ঢাকা, সোমবার, ২৭ শ্রাবণ ১৪৩২, ১১ আগস্ট ২০২৫, ১৬ সফর ১৪৪৭

সারাদেশ

‘সাদাপাথরে’ নজিরবিহীন লুটপাট

নাসির উদ্দিন, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭:৩৬, আগস্ট ১১, ২০২৫
‘সাদাপাথরে’ নজিরবিহীন লুটপাট নজিরবিহীন লুটপাটে বিবর্ণ ‘সাদাপাথর’। ছবি: মাহমুদ হোসেন

সিলেট: প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আধার ‍সিলেটে পর্যটন কেন্দ্রগুলোর অন্যতম কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার ভোলাগঞ্জ ‘সাদাপাথর’ এলাকা। এটি প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট একটি পর্যটনকেন্দ্র।

ধলাই নদীর উৎসমুখে ভারত থেকে নেমে আসা পাথররাজির স্তূপ থেকে সৃষ্ট পর্যটনকেন্দ্রটি মহিমান্বিত করেছে কোম্পানীগঞ্জকে। সীমান্তের জিরো লাইন সংলগ্ন ১০ নম্বর এলাকার নাম পড়ে যায় ‘সাদাপাথর’।

সেই সাদাপাথর এলাকায় প্রতিবছর লাখ লাখ পর্যটকের পদচারণা ঘটে কেবল সৌন্দর্যের টানে। পাথর মাড়িয়ে পড়া স্বচ্ছ জলরাশিতে গা ভাসিয়ে স্বর্গের সুধা নেন পর্যটকরা। মনোমুগ্ধকর সেই ‘সাদাপাথর’ এলাকাটি এখন প্রায় বিবর্ণ।

সম্প্রতি এখানে শুরু হয়েছে নজিরবিহীন লুটপাটে। তাতে বিবর্ণ হয়ে গেছে সাদাপাথর। ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেছে পর্যটনকেন্দ্রটি। প্রশাসনের উদাসীনতায় পাথরখেকোরা নির্বিঘ্নে চালিয়ে যাচ্ছে লুটপাট। এখনো মাটিখুঁড়ে বের করে নেওয়া হচ্ছে ‘সাদাপাথর’। দুই সপ্তাহে কোটি কোটি টাকার পাথর লুট হয়েছে বলে ধারণা স্থানীয়দের।

স্থানীয়রা জানান, আদালতের নিষেধাজ্ঞায় পাথর উত্তোলন বন্ধ থাকা পাথররাজ্যে লুটপাট শুরু হয় ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পট পরিবর্তনের পর থেকে। শাহ ভোলাগঞ্জের আরেফিন টিলা, রোপওয়ে বাংকার থেকে প্রকাশ্যে পাথর উত্তোলন করে এখন ধুলায় মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে। বাকি ছিল ‘সাদাপাথর’ ও তৎসংলগ্ন বসত বাড়ি। কোথাও কোথাও প্রভাবশালী নেতারা প্রভাব খাটিয়ে বসতবাড়ি কিনে নিয়ে পাথর উত্তোলন করছেন। পরিবেশের বারোটা বাজালেও কোম্পানীগঞ্জে যেন যেতে বারণ পরিবেশ অধিদপ্তরের।  

সাদাপাথরে চলছে লুটপাট।  ছবি: মাহমুদ হোসেনস্থানীয়রা বলছেন, গত দুই সপ্তাহে সাদাপাথর এলাকায় কয়েক দফা পাহাড়ি ঢল নামে। প্রতিবারই ঢলের তোড়ে স্তরে স্তরে পাথর ও বালু নামে। এবার দফায় দফায় ঢলের পর শুধু বালু দেখা গেছে। বালুর স্তর সরিয়ে পাথর লুটপাট হয়েছে। দুই সপ্তাহে কোটি কোটি টাকার পাথর লুট হয়েছে। এর নেপথ্যে রয়েছেন প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা।

