২০২৪ সালের ৫ আগস্ট। সকালটা ছিল খুব সাধারণ, অন্য দিনগুলো যেমন হয়।
সকাল ১১টার দিকে প্রথম মিছিল শুরু হয়। কয়েকশ মানুষ দেশীয় অস্ত্র হাতে এলআর উচ্চ বিদ্যালয়ের মাঠ থেকে থানার দিকে এগিয়ে যায়। পথে বাড়তে থাকে জনতার স্রোত। ঘণ্টাখানেকের মধ্যে এ সংখ্যা দাঁড়ায় কয়েক হাজার। ৫ আগস্টের আগের দিনগুলোতে নৃশংসতা চালানো পুলিশের মুখোমুখি দাঁড়ায় ক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা। উত্তেজনা চরমে পৌঁছায়। পুলিশ অবস্থান নেয় থানার ভেতরে। শুরু হয় ইট-পাটকেল বৃষ্টি। জবাবে পুলিশ ছোড়ে রাবার বুলেট, টিয়ার গ্যাস আর গুলি।
গুলিতে ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারান চারজন। পরবর্তীতে হাসপাতালে এবং হাসপাতালে নেওয়ার পথে মারা যান আরও ৫ জন।
নিহতদের একজন নবম শ্রেণির ছাত্র আনাস। বয়স ছিল মাত্র ১৪। তার মতোই নিহত হন ১২ বছরের শিশু হাসান মিয়া। স্কুলব্যাগ ছুড়ে ফেলে যারা বেরিয়েছিল মিছিলে, তাদের অনেকে আর ঘরে ফেরেনি। রংমিস্ত্রি তোফাজ্জল মিয়া (২২), কাঠমিস্ত্রি আশরাফুল (১৭), রাজমিস্ত্রি নয়ন মিয়া (১৮), শ্রমজীবী মোজাক্কির (৪০), পেশাজীবী সাদিকুর রহমান (৩০), আকিনুর মিয়া (৩৫)— এরা কেউ রাজনীতি করতেন না। শুধু প্রত্যাশা ছিল বদলের, ক্ষোভ ছিল বৈষম্যের বিরুদ্ধে, স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে। তাদেরও থামিয়ে দেয় গুলি, লাঠিপেটা আর ধোঁয়া।
সাংবাদিক সোহেল আখঞ্জি তখন ছবি তুলছিলেন থানার গেটে। তাকেও বাঁচানো যায়নি। উত্তেজিত জনতা তাকে আওয়ামী লীগ নেতা ও চেয়ারম্যানের লোক হিসেবে মারধর করে।
একজন প্রত্যক্ষদর্শী রাজু আহমেদ বলেন, হাসনাইন নামে এক ছেলের মাথায় গুলি লেগে যায়। তার রক্ত গায়ে পড়ে আমরা দৌড় দিতে পারিনি। সেদিন আমি বুঝেছিলাম— এই দেশে মানুষ মারা গেলে খুব কম লোক দৌড়ে আসে বাঁচাতে।
নিহতদের লাশ পড়ে থাকতেই থানা গেটে হামলা শুরু হয়। জনতা গেট ভেঙে ঢুকে পড়ে। এরপর ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ। চারটি ভবনে আগুন। পুড়ে যায় ১২৮টি গাড়ি, পুলিশের পিকআপ, মোটরসাইকেল, জব্দ করা যানবাহন, এমনকি এক নারী কনস্টেবলের স্বামীর ব্যক্তিগত প্রাইভেট কারও। আগুনে পুড়ে ছাই হয় কম্পিউটার, টিভি, ওয়্যারলেস, সিসিটিভি, ফাইল, মসজিদের মাইক ও এসি।
লুট হয় ১৩টি আগ্নেয়াস্ত্র, ২ হাজার ১৯৭ রাউন্ড গুলি, ২১টি ম্যাগাজিন ও নানা সরঞ্জাম। এক বছরের মাথায়ও একটি পিস্তল ও একটি চায়না এসএমজি উদ্ধার হয়নি।
ঘটনার ভয়াবহতায় সেনাবাহিনী হস্তক্ষেপ করে। পুলিশ সদস্যদের ব্যারাক থেকে বের করে অস্ত্র জমা নিয়ে তাদের উদ্ধার করে সার্কিট হাউজে নেওয়া হয়। ততক্ষণে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার, ওসি ও অন্যান্য সদস্যরা মারধরের শিকার হন।
ওই রাতে পুলিশের এসআই সন্তোষ চৌধুরী নিহত হন। দুপুরে অস্ত্রাগার থেকে চায়না রাইফেল নিয়ে গুলি ছুড়েছিলেন তিনিই, যার গুলিতে কয়েকজন প্রাণ হারান। পরে তিনি পুলিশের শেষ দলটির সঙ্গে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে আন্দোলনকারীদের হাতে ধরা পড়েন এবং পিটিয়ে মারা হন। তার মৃত্যু ছিল এক প্রতিশোধের বহিঃপ্রকাশ, যেটি সেই মুহূর্তে ঠেকাতে পারেনি কেউ।
ঘটনার ১৭ দিন পর, ২২ আগস্ট, পুলিশ বিশেষ ক্ষমতা আইনে মামলা করে। অভিযোগে বলা হয়, আট থেকে দশ হাজার অজ্ঞাতনামা লোক থানা ঘেরাও, আগুন, লুটপাট ও হত্যাকাণ্ডে জড়িত। এর আগেই শহীদ আনাসের বাবা আরেকটি হত্যা মামলা করেন।
স্মৃতিচারণ করে বানিয়াচং উপজেলার ৪ নম্বর ইউপি চেয়ারম্যান মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ আলী মমিন বলেন, আজও বানিয়াচংয়ের মানুষ ৫ আগস্টকে ভয়ে ও শোকে মনে করে। পুকুরঘাটে, মসজিদে, স্কুলে, দোকানে, এখনো আলোচনায় আসে সেই ভয়াল দিনের কথা, আলোচনায় আসে শহীদদের কথা। কেউ বলে, আনাস ও হাসান বেঁচে থাকলে এখনো রাস্তায় নামতো স্কুলড্রেস পরে। কেউ বলে, তোফাজ্জল মারা না গেলে এবার হয়তো দেশে ঘর করত। কেউ চুপ করে থাকে, কিছু না বলে আকাশের দিকে চায়।
বানিয়াচংয়ের ৫ আগস্ট এখন কেবল একটি কালপঞ্জির তারিখ নয়। এটি আগুনে পোড়া গন্ধ, বুকে বারুদ ঠাসা তরুণদের অন্যায়ের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার দিন, স্বজন হারানোর আর্তনাদ, জুলুমের বিরুদ্ধে মজলুমের ঐক্যবদ্ধ রুখে দাঁড়ানোর স্মৃতিভরা একদিন।
এমইউএম