ঢাকা, মঙ্গলবার, ৩০ আষাঢ় ১৪৩২, ১৫ জুলাই ২০২৫, ১৯ মহররম ১৪৪৭

সারাদেশ

ফেনীতে বন্যার তাণ্ডব

বিধ্বস্ত ঘরবাড়ি, নষ্ট ফসলি জমি—চার উপজেলায় হাহাকার

সোলায়মান হাজারী ডালিম, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১:১৩, জুলাই ১৪, ২০২৫
বিধ্বস্ত ঘরবাড়ি, নষ্ট ফসলি জমি—চার উপজেলায় হাহাকার ফেনীতে বন্যার তাণ্ডবে ভেঙে পড়েছে বসতবাড়ি

ফেনীর উত্তরের উপজেলা পরশুরামের ধোপাপাড়া; চারিদিকে পড়ে আছে মানুষের ঘরবসতির ধ্বংসাবশেষ। পানি কমে যাওয়ায় দেখা যাচ্ছে বন্যার দগদগে ক্ষত চিহ্ন।

এখানকার বাসিন্দা শিউলি রানী দাস বলছিলেন, বন্যা শুরুর দিনের সেই ভয়ানক পরিস্থিতির কথা। হঠাৎ নদীর বাঁধ ভেঙে নিমিষেই যেন দীর্ঘদিনের সাজানো গোছানো সংসারের সবটা ভাসিয়ে নিলো। কোনোমতে প্রাণে বাঁচলেও সংসারের আর কিছুই রক্ষা করা যায়নি। শিউলি জানান, চারদিন ধরে এক কাপড়েই আছেন। শাড়িটি ছাড়া কিছুই আর অবশিষ্ট নেই।

কলি রানী দাসও জানালেন তার সব হারানোর কথা। বললেন, চুলা জ্বলে না আজ পাঁচদিন। সব হারিয়ে একদম নিঃস্ব তিনি। এখন মানুষের কাছে হাত পাতা ছাড়া উপায় নেই।


ঘরবাড়ি, জমির ফসল হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে গেছেন চার উপজেলার বহু মানুষ
 
যুব চন্দ্র দাস, অর্জুন চন্দ্র রায়ও সব হারিয়েছেন। পাড়ার মুদি দোকানি জাফর ইবনে আল মনসুর বলেন, ভাগ্য ভালো, হায়াত থাকায় বেঁচে আছি। দোকানের টিভি, ফ্রিজ, মালামাল থেকে শুরু করে নগদ টাকা— সব মিলিয়ে সাড়ে ৩ লাখ টাকার জিনিস ভাসিয়ে নিয়েছে বানের জল।

বন্যায় বিপর্যস্ত এলাকাটি পরিদর্শনে এসে এবি পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু বলেন, একদম ঘটনাস্থলে এসে না দেখলে বোঝা যাবে না কতটা ভয়াবহ ছিল ফেনীর এই বন্যা। সব হারিয়ে মানুষগুলো একদম নিঃস্ব।

বন্যার তাণ্ডবে চার উপজেলাজুড়ে ভেঙে গেছে রাস্তাঘাট, ধসে পড়েছে বসতঘর। ফসলি জমি তলিয়ে এবং গবাদি পশু হারিয়ে অসহায় হয়ে পড়েছেন চার উপজেলার লক্ষাধিক বাসিন্দা।

পুরো ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ না করা গেলেও এতে কয়েক কোটি টাকার ক্ষতির আশঙ্কা করছেন স্থানীয়রা। এ ছাড়া বানভাসিরা আশ্রয়কেন্দ্র থেকে বাড়িতে ফিরলেও আরেক দফা সংকটে পড়েছেন। কর্দমাক্ত ঘরবাড়ি, নষ্ট হয়ে যাওয়া খাবার, ভাঙাচোরা আসবাবসহ সব মিলিয়ে নতুন করে বাঁচার লড়াইয়ে নেমেছেন তারা।

জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, বন্যায় ডুবে যাওয়া ১৩৭ গ্রামের মধ্যে ১২১টি গ্রামের পানি ইতোমধ্যে নেমে গেছে। এর মধ্যে পরশুরাম উপজেলার পানি পুরোপুরি নেমে গেছে। ফুলগাজী উপজেলার প্লাবিত ৬৭ গ্রামের মধ্যে ৬২টি গ্রামের পানি নেমে গেছে। বাকি পাঁচটি গ্রামের পানি দ্রুত নামছে।

