ঢাকা: ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধ সারা বিশ্বকে টালমাটাল করে দিয়েছে। বিশ্ব অর্থনীতির ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কিত গোটা বিশ্ব।
যেকোনো দেশের ওপর ইরান-ইসরায়েলের যুদ্ধের প্রতিক্রিয়া হবে অনেক বেশি। এখন আমরা বিশ্বায়নের যুগে বাস করছি। এই বিশ্বায়নের সময় কোনো যুদ্ধ থেকেই আমরা কার্যত মুক্ত থাকতে পারি না। বিশ্বের বিভিন্ন দেশগুলো আমরা দেখছি যে ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধের প্রেক্ষিতে তারা আগাম প্রস্তুতি গ্রহণ করতে শুরু করেছে, সতর্কতা অবলম্বন করতে শুরু করেছে। নতুন কৌশল গ্রহণ করছে রাজনীতি এবং অর্থনীতিতে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন সম্ভাব্য পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য কৌশল কমিটি গঠন করেছে। ভারতের পার্লামেন্টে করা হয়েছে মনিটরিং সেল।
পাকিস্তান ইতোমধ্যে ইরান সীমান্ত বন্ধ করে দিয়েছে। যুদ্ধ মোকাবিলা নতুন করে কৃচ্ছ্র নীতির পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে তাদের মন্ত্রিসভার বৈঠকে। এই প্রেক্ষিতে তারা জ্বালানি তেল সাশ্রয়, বিদ্যুৎ সাশ্রয় সহ একগুচ্ছ নীতি এবং কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। বাংলাদেশ সরকারের পরিকল্পনা কী? সরকার কেন এনিয়ে সর্বদলীয় বৈঠক করছে না। কথা বলছে না ব্যবসায়ীদের সঙ্গে?
এর আগে রাশিয়া যুদ্ধের প্রভাবে বিশ্ব অর্থনীতি সংকটে পড়ে। বাংলাদেশে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব পড়েছিল ব্যাপকভাবে। অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন যে ইরান-ইসরায়েলের যুদ্ধের প্রভাব আমাদের অর্থনীতিতে আরও বেশি পড়বে। ইরানের প্রাকৃতিক গ্যাস উৎপাদন কেন্দ্রে হামলা হলে কিংবা সমুদ্রপথ হরমুজ প্রণালী বন্ধ হয়ে গেলে তার প্রভাব শুধু মধ্যপ্রাচ্যের মধ্যেই সীমিত থাকবে না, বরং তা বিশ্ব অর্থনীতিতে এবং জ্বালানি সরবরাহ ব্যবস্থা প্রচণ্ড নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। বাংলাদেশ এই প্রভাবের কারণে সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
হরমুজ প্রণালী বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি সামুদ্রিক বাণিজ্য পথ। এই পথ দিয়ে প্রতিদিন প্রায় দুই কোটিরও বেশি ব্যারেল তেল পরিবাহিত হয়, যা গোটা বিশ্বে তেল সরবরাহের ২০ শতাংশের কাছাকাছি। তাই এই পথ যদি সামাজিকভাবে বন্ধ হয়, তাহলে আন্তর্জাতিক তেলের বাজার টালমাটাল হতে বাধ্য।
১৯৭৩ সালে আরব-ইসরায়েলের যুদ্ধ বা ২০১৭ সালে সৌদি আরবের তেল স্থাপনা ইসরায়েলের হামলার পর বিশ্ববাজারে তেলের দাম বেড়েছিল লাগামহীনভাবে। তারচেয়েও বাড়বে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করছেন বিশেষজ্ঞরা। ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধ বাংলাদেশের অর্থনীতির উপর কি কি প্রভাব ফেলতে পারে- আসুন দেখে নেওয়া যাক-
জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধির শঙ্কা: বাংলাদেশ জ্বালানি আমদানি নির্ভর একটি দেশ। দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদনের একটি বড় অংশ গ্যাস এবং তেল নির্ভর। বিশেষত এলএনজি এবং পরিশোধিত জ্বালানি তেল আমাদের দেশের চাহিদার একটি বিরাট অংশ মেটায়। আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম বাড়লে তাতে বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ যেমন বাড়ে, তেমনি শিল্প উৎপাদন, পরিবহন, কৃষি ও খুচরা বাজারে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। এই ধরনের ঘটনা যদি ঘটে তাহলে আমার সামগ্রিক মুদ্রাস্ফীতি বেড়ে যাবে। মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়বে।