গত ১৪ জুন সকালে প্রতিবেশ সংকটাপন্ন এলাকা (ইসিএ) জাফলং পরিদর্শনে গেলে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান এবং বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদবিষয়ক উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খানের গাড়িবহর আটকে দেন বালু-পাথর ব্যবসায়ী ও শ্রমিকেরা।

এসব আন্দোলনকারীর নেতৃত্বে ছিলেন রাজনৈতিক কিছু সংগঠনের কয়েকজন নেতা। এ সময় তারা বন্ধ থাকা জাফলংসহ সিলেটের পাথর কোয়ারিগুলো চালুর দাবিতে স্লোগান দেন। কিন্তু পাথর কোয়ারিগুলো খুলে দেওয়ার দাবিতে যখন উপদেষ্টাদের গাড়ি আটকানো হয়, তখনো পাথর লুটপাটের ঘটনা অব্যাহত ছিল।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার বাসিন্দাদের অনেকে বলেন, পাথররাজ্যে বড় লুটপাট হয়েছে গত বছরের ৫ আগস্টের পর থেকে। দিনে ও রাতে চলেছে লুটের মচ্ছব। সে সময় প্রতিরাতে অন্তত শতাধিক গাড়ি পাথর কোম্পানীগঞ্জ থেকে বের হয়ে যেতো। আর পাথর লুটের নেতৃত্বে ছিলেন স্থানীয় প্রভাবশালী এক রাজনৈতিক নেতা। উপজেলা প্রশাসন ও পুলিশ, বিজিবির নীরবতায় লুট হয়েছে সাদাপাথরও। স্থানীয় কালাসাদেক বিওপি অতিক্রম করেই যেতে হয় পাথর কোয়ারিতে। বিজিবির ফাঁড়ি এলাকা মাড়িয়েই পাথরের ট্রাকগুলো যায় গন্তব্যের উদ্দেশ্যে।

বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) সিলেট বিভাগীয় সমন্বয়ক শাহ সাহেদা আখতার বাংলানিউজকে বলেন, ‘৫ আগস্টের পরিবর্তন সারা দেশে এসেছে। সেটিকে আমরা রাজনৈতিক পরিবর্তন ধরে নিয়েছি। কিন্তু সব দিক দিয়ে নেতিবাচক পরিবর্তন এসেছে। তেমনি নেতিবাচক পরিবর্তন সিলেটেও এসেছে। এখানে প্রশাসনের কোনো তদারকি নেই। ধ্বংসযজ্ঞ দেখে মনে হয়, এই বিষয়গুলো ঠেকানোর কেউ নেই। ’

পরিবেশ অধিদপ্তর সিলেটের সহকারী পরিচালক বদরুল হুদা বাংলানিউজকে বলেন, ‘জাফলং যেমনি ইকোলজিক্যালি এরিয়া, তেমনি সাদাপাথর নয়। যে কারণে সাদাপাথরে অভিযান চালাতে পারি না। ইতোমধ্যে জাফলংয়ে অভিযানে ১২টার বেশি মামলা করেছি। তারপর জেলা প্রশাসন থেকে টাস্কফোর্সের অভিযান পরিচালিত হলে আমরা সংযুক্ত থাকি। মূলত এটি খনিজসম্পদের আওতায়। পরিবেশ সংশ্লিষ্ট আমলযোগ্য নয়। যেমনটি লোভাছড়াতে অভিযান চালিয়ে মামলা করতে গেলে খনিজসম্পদ থেকে চিঠি দিয়ে বাধা দেয়। ’

খনিজসম্পদ উন্নয়ন ব্যুরোর (বিএমডি) সহকারী পরিচালক (খনি প্রকৌশল) ফারজানা হক বাংলানিউজকে বলেন, ‘আমার মনে হয়, এসব বিষয়গুলি নিয়ে যারা দেখছেন, তারা কাজ করছেন। ’

