আবহমান বাংলার সব শিল্পসম্মত গৃহস্থালি সামগ্রী, সৌখিন পণ্যসম্ভার একসঙ্গে, এক সারিতে।
বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণজুড়ে পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে শুরু হয়েছে দশ দিনব্যাপী বৈশাখী মেলা।
দিনাজপুরের ফুলবাড়ি উপজেলা থেকে আসা কারুশিল্পী ধীরেন্দ্রনাথ সামন্ত এক অবাক করা তথ্য দিলেন। এই ডিজিটাল আধিপত্যের যুগেও তাদের বানানো বাঁশের পণ্যের চাহিদা নাকি বাড়ছে। এ সম্পর্কে তার বয়ান, আমার বাপ-দাদা চৌদ্দ পুরুষের ব্যবসা এটি। আমি নিজে পঞ্চাশ বছর ধরে বাঁশের পণ্য তৈরি করছি। আগে আমাদের দিনাজপুরে একটিও দোকান ছিল না। আমরা ঘুরে ঘুরে পণ্য বিক্রি করতাম। এখন আমাদের জেলাতেই ২২টি দোকান আছে বাঁশপণ্যের।
‘তবে যুগের পরিবর্তনে চাহিদারও কিছু পরিবর্তন হয়েছে। যেমন আগে আমরা বাঁশের চালনি থেকে ঝাড়ু এসব তৈরি করতাম। এখন নানা ধরনের কসমেটিক্স বক্সও তৈরি করছি। শহুরে ক্রেতাদের কাছে এসবের ভালো চাহিদা আছে। আসলে মানুষের অর্থনৈতিক উন্নতি হওয়ার সঙ্গে সৌখিন জিনিসের প্রতি আগ্রহ বেড়েছে। আর এসব পণ্য তো ঘর গৃহস্থালির কাজেও ব্যবহার করা যায়। ’
ধীরেন্দ্রনাথ সামন্তের বক্তব্য শুনে খানিকটা খটকা লাগলো। সঞ্জয় কুমার পালের কথাতে ধোঁয়াশা কিছুটা দূর হলো। শখের হাঁড়ি নিয়ে বসেছিলেন রাজশাহীর পবা থেকে আসা এই শিল্পী।
‘দ্যাখেন আগে আমরা যে ধরনের পণ্য তৈরি করেছি সেগুলো ঘর গৃহস্থালির কাজে সব সময় ব্যবহৃত হতো। এখন কি তা হয়? এখন তো সব জায়গায় প্লাস্টিক পণ্যের জয়। আমাদের বানানো পণ্য মানুষ নিচ্ছে শখে। হয়তো ঘরে সাজিয়ে রাখতে। কিন্তু যদি দৈনন্দিন কাজে সেই পণ্য ব্যবহৃত না হয় তাহলে বিক্রি বাড়বে কীভাবে আর আমরাইবা এই পূর্ব পুরুষের কাজ ধরে রাখবো কীভাবে। ’
‘এই যেমন ধরেন আমার কাছে মাটির হাঁড়িসহ অন্যান্য পণ্যের দাম আছে দশ টাকা থেকে এক হাজার টাকা পর্যন্ত। এখন যে হাঁড়ির দাম এক হাজার টাকা তা ইচ্ছে করলেই আমি কমাতে পারবো না। কিন্তু একই কাজ হয়তো একটি একশো টাকা দামের প্লাস্টিক পণ্যে হয়ে যাচ্ছে। ’
তবে এতসব নিয়ে মাথা ঘামাতে রাজি নন সন্ধ্যা রানি। তিনি এক মনে বাহারি হাত পাখা তৈরি করছিলেন। লাল-হলুদ নানা রঙের কাপড়ের উপর দারুণ মনকাড়া সব নকশার কাজ। তারও চৌদ্দ পুরুষের কাজ এটি। এখানে ভিড় লেগেই আছে। রং বাহারি এসব হাতপাখা টানছে মেলায় দর্শনার্থীদের। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার শিক্ষার্থী শামীম, অরণীরা দলবেঁধে এসেছিলেন নিজেদের শিক্ষার অনুষঙ্গ খুঁজতে। সন্ধ্যা রানির কাছ থেকে বেশ দামাদামি করে দুটো হাত পাখা নিয়ে গেলেন তারা।
