ঢাকা, শুক্রবার, ১ কার্তিক ১৪৩২, ১৭ অক্টোবর ২০২৫, ২৪ রবিউস সানি ১৪৪৭

সারাদেশ

চলনবিলে ‘শাহী কাশ্মীরি’ রুটি

মো. মামুনুর রশীদ, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০:৪৯, অক্টোবর ১৭, ২০২৫
চলনবিলে ‘শাহী কাশ্মীরি’ রুটি শাহী কাশ্মীরি রুটি

নাটোর: গ্রামগঞ্জের হাট-বাজারে ঢুকলেই নাকে ভেসে আসে এক অনন্য ঘ্রাণ। চুলার আগুনে পোড়ানো সোনালি রঙের বিশাল আকারের রুটি, যা চলনবিলের মানুষের শ্রম, ভালোবাসা আর ঐতিহ্যের প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠেছে।

 

এ রুটি কেবল একটি খাবার নয়, বরং অতিথি আপ্যায়নের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে আছে চলনবিলের মানুষের কাছে। শত বছরের বয়ে চলা ইতিহাসের এ রুটির নাম শাহী কাশ্মীরি রুটি। তবে স্থানীয়ভাবে এ রুটি পরিচিত কেজি রুটি নামে।

এ রুটি তৈরি করতে উপকরণ হিসেবে শুধুমাত্র প্রয়োজন হয় ময়দা, ইস্ট, স্যাকারিন, লবণ আর পানি। এসবের সংমিশ্রণে আটা থেকে ডো প্রস্তুত হয়ে গেলে হাতে বিভিন্ন আকারের ডো তৈরি করার পর দেওয়া হয় বিভিন্ন আকৃতি, কোনোটা বড় গোল, কোনোটা লম্বা। তার ওপরে আবার ধারালো কিছু দিয়ে নকশা আঁকা। এরপর সেগুলো তন্দুরিতে (এক ধরনের চুলা) ছেঁকা হয়। ব্যাস তৈরি হয়ে গেল সোনালি রঙের রুটি। যা শুধু স্বাদেই নয়, বরং স্থানীয়ভাবে খুবই জনপ্রিয়। এই রুটির সঙ্গে বাজারের অন্য সব পাউরুটির মধ্যে পার্থক্য কেবল আকৃতি আর নকশায়। বানানোর পদ্ধতি আর স্বাদ মোটামুটি একই রকম হলেও এর অনন্য আকৃতির কারণে এখানকার মানুষের হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছে এ রুটি।

উজবেকিস্তানের সামারখন্দ, ইরান, তুরস্কসহ নানা দেশ আর শহর বাহারি সব রুটির জন্য বিখ্যাত। কিন্তু বাংলাদেশের অভিজাত কিছু সুপারশপ ছাড়া সেভাবে এমন বাহারি পাউরুটি/রুটি চোখে পড়ে না। আর গ্রামগঞ্জে তো পাওয়ার প্রশ্নই আসে না।  

সেখানে চলনবিলের মতো একটি প্রত্যন্ত অঞ্চলে এমন বাহারি রুটি আকৃষ্ট করে আসছে সবাইকে।   

এছাড়া দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশের মাটিতেও বেশ পরিচিতি লাভ করেছে এ পাউরুটি। নাটোর জেলার সিংড়া উপজেলার চলনবিলের হাট-বাজারগুলোতে প্রতিনিয়ত পাওয়া যাচ্ছে ঐতিহ্যবাহী বিশেষ ধরনের এ পাউরুটি।

জানা যায়, রাজা-বাদশাহদের আমল ও পাকিস্তান আমল থেকে সিংড়া উপজেলার কলম, পুন্ডরী, সাঁইল গ্রামের কয়েকজন কারিগর ও তাদের বাপ-দাদারা এ শাহী কাশ্মীরি পাউরুটি তৈরি করে বিক্রি করে আসছেন। তবে দুজন কারিগর সক্রিয়ভাবে এখনো এ রুটি তৈরি করেন। আর অন্যরা শুধুমাত্র শীতকালে এ পাউরুটি তৈরি ও বিক্রি করে থাকেন।  

