এক মোহনায় সমবেত বাঙালির কন্ঠে কন্ঠে এই চিরায়ত সুর। স্বতঃস্ফূর্ত প্রাণের আবেগে আর উচ্ছ্বাসে বরণ করে নিলো নতুন স্বপ্ন, নতুন প্রত্যাশায় নতুন দিন।
নকশা তোলা পাঞ্জাবি, বর্ণিল ফতুয়া আর আলপনাময় শাড়িতে ব্যঞ্জময় অসাম্প্রদায়িক বাঙালির এই উৎসবে অগণন মানুষ নেমে এলো পথে। এ যেন এক উৎসবের নগর।
গোটা ময়মনসিংহ জেলাজুড়েই প্রাণের উচ্ছ্বাসের কোনো কমতি নেই। সবার মনেই আবাহন করেছে নতুন বছর। ঘর-দূয়ার ছেড়ে আসা হাজারো মানুষের অনিবার্য ঠিকানা হয়ে উঠেছে ব্রহ্মপুত্র নদছোঁয়া জয়নুল উদ্যান, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) বোটানিক্যাল গার্ডেন বা নগরের বিপিন পার্ক।
পুরনো মলিন মন মুছে আলোর পথে চলার শপথ নিয়েই শিশু-বুড়ো, তরুণ-তরুণী-যুবা সবাই মেতেছে বৈশাখী আনন্দে। ব্রহ্মপুত্র নদের ওপারে বয়স ভুলে বয়স্কদের ছুটাছুটি বা তরুণ-তরুণীদের প্রাণময় আড্ডায় ধরা দেয় নতুনরূপে।
শিক্ষা ও সংস্কৃতির প্রবেশদ্বার ময়মনসিংহের আকাশে নতুন বছরের ফুটন্ত সকাল বেরিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গেই বৈশাখী সাজে ললনাদের পদচারণায় মুখর হয়ে উঠে জয়নুল উদ্যান। তাদের কন্ঠেও মানবতার জয়গান। সব অশুচি মুছে দিয়ে অমঙ্গল দূর করার আওয়াজ। সূর্যের ভিন্নতায় ফেলে আসা শিকড় খোঁজার এই উৎসবে বিলুপ্তপ্রায় নানা কৃষ্টি-সংস্কৃতির মেলবন্ধন ঘটায়। নাগরদোলা, চরকি বা মাটির হাঁড়ি-পাতিলসহ হরেক রকমের জিনিসপত্রে আলিঙ্গণ করে গ্রামীণ জীবনকে।
কদর বাড়ায় অনাদরে থাকা মৃৎশিল্পকে। মুড়ি-মুড়কি, মিষ্টি, পিঠা-পায়েসের ধুম পড়ে। মাটিতে চাদর বিছিয়ে উদ্যমী তারুণ্য খেয়েছে দলবেঁধে পান্তা-শুটকি ভর্তায়।
প্রতিটি বর্ষবরণে শুধু উৎসব আয়োজন না তা বিশ্লেষণেও জাতির প্রবণতা লক্ষণীয়। গণমাধ্যমেও বাংলা নববর্ষ বিশাল ক্যানভাসে আলোচনা সভা, রং কালারফুল।
বাংলা নববর্ষের পক্ষপাতিত্ব রয়েছে সংস্কৃতির অগ্রযাত্রার পথযাত্রায়। একইসঙ্গে পহেলা বৈশাখ হলো অপসংস্কৃতির আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিবাদ।
কবি ও সাহিত্যিকরা বলছেন, সাংস্কৃতিজ্ঞ মানুষ, গবেষক, ইতিহাসবিদ পণ্ডিতদের লেখা-রেখায় বাংলা নববর্ষ বাংলার সমাজ জীবনের ইতিবৃত্ত সমৃদ্ধ থেকে সমৃদ্ধতর হচ্ছে। জাতি হিসেবে বাঙালির বৈশিষ্ট্য হচ্ছে আপন সংস্কৃতির প্রতি পরম গর্ব। সংস্কৃতির উৎসব ও স্বরূপের পর্যায় সরণি নিয়ে গবেষণা তাই চলমান।
পহেলা বৈশাখে বাড়তি আকর্ষণ হয়ে দাঁড়ালো মঙ্গল শোভাযাত্রা। কয়েক দশকের ধারাবাহিকতায় রোববার (১৪ এপ্রিল) সকাল সাড়ে ৮টায় শহরের মহাজারাজা রোড এলাকার মুকুল নিকেতন উচ্চ বিদ্যালয় প্রাঙ্গণ থেকে বের করা হয়েছে জেলা সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের উদ্যোগে মঙ্গল শোভাযাত্রা।
এতে স্থান পায় বাঙালির ঐতিহ্যের শিল্পকর্ম কুড়েঘর, মাছ ধরা, পাখ-পাখালি ও বিভিন্ন প্রাণীর প্রতিকৃতি প্রভৃতি। নগরের প্রধান প্রধান সড়ক ঘুরে শেষ হয় জয়নুল উদ্যানের বৈশাখী মঞ্চে। সমাজকল্যাণ প্রতিমন্ত্রী শরীফ আহমেদ শোভাযাত্রার উদ্বোধন করেন।
এসময় ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশনের প্রশাসক মো. ইকরামুল হক টিটু, জেলা পরিষদ প্রশাসক ইউসুফ খান পাঠান, জেলা পুলিশ সুপার (এসপি) শাহ আবিদ হোসেন, জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট মোয়াজ্জেম হোসেন বাবুল প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
ময়মনসিংহ জেল সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের আহ্বায়ক অধ্যাপক আমির আহমেদ চৌধুরী রতন বাংলানিউজকে বলেন, আবহমান গ্রাম বাংলার উৎসব আমাদের ফেলে আসা শিকড়ের কথা মনে করিয়ে দেয়।
‘শৈশবে মেলায় গিয়ে হরেক রকমের জিনিস কেনা, মুড়ি-মুড়কি খেতে খেতে বাড়ি ফেরার স্মৃতি আজো আন্দোলিত করে হৃদয়-মনকে। বাঙালিত্ব উদযাপনের পাশাপাশি বৈশাখ ধর্মীয় উগ্রবাদীদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের হাতিয়ার। ’
বাংলাদেশ সময়: ১৪৩৪ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৪, ২০১৯
এমএএএম/আরবি/