরকারি কলেজের ইংরেজি বিভাগের প্রথম বর্ষের ছাত্র। মুগ্ধকে কামারপাড়া কবরস্থানে কবর দেওয়া হবে জানতে পেরে জয় ও তার বন্ধুরাও জুমার নামাজের পর গিয়েছিলেন সেখানে। এখানে ঘুমিয়ে আছেন জয়

মুগ্ধকে দাফন করার পর বিকেলেই বন্ধুদের সঙ্গে জয় যুক্ত হয়েছিলেন গণআন্দোলনে। সেখানে আন্দোলনকারীদের প্রাথমিক চিকিৎসা দিচ্ছিলেন তারা। মায়ের সঙ্গে তখনো তার যোগাযোগ হচ্ছিল। শেষবার যখন কথা হয়, ঘড়িতে তখন বিকাল ৫টা বেজে ৩২ মিনিট। আর তারপরের পাঁচ মিনিট, মাত্র পাঁচ মিনিট... বিকাল ৫টা ৩৭ মিনিটে জয়কে মাথায় গুলি করে হত্যা করে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের তাবেদাররা।

এ ঘটনার পরপরই বন্ধুরা একজন রিকশাচালককে তার মোবাইল থেকে জয়ের পরিবারকে খবর দেয়। বন্ধুদের পরামর্শে সেই রিকশাচালক জানান, জয় আহত হয়েছে, তারা যেন দ্রুত জয়ের জন্য হাসপাতালে আসে। কিন্তু হাসপাতালে নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই চিকিৎসকরা জানান, জয় ঘটনাস্থলেই শহীদ হয়েছেন।

সেদিন সন্ধ্যার পর শহীদ মুগ্ধর পাশেই চিরনিদ্রায় শায়িত করা হয় শহীদ রিদোয়ান শরীফ রিয়াদ জয়কে। কে জানত, সেদিন বিকেলে যে কবরের পাশে দাঁড়িয়ে ছিল জয়, সে রাতে সেখানেই নিজের চিরস্থায়ী ঠিকানা হবে তার। পাশাপাশি কবরে চিরনিদ্রায় শায়িত এই দুই তরুণের জীবনের শেষ অধ্যায়টি মনে করিয়ে দেয় কতটা তীব্র ও আবেগঘন ছিল জুলাই গণঅভ্যুত্থান।

‘স্বাধীনভাবে কাঁদতেও পারিনি’
জয়ের মৃত্যুর খবর যখন প্রথম আসে সেই শোকাবহ মুহূর্তের কথা স্মরণ করে জয়ের বড় বোন শাহানাজ আহমেদ শিমু বাংলানিউজকে বলেন, ‘পরিবারের সবাই তখন কান্নায় ভেঙে পড়েছিল। কিন্তু হাসপাতাল থেকে জানানো হলো, কান্নাকাটি করা যাবে না। কারণ, পুলিশ ব্লক রেইড দিচ্ছে, লাশ নিতে দেবে না। স্বাধীনভাবে কাঁদতেও পারিনি আমরা। ’

এমনকি, জানাজার পরও জয়ের লাশ নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছিল আওয়ামী তাবেদাররা। কিন্তু এলাকাবাসীর কারণে তা সম্ভব হয়নি বলে জানান শিমু। সেদিন সন্ধ্যার পরই শহীদ মুগ্ধর পাশেই চিরনিদ্রায় শায়িত করা হয় শহীদ রিদোয়ান শরীফ রিয়াদ জয়কে।

জয়ের অনুপস্থিতি পরিবারের সদস্যদের জীবনে কী প্রভাব ফেলেছে, এমন প্রশ্নে কিছুটা আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন শিমু। তিনি বলেন, ‘ছোট ভাইয়ের সঙ্গে বড় বোনের যে সম্পর্ক থাকে, আমাদের সম্পর্কটা তার চেয়েও গভীর ছিল। জয় যে নেই, তা আমার অনেক সময় বিশ্বাস হয় না। মাঝে মাঝে মনে হয় জয় হয়তো আবার আমাদের মাঝে ফিরে আসবে। ’