বাংলাদেশ মধ্যপ্রাচ্যের দেশ কাতার ও ওমান থেকে এলএনজি আমদানি করে থাকে। এসব দেশের একাধিক কোম্পানির সঙ্গে বাংলাদেশের দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি আছে। কাতার থেকে এলএনজি আমদানি একমাত্র পথ হরমুজ প্রণালী। জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন হরমুজ প্রণালী ইরান দীর্ঘ মেয়াদে বন্ধ করে দিলে বাংলাদেশে এলএনজি আমদানির স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত হবে। তাতে গ্যাস সরবরাহের প্রভাব পড়বে। এমনিতেই দেশের শিল্পকারখানাগুলোতে গত কয়েক বছর ধরে বারবার গ্যাসের দাম বাড়ানো হচ্ছে। তীব্র গ্যাস সংকটে ভুগছে দেশের শিল্পখাত। এরকম পরিস্থিতিতে এলএনজির ব্যয় বাড়লে তার প্রতিক্রিয়া হবে ব্যাপক। ফলে শিল্পোৎপাদন ব্যাহত হবে, সংকটে থাকা শিল্পখাত আরও বড় ধরনের সংকটের মধ্যে পড়বে। জিনিসপত্রের দাম বাড়বে হুহু করে।
দারিদ্র বাড়বে: এবার বাজেটে প্রবৃদ্ধি হার নির্ধারণ করা হয়েছে তুলনামূলক ভাবে অনেক কম। অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, দুই বছর ধরে দেশে উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিরাজ করছে। এখন ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধের কারণে শেষ পর্যন্ত ভোগান্তি বাড়বে নিম্ন আয়ের মানুষেরই। বেড়ে যাবে দারিদ্র্য। এর মধ্যে বিশ্বব্যাংক পূর্বাভাস দিয়েছে চলতি বছরে চরম দরিদ্র মানুষের সংখ্যা ৩০ লাখ পর্যন্ত বেড়ে যেতে পারে। এই যুদ্ধের প্রভাবে সেই সংখ্যা আরও বাড়বে বলেই অনেকে মনে করছেন। অর্থনীতিতে এমনিতেই একটি স্থবিরতা চলছে। ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধের ফলে অর্থনীতির সংকোচনের ধারা আরও বেড়ে যাবে। বাংলাদেশের সামগ্রিক উন্নয়ন কর্মকাণ্ড মুখ থুবড়ে পড়বে। বিশেষ করে হরমুজ প্রণালী বন্ধ হলে বিশ্বের সামগ্রিক বাণিজ্যিক ভারসাম্য ক্ষুণ্ন হতে পারে। ফলে একটা বড় ধরনের সংকটে পড়বে বাংলাদেশের রপ্তানি নির্ভর অর্থনীতি। তৈরি পোশাক খাত বাংলাদেশের বৈদেশিক আয়ের অন্যতম উৎস। পণ্য পরিবহণে বিলম্ব হলে পণ্য সরবরাহ ব্যাহত হতে পারে। ফলে ক্রয়াদেশ বাতিল হতে পারে, মূল্য ছাড় দিতে বাধ্য হতে পারে বাংলাদেশের বিক্রেতারা এবং বাজার হারানোর মতো পরিস্থিতিও তৈরি হতে পারে। তাছাড়া জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধি হলে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতামূলক দামে পোশাক রপ্তানি দুরূহ হয়ে পড়বে।
শ্রমবাজার ও প্রবাসী আয়ের ওপর নেতিবাচক প্রভাব: মধ্যপ্রাচ্য বাংলাদেশের প্রধান শ্রমবাজার। বাংলাদেশের অভিবাসীদের গন্তব্যস্থল মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো। অভিবাসন বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, ইরান ও প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়লে এই অঞ্চলে বাংলাদেশের শ্রমিকদের কর্মসংস্থান হুমকির মুখে পড়তে পারে। ইতোমধ্যেই ইরানে ১৪০০ বাঙালির চাকরি হারিয়েছেন। শুধু চাকরি নয়, তাদের জীবন সংকটাপন্ন। এই যুদ্ধের ব্যাপ্তি বাড়তে থাকলে এ ধরনের ঘটনা আরও ঘটবে। জর্ডানে অনেক বাংলাদেশি কাজ করে। সেখানকার শ্রম বাজারেও নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করবে। এই যুদ্ধে যেভাবে যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলকে সমর্থনে এগিয়ে এসেছে এবং ইরান মুসলিম দেশগুলোর সহায়তা চাইছে, তাতে এই যুদ্ধের সঙ্গে আঞ্চলিক দেশগুলো জড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। সেটি হলে মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশেও কাজের সংকট দেখা দিতে পারে। তাতে রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয় কমে যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে। হরমুজ প্রণালীর আশেপাশে ওমান বাংলাদেশের প্রবাসী আয়ের ষষ্ঠ বৃহত্তম উৎস। যুদ্ধ পরিস্থিতিতে মধ্যপ্রাচ্যের নির্মাণ খাত, পরিষেবা খাত, আবাসন খাতের কার্যক্রম স্থগিত অথবা বন্ধ হয়ে যেতে পারে। ফলে প্রবাসী শ্রমিকরা হঠাৎ করে কাজ হারানোর ঝুঁকিতে পড়বেন। এই যুদ্ধ চলতে থাকলে অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে সংশ্লিষ্ট দেশগুলো নতুন করে কর্মী নেয়া বন্ধ করে দেবে তা বলাই বাহুল্য। ফলে বিদেশি আমাদের অভিবাসন বড় ধরনের ঝুঁকিতে পড়বে।
বাড়বে বিমান পরিবহন ব্যয়: গত শুক্রবার ইসরায়েল হামলার পরপরই বাণিজ্যিক বিমান চলাচলের ওপর তাৎক্ষণিক প্রভাব দেখা দিচ্ছে। ইরানের আকাশ দিয়ে চলা বিমানের সংখ্যা প্রায় শূন্যে নেমে এসেছে। ইউরোপ থেকে এশিয়া আগামী যাত্রীবাহী বিমানগুলো ইরানকে এগিয়ে দুপাশ দিয়ে উড়ে যাচ্ছে এখন। অনেক বিমান মাঝ আকাশ থেকে পথ বদলে ইরানের আকাশ ছেড়ে অন্য করিডর ব্যবহার করছে। বিমানগুলোর এই গণহারে পথ পরিবর্তন এবং ইরানের আকাশপথ এড়িয়ে চলার ফলে আন্তর্জাতিক বিমান চলাচলে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। বাংলাদেশের কিছু বিমান ইরানের আকাশ সীমা ব্যবহার করে ফলে এই বিমানগুলোর পরিবহন খরচ বেড়ে যাবে। এছাড়া মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতেও পরিবহন ব্যয় বাড়তে পারে। এমনিতেই জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির কারণে বিমান পরিবহনের ব্যয় বাড়বে। এটির আমাদের অর্থনীতিতে রপ্তানি বাণিজ্যের ওপর যেমন প্রভাব পড়বে, তেমনি অভিবাসী এবং অন্যান্য বিদেশগামী যাত্রীদের ভ্রমণ ব্যয় বেড়ে যেতে পারে।
আন্তর্জাতিক সহায়তা কমে যাবে: এই যুদ্ধের কারণে বিশ্ব কূটনীতিকে নতুন করে মেরূকরণ ঘটবে। এমনিতেই বাংলাদেশে মার্কিন সহায়তা (US AID) বন্ধ হয়ে গেছে। যুক্তরাজ্য বাংলাদেশে সহায়তা কমিয়েছে উল্লেখযোগ্য ভাবে। সুইজারল্যান্ড সহ কয়েকটি ইউরোপের দেশ বাংলাদেশে নতুন সহায়তা বন্ধ রেখেছে। এই যুদ্ধের কারণে আন্তর্জাতিক সহায়তা অনেক কমে যাবে। এর ফলে স্বাস্থ্য, শিক্ষার মতো উন্নয়ন প্রকল্পগুলো বন্ধ হয়ে যেতে পারে।
রোহিঙ্গা সংকট বাড়বে: এরকম যুদ্ধের ফলে আন্তর্জাতিক সংস্থা গুলো ইরান-ইসরায়েল এবং গাজা এলাকায় ত্রাণ এবং আন্তর্জাতিক সহায়তার জন্য মনোযোগী হবে। ফলে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য আন্তর্জাতিক সহায়তা কমে যাবে। রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে মনোযোগ দেবে না বিশ্ব।
বিশ্ব কূটনীতিতে ঝুঁকিতে পড়বে বাংলাদেশ: ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যেভাবে সরাসরি ইসরায়েলকে সমর্থন দিচ্ছে, তাতে বিশ্ব কূটনীতিতে নতুন মেরূকরণ সৃষ্টি হবে। মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশকেই যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েল পক্ষভুক্ত করার চেষ্টা করবে। এর ফলে বাংলাদেশ একটি নাজুক এবং স্পর্শকাতর কূটনৈতিক পরিস্থিতিতে পড়বে।
এরকম বহুমাত্রিক সংকট সৃষ্টি করবে এই ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধ। সবচেয়ে বড় কথা হলো এই যুদ্ধে সম্ভাব্য ঝুঁকিগুলোতে চিহ্নিত করে পদক্ষেপ গ্রহণ করা সরকারের এখন দায়িত্ব। যেহেতু এটি অন্তর্বর্তী সরকার সেজন্য দ্রুত এ ব্যাপারে সকল রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বৈঠকের মাধ্যমে একটি কর্ম কৌশল নির্ধারণ করা অত্যন্ত জরুরি। পাশাপাশি প্রয়োজন ব্যবসায়ীসহ অংশীজনদের নিয়ে অবিলম্বে করণীয় নির্ধারণ।
অদিতি করিম, নাট্যকার ও কলাম লেখক
ইমেইল: auditekarim@gmail.com