আজ শীতল পাটি বিশ্বনন্দিত। কিন্তু শত বছর ধরে এই গ্রামে শীতল পাটি তৈরি হলেও নেই কোনো স্বীকৃতি।
সারাবছর যেমন-তেমন গেলেও গরমকে ঘিরে এই গ্রামের শীতল পাটির বেশ ভালো কদরই থাকে। যদিও কাঁচামালের দাম বৃদ্ধি আর পুঁজির অভাবে অনেকেই সরে গেছেন পাটি তৈরির কাজ থেকে।
গ্রাম ঘুরে দেখা গেছে, বর্তমানে গ্রামের ২০টির মতো পরিবারের নারী-পুরুষ সবাই মিলে পাটি বোনার কাজে ব্যস্ত সময় পার করছেন। ঘরের বারান্দা আর উঠোনজুড়ে বিরামহীনভাবে পাটির সুনিপুণ নির্মাণকাজ চলছে। তারপরও যেন খুঁজে পাওয়া যায় না পুরনো দিনের গল্পের সেই জৌলুস।
পাটিশিল্পের ইতিহাস-ঐতিহ্য নিয়ে গ্রামের বাসিন্দা পঞ্চাশোর্ধ ইন্দ্রোজিত কুমার পাটিকর বলেন, আগে হেলেঞ্চা গ্রামের পুরোটা জুড়েই পাটির কাজ হতো, যা তিনি জন্মের পর থেকেই দেখে এসেছেন। বাবা-দাদার কাছ থেকে জেনেছেন তাদের পূর্ব-পুরুষরাও এ কাজ করতেন। আর কাজ করতে করতেই নামের শেষে পাটিকর শব্দটি লেগে গেছে। তার স্ত্রী রেখা রানী পাটিকর বলেন, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সবকিছুর দাম বেড়েছে, কদরও বেড়েছে অনেকের। তবে ভাগ্যের বদৌলতে গ্রামের পাটিকরদের কোনো উন্নয়ন হয়নি। আর তাই কমতে কমতে এখন গ্রামের প্রায় ২০টির মতো পরিবার পাটি বুনে এখন রোজগার করছে।
তিনি বলেন, যারা করছেন তারা তো আছেন, তবে বাকিরা পেশা পাল্টেছেন নয়তো বাপ-দাদার ভিটে-বাড়ি বেচে অন্যত্র চলে গেছেন।
এদিকে বাকেরগঞ্জের শুধু হেলেঞ্চা গ্রাম নয়, বরিশালের মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলা, ঝালকাঠির রাজাপুর-কাঠালিয়া, পিরোজপুরের কাঠালিয়া উপজেলার বেশ কিছু গ্রামে শীতল পাটির কাজ এখনও হয় বলে জানান সবিতা রানী নামের অপর এক পাটিকর।
বংশ পরম্পরায় এক জায়গার পাটিকরদের সঙ্গে অন্য জায়গার পাটিকরদের পরিবারের সদস্যদের বিয়েও হয় জানিয়ে তিনি বলেন, সরকারি সহায়তাবিহীন শীতল পাটি তৈরি করে আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়াটা কঠিন। পরিবারের সবাই শ্রম দিয়ে পাটি বানিয়ে বিক্রি করে যা আয় হয় তা দিয়ে সন্তানদের লেখাপড়ার খরচ দিয়ে খেয়ে বেঁচে থাকাটাই কঠিন হয়ে যায়।
নিপুণ হাতে কারুকার্যময় পাটির বিষয়ে সুমতি বালা বলেন, ৪ হাত/৫ হাত একটি পাটি একজনের বুনতে আটদিন সময় লাগে। তবে এ কাজে পরিবারের আরও ২/৩ সদস্য মিলে তাকে সহায়তা করেন।
তিনি জানান, পাটি বানাতে হলে প্রথমে বাঁশের কঞ্চির মতো দেখতে পাইত্রা নামের এক ধরনের উদ্ভিদ বা গাছ লাগে। যা স্থানীয়ভাবে চাষও করা হয়। সেই পাইত্রা কিনে এনে প্রথমে তোলায় (চিকন করে কাটা) এরপর হলাই বের করা হয় (ভেতরের সাদা অংশ ফেলে দেওয়া) এবং পরবরর্তীতে হাতে ভেঙে পাটি বোনার মূল উপাদান বেতি বের করা হয়, যা সিদ্ধ করে ধুয়ে শুকানোর পর পাটি বোনার কাজ শুরু করা হয়।
তিনি বলেন, এক্ষেত্রে ৫শ’ টাকার পাইত্রা গাছের বেতি লাগে একটি ৪/৫ হাত পাটির জন্য। আর অনুসঙ্গসহ শ্রম দিয়ে প্রায় হাজার টাকার মতো খরচ করা পাটি ১২ থেকে ১৪ শ’ টাকার বিক্রি হয়। তবে প্লাষ্টিকের পাটি বের হওয়ার পর থেকে কদর অনেকটা কমে গেছে। তাই একটু বাড়তি দামের আশায় বাড়ির পুরুষরাই এখন শহরে ঘুরে ঘুরে বিক্রি করেন শীতল পাটি। তবে সব পরিশ্রম শেষে একটি পাটি বেঁচে তেমন কিছুই থাকে না, দিন এনে দিন খাওয়ার মতো অবস্থা হয়ে যায়।
স্থানীয় ব্যবসায়ী সৌতম বিশ্বাস জানান, পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে বাকেরগঞ্জের পাটিশিল্প এখন বিপন্ন হতে চলেছে। দৃষ্টিনন্দন এ শীতল পাটি তৈরির পেছনে রয়েছে যাদের নিপুণ হাত, সেই পাটিকরদের চোখেমুখে সর্বদা বিরাজ করে বিষণ্নতার ছাপ।
বাংলাদেশ সময়: ০৮৪৩ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৩, ২০১৮
এমএস/আরআর