এ ছাড়া ফেনী সদর ও দাগনভূঞার পানি দ্রুত নামছে। এরই মধ্যে ৯ হাজার ৭৬ জন বানভাসি আশ্রয়কেন্দ্র ত্যাগ করে বাড়ি ফিরেছেন। নয়টি আশ্রয়কেন্দ্রে আর ৪৮৪ জন আশ্রয় নিচ্ছেন। তারা পরিস্থিতি উন্নত হলে আশ্রয়কেন্দ্র ত্যাগ করবেন। এ ছাড়া মুহুরী নদীর পানি বিপৎসীমার ৪ দশমিক ২৮ মিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।

পরশুরাম উপজেলা কৃষি অফিস সূত্র জানায়, প্রাথমিক হিসেবে বন্যায় পানিতে আমনের ১৫০ হেক্টর বীজতলা, আউশ ধান ৪০ হেক্টর, গ্রীষ্মকালীন সবজি ৯০ হেক্টর, মরিচ ২ হেক্টর, আদা ১ হেক্টর, হলুদ ৫০ শতকসহ তলিয়ে গেছে। এতে সম্ভাব্য ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৬০ লাখ টাকা।

উপজেলা প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর জানায়, বন্যার পানিতে দুটি গরু, একটি ছাগল, ৭ হাজার ২০০ মুরগি, ২৩৫টি হাঁস মারা গেছে। ১৫টি গবাদি পশুর খামার ও ১৭টি হাঁস-মুরগির খামার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। প্রাণিসম্পদ খাতে প্রায় ৩৭ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে।

উপজেলা মৎস অধিদপ্তর সূত্র জানিয়েছে, ১৩০টি পুকুর ও মৎস্য ঘের থেকে ৫৫ টন মাছ ও মাছের পোনা ভেসে গেছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে খামার ও পুকুরের পাড়। বন্যায় কৃষি, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদে ক্ষতি হয়েছে ২ কোটি টাকার বেশি। মানুষের ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাটসহ অবকাঠামোগত ক্ষয়ক্ষতির এখনো নিরূপণ করা যায়নি।

পশ্চিম অলকা গ্রামের খামারি হোসেন বলেন, ‘মুহুরী নদীর সবচেয়ে বড় ভাঙনটি আমার বাড়ির মুখে পড়েছে। বাঁধ ভেঙে পানির ধাক্কায় খামার ভেঙে নিয়ে গেছে। খামারে থাকা ৮টি গরু বাড়ির ছাদে তুলে জীবন বাঁচিয়েছি। ’

একই গ্রামের মাহফুজ নামের একজন জানান, তাদের পুরো ঘর নিয়ে গেছে বানের জল। সব হারিয়ে নিঃস্ব তারা।

মধ্যম ধনীকুণ্ডায় মুহুরী নদীর ভাঙনে ঘর হারিয়েছেন বিমল চন্দ্র দাস। তিনি বলেন, ‘ভাঙনের সঙ্গে বন্যায় নিয়ে গেছে বসতঘর। কিছুই রক্ষা করা যায়নি। এখন থাকার জায়গাটুকু নাই। বসতঘরটি কীভাবে দাঁড় করাব, কিছুই বুঝতে পারছি না। ’

পরশুরামের পর জেলার অন্যতম ক্ষতিগ্রস্ত উপজেলা হলো ফুলগাজী। এখানে পানি ধীরে ধীরে নামতে শুরু করলেও কমছে না মানুষের দুর্ভোগ। টানা তিন দিন পানিবন্দি থাকার পর মানুষ ঘরে ফিরলেও স্বস্তির বদলে মিলছে চরম দুশ্চিন্তা। ভাঙা ঘর, নষ্ট আসবাব, বিশুদ্ধ পানির অভাব—সব মিলিয়ে শুরু হয়েছে বন্যা-পরবর্তী সংকটের নতুন অধ্যায়।  

অশ্রয়কেন্দ্র থেকে সহস্রাধিক মানুষ ফিরলেও অধিকাংশের ঘরে নেই রান্নার উপযোগী চুলা, শুকনো বিছানা কিংবা বিশুদ্ধ পানি। অনেক এলাকায় এখনো বিদ্যুৎ সংযোগ ফেরেনি। অন্যদিকে, কর্মহীন হয়ে পড়া প্রান্তিক মানুষের মধ্যে শুরু হয়েছে তীব্র খাদ্য সংকট। উপজেলা প্রশাসন ও বিভিন্ন সংগঠন কিছু সহায়তা দিলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল বলছেন বন্যার্তরা।