ছোট ভাইয়ের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে শিমু বলেন, ‘জয় অনেক শান্ত ও ম্যাচিওর (পরিণত) স্বভাবের ছিল। আমি বড় বোন হিসেবে কোনো কিছু জেদ করে সহজেই পেয়ে যেতাম, কিন্তু জয়ের ক্ষেত্রে বিষয়টি ছিল উল্টো। সে কখনোই কোনো বিষয় নিয়ে জেদ করত না, তাকে বোঝালে সে সহজে বুঝে যেত। কখনো কোনো কাজে না করতো না। ’

গোরখোদকের স্মৃতিতে দুই শহীদের দাফন
দীর্ঘ ছয় বছর ধরে এই কবরস্থানে কাজ করা গোরখোদক মো. হানিফ সেদিন মুগ্ধ ও জয়ের দাফনের পুরো প্রক্রিয়ার সাক্ষী ছিলেন। হানিফ ও আরেক গোরখোদক মো. আমির হোসেন; দুজন মিলে জয়ের কবর খুঁড়েছিলেন। হানিফ তার স্মৃতি থেকে জানান সেদিনের ঘটনাপ্রবাহ। হানিফ জানান, কোনো এক শুক্রবারের দুপুরে মুগ্ধকে কামারপাড়া কবরস্থানে সমাহিত করা হবে এমন খবর পাওয়ার পর তারা কবর খোঁড়া শুরু করেন। মাটি শক্ত হওয়ায় কবর খুঁড়তে প্রায় আড়াই থেকে তিন ঘণ্টা সময় লেগেছিল।

অন্যদিকে জয়ের দাফন সম্পর্কে হানিফ জানান, জয়ের কবর মুগ্ধর সঙ্গেই হয়েছিল, তবে রাতের বেলায়। জানাজার পর আনুমানিক ৩টা থেকে সাড়ে ৩টার মধ্যে মুগ্ধকে দাফন করা হয়, এরপর জয়কে রাত ১২টার দিকে দাফন করা হয়। জয়ের কবর খোড়েন এ দুজন

হানিফ নিশ্চিত করেন, মুগ্ধর জানাজা ও দাফনের সময় জয় উপস্থিত ছিলেন। কিন্তু ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস, সেদিন রাতেই মুগ্ধর পাশেই কবরস্থ হতে হয় জয়কে। দাফনের সময় কোনো ধরনের বাধা বা সমস্যার সম্মুখীন হওয়া কিংবা লুকোচুরি করে কবর দেওয়ার কোনো ঘটনাও ঘটেনি বলে হানিফ উল্লেখ করেন।

অন্যদিকে মুগ্ধর দাফন সম্পর্কে হানিফ জানান, দাফনের সময় মুগ্ধর চেহারা দেখার সুযোগ হয়নি। কারণ তাকে কাফন দিয়ে ঢেকে আনা হয়েছিল। সাধারণত, দাফনের আগে মৃতদেহ পরিবারের সদস্যদের পক্ষ থেকে বাড়িতেই দেখানো হয়, কবরস্থানে নয়। মুগ্ধকে সাধারণ কাফনের কাপড়েই দাফন করা হয়েছিল, কোনো বিশেষ প্যাকেট করা অবস্থায় নয়। দাফনের দিন আবহাওয়া ভালো ছিল এবং কোনো বৃষ্টি ছিল না বলেও জানান দুই গোরখোদক।

এই কবরস্থানে এলাকার বাইরের লোকদের দাফন করা হয় কিনা, এমন প্রশ্নের উত্তরে হানিফ বলেন, না, এলাকার বাইরের কাউরে এহানে দাফন করা হয় না। এই কবরস্থানে কাউরে দাফন করতে হইলে তারে এই এলাকার ভোটার হইতে হয়।