প্রতিদিন তৈরি করে খোলাভাবেই বিক্রি করা হয় এসব রুটি। প্রতিদিনের রুটি প্রতিদিনই বিক্রি হয়ে যায়। এজন্য এর স্বাদও বেশি এবং চাহিদাও অনেক। আর বাজারে অন্যান্য যেসব কোম্পানি বা বেকারিতে বিশেষ মেশিনের মাধ্যমে তৈরি রুটি পলিথিনে প্যাকেটজাত করা হয়, সেগুলো দু-তিনদিন রেখে বিক্রি করা হয়। ফলে স্বাদ-মান একই  থাকে না। এজন্য ওই রুটির চেয়ে তাদের হাতের তৈরি এসব রুটির কদর অনেক বেশি।
অপরদিকে এ রুটির একেকটি ওজন হয় ২০৫ গ্রাম থেকে প্রায় এক কেজি পর্যন্ত। তাই তো লোকে এ রুটিকে কেজি রুটি বলেই বেশি ডাকে।  

সাধারণ পাউরুটির মতো হলেও আকারে অনেক বড়। দামও তুলনামূলকভাবে কম, প্রতি কেজি রুটির দাম ১০০ টাকা থেকে ১২০ টাকা। মাত্র ১২০ টাকায় এত বড় ও ভারি রুটি পাওয়া যায় বলে মানুষের কাছে এর কদরও অনেক বেশি।  
এ পাউরুটির আরও একটি বিশেষ দিক হলো এর স্বাদ ভালো এবং পুষ্টিকর। সাধারণ পাউরুটির মতো নরম নয়, বরং অনেকটাই শক্ত। এর স্বাদও কিছুটা ভিন্ন। একবার খেলে বারবার খেতে ইচ্ছে করবে। এজন্য দূর-দূরান্ত থেকে লোকজন আসে এসব রুটি কিনতে। বিশেষ করে ঈদ-মেলাসহ নানা সামাজিক, ধর্মীয় উৎসবকে কেন্দ্র করে এ রুটির চাহিদা আরও বেড়ে যায়।

এছাড়া এ রুটি রসগোল্লা এবং দুধ, নারিকেল ও খেজুরের গুর দিয়ে তৈরি সুরার সঙ্গে ভিজিয়ে খেতেও বেশ মজাদার। বিশেষ করে শীতের সময় এ রুটির চাহিদা আরও বেশি বেড়ে যায়। কারণ ওই সময় শীতের পিঠা-পুলির পাশাপাশি এসব রুটি কিনে নিয়ে মিষ্টি সিরায়/সুরায় ভিজিয়ে রেখে এক মজাদার খাবার তৈরি করা যায়। যুগ যুগ ধরে চলনবিলাঞ্চলের মানুষ এ ধরনের পাউরুটি দিয়ে খাবার তৈরি করে অতিথি আপ্যায়ন করে, নিজেরা খেয়ে পূর্বপুরুষের ঐতিহ্য ধরে রেখেছে।

স্থানীয়রা জানান, দীর্ঘদিন ধরে চলনবিলাঞ্চলের রানবাঘা, গুনাইখাড়া, কলমবাজার, নাজিরপুর, হাতিয়ানদহসহ বিভিন্ন হাট-বাজারে সপ্তাহ জুড়ে পাওয়া যায় এসব স্বাদের পাউরুটি। আর এসব পাউরুটি চলনবিলের সিংড়া উপজেলার কলম, পুন্ডরী ও সাঁইল গ্রামের ছয়টি কারখানায় তৈরি করা হয়। তবে দুজন কারিগর সক্রিয়ভাবে এ পাউরুটি তৈরি করে বাজারজাত করেন বেশি। তাদের একজন পুন্ডরী গ্রামের মো. সেলিম মোল্লা ওরফে জাকাত ও অপরজন হলেন কলম গ্রামের মো. আনিসুর রহমান।

তারা নিজেরাই নিজেদের কারখানায় এসব রুটি তৈরি করে থাকেন। এজন্য আলাদা কোনো শ্রমিকের প্রয়োজন হয় না। নিজস্বভাবে তৈরি কারখানায় নিজ বাড়িতেই স্ত্রী, সন্তানদের সঙ্গে নিয়ে সুস্বাদু শাহী কাশ্মীরি, নৌকা রুটিসহ নানা আকৃতির রুটি তৈরি করে থাকেন তারা। আর এসব রুটি তৈরি ও বিক্রি করেই চলে জীবন-জীবিকা, সংসারের যাবতীয় খরচ এবং ছেলে-মেয়েদের পড়ালেখা।

