ফেনী: স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের উত্তাল প্রেক্ষাপটে যখন দেশ স্বপ্ন দেখছিল মুক্তির, ঠিক তার আগের দিন ফেনীর মহিপালে ঘটে যায় এক বিভীষিকাময় ঘটনা। আন্দোলনে অংশ নেওয়া নিরীহ ছাত্রদের ওপর চালানো হয় নির্মম গুলিবর্ষণ।
সেই ঘটনায় প্রাণ হারায় আটজন ছাত্র; মোট নিহতের সংখ্যা দাঁড়ায় ১১। এক বছর পেরিয়ে গেলেও স্বজনদের চোখে এখনো সান্ত্বনার আলো নেই। হোতারা রয়েছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে, বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়নি, উদ্ধার হয়নি হামলায় ব্যবহৃত অবৈধ অস্ত্রও।
ফেনীর সেই বিভীষিকাময় হত্যাকাণ্ডের মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত নাম ইশতিয়াক আহমেদ শ্রাবণ। আজও ছেলেটির কথা উঠলে ভারী হয়ে ওঠে স্বজন, সহপাঠী ও স্বেচ্ছাসেবকদের কণ্ঠ। চোখ ভিজে আসে পরিচিত সবার।
গত বছরের ৪ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের অংশ হিসেবে ফেনীর মহিপালে কর্মসূচিতে অংশ নেন শ্রাবণ। এর আগের প্রতিটি কর্মসূচিতেও ছিলেন তিনি সক্রিয়। কিন্তু সেদিন আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের নির্বিচার গুলিতে প্রাণ হারান এই তরুণ।
শ্রাবণ ছিলেন ফেনী সরকারি কলেজের উচ্চমাধ্যমিক উত্তীর্ণ ছাত্র। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। স্বপ্ন ছিল উচ্চশিক্ষা ও সমাজের পরিবর্তনের, কিন্তু তা থেমে যায় গুলির আওয়াজে।
শহীদ শ্রাবণের বাবা নেছার আহম্মদ বলেন, একমাত্র ছেলে সন্তান ছিল শ্রাবণ। বুকের ধন ছিল। এখন বুকটা খাঁ খাঁ করে। নারকীয় এ হত্যাকাণ্ডের এক বছর পেরিয়ে গেছে। অনেক আসামি দেশের বাইরে চলে গেছে। আবার অনেকে দেশে থাকা সত্ত্বেও এখনো আইনের আওতায় আসেনি। বিচার নিশ্চিত না হলে আমাদের হাজারো সন্তানের রক্ত ও আত্মত্যাগ বৃথা যাবে। কোটি কোটি টাকা বা অট্টালিকা আমরা চাই না। সন্তানের হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের বিচারই একমাত্র চাওয়া ও পাওয়া।
পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, শ্রাবণ ছিলেন একজন তরুণ সংগঠক ও ক্রিকেটার। ২০০৪ সালের ১২ ডিসেম্বর জন্ম তার। ২০২৩ সালে ফেনী সরকারি কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির অপেক্ষায় ছিলেন। শহীদ শ্রাবণ বাবা-মায়ের সঙ্গে ফেনী শহরের বারাহীপুর এলাকায় বসবাস করতেন। তার পৈত্রিক বাড়ি ফুলগাজী উপজেলার আনন্দপুর ইউনিয়নে। তিন-ভাইবোনের মধ্যে শ্রাবণ সবার বড় এবং বাবার একমাত্র ছেলে।
শ্রাবণের বাবা নেছার আহম্মদ আরও বলেন, আমাদের এখন আর কোনো আনন্দ নেই। আখিরাতে ছেলের সঙ্গে দেখা হলে সেদিন আনন্দ হবে। বুকে পাথর নিয়ে চলাফেরা করি। কাউকে বলতে পারি না সন্তান হারানোর এই কষ্টের কথা।
অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া তরুণদের প্রতি হতাশা ব্যক্ত করে তিনি বলেন, উনারা (ছাত্ররা) বিভিন্ন রাজনীতি নিয়ে ব্যস্ত। এখন রাজনৈতিক দল নিয়ে এসেছে। শহীদ পরিবারের দিকে কে তাকাবে? এজন্য এখনো বাধ্য হয়ে রাস্তায় নামতে হয়। আমরা ন্যায্য ও প্রাপ্য অধিকার চাই।
শ্রাবণের মা ফাতেমা আক্তার শিউলি বলেন, ৪ আগস্টের পর থেকে সব আনন্দ চলে গেছে। আমাদের গোছানো একটা জীবন অগোছালো হয়ে গেছে। জীবনের সব আনন্দ সেদিনই শেষ হয়ে গেছে। বড় মেয়েটি সারাক্ষণ একা একা বসে কান্না করে, শ্রাবণই ছিল তার ভাই-বন্ধু। মেয়েটি কাউকে কিছু বোঝাতে পারে না এখনো। ভাইয়ের শোকে কারো সঙ্গে কথা বলে না। আমার আনন্দ বা সুখ-আহ্লাদ সবকিছু আমার ছেলের কাছে রয়ে গেছে।
তিনি বলেন, এখন শুধু সুষ্ঠু একটি বিচারই আমাদের চাওয়া। আসামিরা বাইরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। বড় বড় আসামিরা দেশের বাইরে পালিয়ে গেছে। এ দুনিয়ায় বিচার না হলেও মহান আল্লাহর কাছে বিচার দিয়েছি। আমি তো সন্তানকে হারিয়ে ফেললাম, বিচার আল্লাহ করবেন ইনশাআল্লাহ। আমার ছেলে সবসময় ধর্মীয় রীতিনীতি মেনে চলত। এসব বিষয়ে ভীষণ আন্তরিক ছিল সে।
জেলা প্রশাসক মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, আন্দোলনে ফেনীতে হতাহতের সংখ্যা অন্য জেলার চেয়ে তুলনামূলক বেশি ছিল। ক্ষতিগ্রস্তদের আর্থিক, চিকিৎসা সহায়তা ও পুনর্বাসনের জন্য আমরা সর্বাত্মক চেষ্টা করেছি। সরকারের পক্ষ থেকে জেলার ১০টি শহীদ পরিবারকে ১০ লাখ টাকা করে মোট এক কোটি টাকা সহায়তা দেওয়া হয়েছে।
আহতদের মধ্যে ‘এ’ ক্যাটাগরির তিনজনকে ৬ লাখ টাকা, ‘বি’ ক্যাটাগরির ৩০ জনকে ৩০ লাখ টাকা এবং ‘সি’ ক্যাটাগরির ৩৪৩ জনকে তিন কোটি ৪৩ লাখ টাকা দেওয়া হয়েছে। এসব সহায়তার বাইরেও জেলা প্রশাসন, সমাজসেবা অধিদপ্তরসহ বিভিন্ন দপ্তরের মাধ্যমে সবমিলিয়ে হতাহতদের এখন পর্যন্ত প্রায় পাঁচ কোটি ৫৪ লাখ টাকা সহায়তা দেওয়া হয়েছে।
ফেনীতে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের গ্রেপ্তারের বিষয়ে জানতে কথা হয় পুলিশ সুপার মো. হাবিবুর রহমানের সঙ্গে। তিনি বলেন, জেলায় বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের ঘটনায় ২২টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে সাতটি হত্যা ও ১৫টি হত্যাচেষ্টা মামলা। এসব মামলায় দুই হাজার ১৯৯ জন এজাহারনামীয় এবং চার হাজার অজ্ঞাত আসামি রয়েছে। তাদের মধ্যে এক হাজারের বেশি আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গ্রেপ্তার থাকা ১১ আসামি আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। একটি মামলায় চার্জশিট দেওয়া হয়েছে। অন্য আসামিদের গ্রেপ্তারে পুলিশের অভিযান অব্যাহত রয়েছে।
এসএইচডি/আরএইচ