ঢাকা, মঙ্গলবার, ১৩ শ্রাবণ ১৪৩২, ২৯ জুলাই ২০২৫, ০৩ সফর ১৪৪৭

সারাদেশ

হেলিকপ্টার থেকে ছোড়া গুলি গলায় বিদ্ধ হয়ে প্রাণ হারান ইঞ্জিনিয়ার রাকিবুল

এম রবিউল ইসলাম রবি, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭:২৩, জুলাই ২৮, ২০২৫
হেলিকপ্টার থেকে ছোড়া গুলি গলায় বিদ্ধ হয়ে প্রাণ হারান ইঞ্জিনিয়ার রাকিবুল শহিদ ইঞ্জিনিয়ার রাকিবুলের ছবি হাতে মা বাবা

ঝিনাইদহ: উত্তাল জুলাই বিপ্লবের ১৯ জুলাই শুক্রবার। তখন ঘড়ির কাটায় রাত ১১টা বেজে ৪৫ মিনিট।

ঢাকার কর্মস্থল থেকে একজন সহকর্মী ফোন করে জানান ইঞ্জিনিয়ার রাকিবুল পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছেন। মিনিট কয়েকের মধ্যেই তারা মরদেহ নিয়ে গ্রামের বাড়ি ঝিনাইদহে রওনা হবেন।

অশ্রুসজল নয়নে কথাগুলো বলছিলেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে শহীদ ঝিনাইদহের সন্তান ইঞ্জিনিয়ার রাকিবুল হোসেনের বৃদ্ধ পিতা বিমান বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আবুবকর সিদ্দিক।

২০১১ সালে এসএসসি পাস করা শহীদ ইঞ্জিনিয়ার রাকিবুল হোসেন উচ্চ মাধ্যমিক পাস করার পর মিরপুরে অবস্থিত বাংলাদেশ সেনাবাহিনী পরিচালিত মিলিটারি ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজিতে (এমআইএসটি) ভর্তি হন। মিরপুরের ভাড়া বাসায় একাই বসবাস করতেন।  

তিনি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের এক দফা দাবিকে সমর্থন দিয়ে প্রথম থেকেই রাজপথে ছিলেন সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের সাথে। আন্দোলনের ব্যস্ততায় ক্যান্সার আক্রান্ত মা হাফিজা বেগমের সাথে ঠিকমত কথা বলতেন না মোবাইলে।  

ঘটনার দিন ১৯ জুলাই ইঞ্জিনিয়ার রাকিবুল সারাদিন আন্দোলনে উত্তাল মিরপুর ১০ ও ১১ নম্বর সেক্টরে সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের সাথে রাজপথে ছিলেন। মিরপুর দশ গোলচত্বরে রাত সাড়ে নয়টার দিকে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে অন্য একজনের সাথে কথা বলার সময় হঠাৎ হেলিকপ্টার থেকে ছোড়া একটি বুলেট এসে বিদ্ধ হয় শহীদ রাকিবুলের গলায়। সাথে সাথে তিনি লুটিয়ে পড়েন রাস্তায়।  

পরে তাকে পথচারীরা মিরপুর আজমল হাতপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।  

২৯ বছর বয়সী পরিবারের ছোট ছেলে রাকিবুলের বিয়ের জন্য পাত্রী সন্ধান করছিলেন পিতামাতা। ক্যান্সার চিকিৎসার জন্য ১৯ জুলাই শুক্রবার দুপুরে স্ত্রীকে নিয়ে ভারতে যাওয়ার কথা ছিল আবুবকর দম্পতির। কিন্তু সেদিন থেকে শুরু হয় ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের কার্ফু।  

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাক দেওয়া ‘কমপ্লিট শাট ডাউন’ সফল করতে সকাল ১০টার দিকে আন্দোলনে ঝাপিয়ে পড়েন ইঞ্জিনিয়ার রাকিবুল। প্রায় ১০ কাটন পানি কিনে রাস্তায় শিক্ষার্থীদের মাঝে বিতরণ করেন।  

জুমর নামাজের পর থেকেই মিরপুরের রাজপথ অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে। রাস্তায় শ’শ’ পুলিশ ছাত্রদের উদ্দেশ্যে গুলি চালায়। চারিদিকে শুধু লাশ আর লাশ। এভাবে দিন গড়িয়ে বিকেল-সন্ধ্যা গড়িয়ে যায়, তবুও রাজপথের দখল ছাড়েনি বৈষম্যবিরোধী দামাল ছেলেরা।

রাত সাড়ে আটটার দিকে অসুস্থ মায়ের সাথে রাকিবুলের শেষ কথা হয়। তিনি মাকে বলেছিলেন, ‘চিন্তা করো না মা, হাসিনার পতন হবেই। ছাত্রদের সাথে সাধারণ মানুষও রাস্তায় নেমেছে। অত্যাচারী জালিমকে তার কোন ভিনদেশি প্রভুই রক্ষা করতে পারবে না’।

রাকিবুলের বৃদ্ধ পিতা আবুবকর সিদ্দিক জানান, ছাত্র আন্দোলন দমন করতে স্বৈরাচার হেলিকপ্টার থেকে গুলি চালিয়েছে ছাত্রদের বুকে। হেলিকপ্টার গানশিপের গুলিতে তার ছেলে মারা গেলেও মরদেহের ময়নাতদন্ত হয়নি।

২০ জুলাই ভোওে মরদেহ ঝিনাইদহ শহরের মহিষাকুন্ডু গ্রামের বাড়িতে পৌঁছানোর পর অনেকটা তড়িঘড়ি করে দাফনের জন্য হরিনাকুন্ডু উপজেলার বাসুদেবপুর পারিবারিক কবরস্থানে নিয়ে যাওয়া হয়।  

তিনি আরো জানান, রাকিবুলের হত্যার ঘটনায় ৯৮ জনকে আসামি করে মামলা করা হয়েছে। কিন্তু বিচার আদৌ হবে কিনা তা নিয়ে তারা উদ্বিগ্ন।  

রাকিবুলের মা হাফিজা বেগম ছেলে হত্যার বিচার পাবেন না বলে আশংকা প্রকাশ করে বলেন, গত ৪ ডিসেম্বর আদালত শহীদ রাকিবুলের মরদেহ কবর থেকে উত্তোলন করে ময়নাতদন্ত করার জন্য আদেশ দিয়েছেন। কিন্তু আমারা শেষ পর্যন্ত বিচার পাবো না এমন আশংকা থেকেই সন্তানের মরদেহ কাটা ছেঁড়া করতে রাজি নই।  

তিনি দাবি করেন জুলাই শহীদদের হত্যার বিচার করতে হলে রাজনৈতিক দলসহ বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের সদিচ্ছা থাকতে হবে। অন্যথায় তার সন্তানসহ হাজারো শহীদের জুলাই বিপ্লবের চেতনা ম্লান হয়ে যাবে।

ঝিনাইদহ জেলা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনেরযেুগ্ম আহ্বায়ক আনিচুর রহমান জানিয়েছেন, নিহত রাকিবুলের পরিবারের সার্বক্ষনিক খোঁজখবর রাখা হচ্ছে। ইতিমধ্যে জুলাই স্মৃতি ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে পাঁচ লাখ, জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ৫০ হাজার, কেন্দ্রীয় বিএনপির পক্ষ থেকে ৫০ হাজার ও কেন্দ্রীয় জামায়াত ইসলামীর পক্ষ থেকে এক লাখ মোট সাত লাখ টাকা রাকিবুলের বৃদ্ধ বাবা মাকে প্রদান করা হয়েছে।  

এসএইচ
 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।