স্থানীয় ক্রেতা লোকমান হোসেন, আমিরুল ইসলাম বলেন, এখানকার তৈরি রুটির স্বাদ ভালো, চাহিদাও বেশি। কারণ শীতের সময় বিভিন্ন পিঠা-পুলির পাশাপাশি এ রুটি দুধ ও গুড় মিশ্রিত সিরায় ভিজিয়ে অতিথি আপ্যায়ন করা হয়। এছাড়া রসগোল্লা দিয়ে খেতেও মজাদার। হাটে-বাজারে অন্যান্য রুটির তুলনায় এ রুটির মান অনেক ভালো।  

তারা আরও জানান, আগে জমি কেনা-বেচা ও রেজিস্ট্রি করার সময় এসব রুটি আর রসগোল্লা খাওয়ার/খাওয়ানোর প্রচলন ছিল। জমি ক্রেতা এসব রুটি ও রসগোল্লা জমির বিক্রেতাকে খাওয়াতেন, বাড়ির জন্যও কিনে দিতেন, নিজের বাড়ির জন্যও নিয়ে যেতেন। কিন্তু এখন সেই প্রচলন নেই। তবে সেই রুটি এখনও তৈরি এবং বিক্রি হচ্ছে।

এ রুটি তৈরির প্রধান উদ্যোক্তা ও কারিগর সেলিম মোল্লা ওরফে জাকাত বাংলানিউজকে জানান, খুব ছোটবেলায় প্রথমে নানার কাছ থেকে, পরে বাপ-দাদার কাছে কারিগরি শিক্ষা নিয়ে রুটি তৈরির কাজ শুরু করেন। পরে দেশের বিভিন্ন বেকারিতেও কাজ করেছেন তিনি। এরপর ১৯৮৮ সাল থেকে নিজেই বাড়িতে ছোট কারখানা বানিয়ে পরিবারের লোকজনকে নিয়ে রুটি তৈরি ও হাট-বাজারে বিক্রি শুরু করেন। যা আজও চলমান আছে।

সপ্তাহে দুদিন হাট করেন এবং সপ্তাহে তিনদিন রুটি তৈরি করে থাকেন। প্রতি হাটে ৭০ থেকে ১০০ কেজি করে পাউরুটি বিক্রি করেন। একেকটি রুটির ওজন ২৫০ গ্রাম থেকে শুরু করে এক কেজি পর্যন্ত হয়। এসব রুটি বিক্রি করে ভালোই আয় হয়। এছাড়া বাড়ি থেকেও লোকজন এসে কিনে নিয়ে যায় এবং অনেকে অর্ডার দিয়ে বানিয়ে নেয়। শীতকালে এ রুটির চাহিদা বেশি থাকে। তাই রুটি তৈরি ও বাজারজাত করে যুগ যুগ ধরে তাদের পূর্বপুরুষের পেশা আর রাজা-বাদশাহদের খাবারের ঐতিহ্য বহন করে চলেছেন বলে জানান তিনি।

কলম গ্রামের আরেক কারিগর ও রুটি বিক্রেতা মো. আনিসুর রহমান বাংলানিউজকে বলেন, গ্রামের হাট-বাজারে দোকানে এসব রুটি যখন সারি সারিভাবে সাজানো থাকে, তখন সেখানে ভিড় জমে যায়। একসঙ্গে অনেক রুটি কিনে নিয়ে যান ক্রেতারা, যাতে বাড়িতে সবাই একসঙ্গে খেতে পারেন। এ রুটি শুধু খাবার নয়, অনেকটা সামাজিক ও সংস্কৃতির একটি অংশও বটে। প্রবাসীরা গ্রামে ফিরলে এ রুটি কিনে নিয়ে যান।

এমনকি বিদেশেও পাঠিয়ে দেন কেউ কেউ। সরকারি বিভিন্ন দপ্তরের লোকজন বা কর্মকর্তারা এসে অর্ডার দিয়ে এ রুটি বানিয়ে নিয়ে যান।  