কারা দেখছেন, সেটি উল্লেখ করতে চাননি তিনি।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আাজিজুন্নাহার বাংলানিউজকে বলেন, ‘পাথর লুটপাট ঠেকাতে আমরা নিয়মিত মোবাইল কোর্ট করছি। আজও অব্যাহত আছে। কিন্তু ২৪ ঘণ্টা পাহারা দেওয়া তো সম্ভব না। যে কারণে বিজিবি ও রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনী (আরএনবি) যাতে গুরুত্বের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করে, সেজন্য যথাযথ কর্তৃপক্ষের (জেলা প্রশাসক) মধ্যেমে চিঠি দিয়েছি। তাছাড়া বিএমডিতেও যোগাযোগ করেছি। তারা তাদের একজন ম্যাজিস্ট্রেট পাঠাবেন, তবে একদিনের অভিযানে পাথর লুটপাট দমন করা সম্ভব না। ’

পাথর লুটের বিষয়ে জানতে সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) উজায়ের আল মাহমুদ ‘মিটিংয়ে আছেন’ বলে মোবাইল সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন।

সাদাপাথরে চলছে লুটপাট।  ছবি: মাহমুদ হোসেনসিলেটের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শের মাহবুব মুরাদ বাংলানিউজকে বলেন, ‘পাথর লুটপাট ঠেকাতে আমাদের নিয়মিত অভিযান অব্যাহত আছে। আজও অভিযান চলছে। ’

অভিযানের পরও লুটপাট ঠেকাতে না পারায় কোনো কঠোর পদক্ষেপের দিকে যাচ্ছেন কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমরা আলোচনা করে কঠোর পদক্ষেপের দিকে যাচ্ছি। ’

ভেসে আসা পাথর উত্তোলিত পাথরের চেয়েও দামি
কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার সীমান্তবর্তী পশ্চিম ইসলামপুর ইউনিয়নে ‘সাদাপাথর’ এলাকাটির অবস্থান। এটির ওপারে ভারতের মেঘালয় রাজ্যের পাহাড়ি অঞ্চল লুংলংপুঞ্জি ও শিলংয়ের চেরাপুঞ্জি। সেখানকার ঝরনা দিয়ে বছরজুড়ে পানি প্রবহমান থাকে। বৃষ্টিবহুল চেরাপুঞ্জির পাদদেশ থেকে বর্ষায় ঢলের পানির সঙ্গে পাহাড় থেকে পাথরখণ্ড এপারে নেমে আসে। ভেসে আসা এই পাথর উত্তোলিত বা আমদানি করা পাথরের চেয়ে দামি। এটির কদরও বেশি। ব্যবহৃত হয় স্থাপত্যকাজে।

২০১৭ সালে পাহাড়ি ঢলে সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার ভোলাগঞ্জ পাথরমহালের ধলাই নদের উৎসমুখে পাঁচ একর জায়গাজুড়ে জমা হয় সেই পাথর। ঢলের তোড়ে সেখানে সর্বশেষ ১৯৯০ সালে একবার পাথর জমা হয়েছিল। পাহাড়ি ঢলের পর লুটপাটে সেসব পাথর নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। ২৭ বছরের মাথায় ফের পাথর জমা হওয়ায় উপজেলা প্রশাসন ও স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের পাহারায় সংরক্ষিত হয়। ওই বছর থেকে পুরো এলাকাটি প্রাকৃতিক পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে পরিচিতি পায়।

বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা গেছে, ২০১৭ সালের মার্চ মাস থেকে মধ্য জুলাই পর্যন্ত মোট ১৩ দফা পাহাড়ি ঢল নেমেছিল। তখন উপজেলা প্রশাসন প্রাথমিকভাবে হিসাব করেছে ঢলের তোড়ে ওপার থেকে পাথরের অন্তত ১৩টি আস্তরণ পড়ে। পাঁচ একর জায়গার ওপরে অন্তত ২০ ফুট পুরু পাথরের স্তর জমে। তখন উপজেলা প্রশাসন লুটপাট ঠেকিয়ে পাথরগুলো সংরক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ করে। ২০১৭ সাল থেকে এটি ‘সাদাপাথর পর্যটন এলাকা’ হিসেবে পরিচিতি পায়।  

এনইউ/এইচএ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।