ফুলগাজীর বিস্তীর্ণ মাঠের ধান ও সবজির ক্ষেত পানিতে পচে গেছে। বন্যায় গবাদি পশু ও হাঁস-মুরগির ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। এতে অধিকসংখ্যক হাঁস-মুরগি মারা গেছে। পশুখাদ্য ও ঘাসের ক্ষতি হয়েছে প্রায় ৬৫ টন।

উপজেলার ১ হাজার ৩০৫টি পুকুর প্লাবিত হয়েছে, যার আয়তন প্রায় ২৭৮ হেক্টর। এতে আনুমানিক ৩ কোটি ৭৪ লাখ টাকা ক্ষতি হয়েছে বলে মৎস্য অফিস সূত্রে জানা গেছে। ফুলগাজী সদর ও মুন্সীরহাট এলাকার গ্রামীণ সড়কের সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে। প্রকৃত চিত্র পেতে আরও কিছুদিন সময় লাগবে বলে জানিয়েছেন উপজেলা প্রকৌশলী সৈয়দ আসিফ মুহাম্মদ।

ফুলগাজী বাজারের শ্রীপুর সড়কে নদীতে বিলীন হয়েছে অন্তত ১৫টি দোকান। দোকান হারিয়ে হতাশ ব্যবসায়ীরা এখনো নদীপাড়ে দাঁড়িয়ে জীবিকার পথ খুঁজছেন।

ব্যবসায়ী আবদুল গফুর বলেন, ‘এক দিনেই দোকান চলে গেল নদীতে। এত বছর ধরে এখানে বসে ব্যবসা করতাম। এখন সংসারের একমাত্র আয়ের উৎসটাও আর নেই। ’

ফুলগাজী উপজেলার গজারিয়া গ্রামের গৃহবধূ শাহানা আক্তার বলেন, ‘পানি নেমেছে, কিন্তু ঘরে ঢুকতে পারছি না। মাটিতে কাদা, নষ্ট খাবারের গন্ধে ছোট ছোট ছেলেমেয়েও অসুস্থ হয়ে পড়ছে। ’ দক্ষিণ শ্রীপুরের হাসান বলেন, ‘ঘরে ফিরেও আমরা ভালো নেই। পানি উঠে সবকিছুই নষ্ট করেছে। কবে নাগাদ স্বাভাবিক জীবনে ফেরব জানা নেই। ’

বসন্তপুরের কৃষক আমির হোসেন বলেন, ‘পানির নিচে সব ডুবে গেছে। ঘরে যাওয়ার উপায় নেই। ’

ফুলগাজী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ফারিয়া ইসলাম বলেন, ‘পানি নেমে গেলেও অনেক ঘর এখনো বসবাসের উপযোগী হয়নি। বিদ্যুৎ সংযোগও সবখানে চালু হয়নি। বিদ্যুৎ ও স্বাস্থ্য বিভাগসহ আমরা সমন্বিতভাবে কাজ করছি। ’

পরশুরামের ইউএনও আরিফুল ইসলাম বলেন, ‘ত্রাণ বিতরণ চলছে। ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা তৈরি করে ধাপে ধাপে পুনর্বাসনের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। ’

পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আকতার হোসেন মজুমদার বলেন, পানি পুরোপুরি নেমে যাওয়ার পর ক্ষতিগ্রস্ত বেড়িবাঁধ দ্রুত মেরামত করা হবে। সর্বমোট ৪১টি স্থানে বাঁধ ভেঙেছে ।

ফেনীর অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক ও বন্যা মনিটরিং টিমের প্রধান ফোকাল পারসন ইসমাইল হোসেন বলেন, ক্ষতিগ্রস্তদের সহযোগিতায় কাজ করছে জেলা প্রশাসন। পানি নেমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণের চেষ্টা চলছে। সার্বক্ষণিক পরিস্থিতি তদারকি করা হচ্ছে। পানি পুরোপুরি নেমে গেলে ক্ষয়ক্ষতির পূর্ণাঙ্গ চিত্র পাওয়া যাবে।

এসএইচডি/এমজেএফ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।