তাদের ভাষ্য, আমরা তো নিজেদের শিক্ষার তাড়না থেকে এসব কিনছি। অনেকে কিন্তু শুধু বাতাস খাওয়ার জন্য কিনে নিয়ে যাচ্ছে। ইলেকট্রিসিটি চলে গেলে এগুলো দারুন কাজে লাগে। এমন সুন্দর জিনিস থাকলে ঘরটিও শিল্পসম্মত হয়ে ওঠে।
এই দোকানে স্থান পেয়েছে রঙিন কাঠের পুতুলও। সন্ধ্যা রানির স্বামী বানান এসব। তিনি এসব পণ্য নিয়ে জাপান, নেপালেও প্রদর্শনী করে এসেছেন। সেখানকার মানুষের এসবের ব্যাপারে ব্যাপক সাড়া। সন্ধ্যা রানিনী, আরতী সূত্রধর তাই আশাবাদী। তারা বিশ্বাস করেন তাদের এই পরম্পরার শিল্প হারিয়ে যাবে না।
চোখে সেই একই স্বপ্ন নিয়ে এই বৈশাখী মেলায় নিজেদের পণ্য তুলে ধরছেন মুন্সীগঞ্জের টুঙ্গীবাড়ির শীতলপাটির কারিগর সবিতা মুদী, রাজশাহীর মৃৎশিল্পী সুবোধ কুমার পাল। সবার একটাই অভিযোগ, মানুষের মধ্যে লোকায়ত এসব পণ্যের চাহিদা থাকলেও মাঝখানে বাধার দেয়াল তুলছে প্লাস্টিক।
এ ব্যাপারে মেলার সহ-আয়োজক বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প করপোরেশনের সহকারী মহাব্যবস্থাপক জেসমিন নাহার বাংলানিউজকে বলেন, এটা ঠিক প্লাস্টিকের কারণে এসব গ্রামীণ শিল্প মার খাচ্ছে। তবে আমরাও থেমে নেই। এ ধরনের আয়োজনের মাধ্যমে আমরা শহরের মানুষের কাছে এসব পণ্য তুলে ধরার চেষ্টা করছি। সবচেয়ে আশার কথা ভালো সাড়া পাওয়া যাচ্ছে।
মেলায় আরও স্থান পেয়েছে কাপড়, লোকায়ত বাদ্যযন্ত্র, খাবারের দোকান। সোনারগাঁ উপজেলার লাঙ্গলবন্দের পলাশ বিশ্বাস তার মুড়ি, মুড়কি, কদমা, বাতাসার দোকান নিয়ে বসেছিলেন। ভালোই খাওয়া দাওয়া চলছে এখানে। এরকম ২০০ দোকানে গ্রামীণ পণ্যের সমাহারে জমজমাট বাংলা একাডেমির বৈশাখী মেলা প্রাঙ্গণ। আছে নাগরদোলার ব্যবস্থাও।
ফেরার পথে গেটেই আসগর মিয়া বায়োস্কোপ নিয়ে বসেছিলেন। বায়োস্কোপের খেল দেখার আহ্বান তার। এখানে অল্পবয়সীদের সঙ্গে ক বয়স্করাও আসেন শখে। তার আক্ষেপ আবারো যদি পুরনো দিন ফিরে আসতো। যদি মানুষ শুধু শখে না, প্রয়োজনের তাগিদেই এসব জিনিস দেখতো! কিনতো!।
বাংলাদেশ সময়: ১৬২৫ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৬, ২০১৯
আরএস/এএ