তিনি বলেন, এ রুটির ব্যবসা করেই তাদের সংসার চলে। ছেলে-মেয়েদের পড়াশোনা এবং বিয়ে, বাড়ি নির্মাণ-সবই এ রুটি বিক্রির টাকায়ই হয়েছে। তাই বাপ-দাদার পেশা ও ঐতিহ্য ধরে রেখেছি।

স্থানীয় গণমাধ্যমকর্মী রাজু আহম্মেদ, আবু জাফর, রবিন খানসহ আরও অনেকে বাংলানিউজকে জানিয়েছেন, চলনবিলাঞ্চলের এসব রুটি স্থানীয় গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশের মাটিতে পরিচিত হচ্ছে বেশ। সবচেয়ে বড় কথা, এ রুটি মনে করিয়ে দেয় প্রতিটি অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী খাবার একেকটি সম্পদ। এখানকার পাউরুটির ইতিহাস বেশ প্রাচীন এবং এর যাত্রা শুরু হয়েছে প্রাচীনকাল থেকে। পাউরুটি মূলত এক ধরনের রুটি, যা গমের ময়দা ও পানি দিয়ে তৈরি করা হয়। আর চলনবিল এলাকার এ শাহী কাশ্মীরি রুটি শুধু খাবার নয়, বরং পরিচয় বহন করছে এলাকার।

এদিকে উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ সূত্রে জানা যায়, পাউরুটির ইতিহাস বেশ প্রাচীন এবং এর যাত্রা শুরু হয়েছে প্রাচীনকাল থেকে। পাউরুটি মূলত এক ধরনের পশ্চিমা শৈলীর রুটি, যা গমের ময়দা ও পানি দিয়ে তৈরি করা হয়। ইউরোপে এর প্রচলন বেশি হলেও বর্তমানে এটি বিশ্বজুড়ে জনপ্রিয় একটি খাবার।

প্রাচীন উৎপত্তি: পাউরুটির ইতিহাস রুটির ইতিহাসের সঙ্গে সম্পর্কিত। রুটি সম্ভবত প্রাচীনতম খাদ্যগুলোর একটি, যা প্রায় ১৪,৬০০ থেকে ১১,৬০০ বছর আগে বন্য গম, বার্লি এবং কন্দ থেকে তৈরি করা হতো।
প্রাচীন মিশর: প্রাচীন মিশরে রুটির ব্যবহার বেশ প্রচলিত ছিল এবং এটি একটি প্রধান খাদ্য হিসেবে বিবেচিত হতো। সেখানে সম্ভবত ৩০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে রুটি তৈরির কৌশল উন্নত করা হয়েছিল।

পর্তুগিজদের অবদান: পাউরুটি শব্দটি পর্তুগিজ শব্দ ‘পাও’ (pão) থেকে এসেছে, যার অর্থ রুটি। পর্তুগিজরা এ খাবারটিকে বাংলায় নিয়ে আসেন এবং তাদের মাধ্যমেই এটি বাংলায় পরিচিতি লাভ করে।

খামিরের ইস্টের ব্যবহার: রুটি তৈরির জন্য খামিরে ইস্ট ব্যবহার করা হয়, যা ময়দা/আটাকে ফাঁপা করে তোলে। প্রাচীনকালে বিভিন্ন উপায়ে খামির তৈরি করা হতো, যেমন প্রাকৃতিক অণুজীব, রাসায়নিক দ্রব্য বা শিল্পোৎপাদিত খামির।

উপকরণ ও প্রক্রিয়া: পাউরুটি সাধারণত গমের ময়দা, পানি, ইস্ট, লবণ, সামান্য চিনি, তেল মিশিয়ে খামির তৈরি করা হয়। এরপর খামির থেকে প্রয়োজনমতো আকৃতি  তৈরি করে সেঁকে নিলেই হয়ে যায় সুস্বাদু রুটি।

বর্তমান প্রচলন: বর্তমানে পাউরুটি বিশ্বজুড়ে একটি জনপ্রিয় খাবার এবং বিভিন্ন রূপে এটি পাওয়া যায়, যেমন সাদা পাউরুটি, বাদামি পাউরুটি ইত্যাদি।

এসআই

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।