মুগ্ধ ও জয় এই এলাকার ভোটার ছিলেন কিনা জানতে চাইলে হানিফ জানান, জয় এই এলাকার ভোটার ছিলেন। তবে মুগ্ধ এই মহল্লার ছিলেন না। মুগ্ধকে উত্তরা নিজ এলাকায় কবর দিতে বাধা দেওয়ায় এবং কোথাও কবর দিতে না পারায় শেষ পর্যন্ত এই এলাকায় কবরস্থ করতে হয়েছিল।

মুগ্ধর এপিটাফে সদা হাস্যোজ্জ্বল মুখ, শেষ কিটটি দিতে পারেননি জয়
কামারপাড়া কবরস্থানে বর্তমানে দুজন ব্যক্তির কবর পাকা করা— একজন শহীদ স্কাউটার মীর মাহফুজুর রহমান মুগ্ধ, অন্যজন শহীদ রিদোয়ান শরীফ রিয়াদ (জয়)। এই কবরস্থানে আওয়ামী লীগের স্থানীয় এক নেতার একটি পুরোনো পাকা কবর ছিল, যা ৫ আগস্টের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর ভেঙে ফেলা হয় বলে জানান গোরখোদক মো. হানিফ। মুগ্ধ ও জয়ের কবর বাংলাদেশ স্কাউটের পক্ষ থেকে গত জুন মাসেই পাকা করা হয় বলে জানান তিনি।

মুগ্ধর সমাধিফলকে লেখা রয়েছে, ‘সেবার মহিমায় সদা হাস্যোজ্জ্বল মুগ্ধ, পানি লাগবে পানি— এই ছিল তাঁর জীবনের শেষ কথা, জুলাই ২০২৪ অভ্যুত্থানের সক্রিয় যোদ্ধা, আহত আন্দোলনকারীদের উদ্ধারের পর পানি পান করাতে গিয়ে শহীদ হন। ’

অন্যদিকে জয়ের সমাধিফলকে লেখা, ‘জুলাই ২০২৪ অভ্যুত্থানের সক্রিয় যোদ্ধা, আন্দোলনে আহতদের ফার্স্ট এইড কিট দিয়ে সহায়তা করতে গিয়ে শহীদ হন, সবগুলো দিয়ে শেষ একটি ব্যাগ ওর হাতে ছিল যা আর দিতে পারেনি। ’

বছর ঘুরে শীত এসেছিল রুক্ষতা নিয়ে, বৃক্ষরাজি হয়েছিল পত্রহীন। বর্ষার ছোঁয়ায় প্রকৃতির সেই ধূসর ক্যানভাসে এখন সবুজের প্রাণবন্ত মেলা। নববর্ষার বারিধারায় সজীবতা ফিরে পেয়েছে তরুলতা, প্রতিটি পাতায় যেন নতুন জীবনের স্পন্দন। গত বর্ষায় ঠিক এমন পরিবর্তনের জন্যই প্রাণ দিয়েছিলেন দুই শহীদ।

এবার এই পরিবর্তনের মাঝেই এক গভীর শ্রদ্ধায় সেজে উঠেছে শহীদ মুগ্ধ ও শহীদ জয়ের সমাধি। ধুয়ে-মুছে, পরিপাটি করে পাকা করা সমাধি যেন নতুন করে জানান দিচ্ছে তাঁদের আত্মত্যাগের মহিমা। পনেরো বছরের স্বৈরাচারের শেকল ভেঙেছে দেশ। প্রকৃতি ও ইতিহাসের এই যুগলবন্দী যেন এক নতুন যাত্রার ইঙ্গিত দিচ্ছে, যেখানে পুরনো জীর্ণতা মুছে গিয়ে নতুন সম্ভাবনা ডানা মেলছে।

ইএসএস/এমজে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।