২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের বিপ্লবের সফলতার পেছনে প্রবাসীদের ভূমিকা ছিল উল্লেখযোগ্য। আন্দোলনের এক পর্যায়ে রেমিট্যান্স শাটডাউন করে তারা বিপ্লবকে ত্বরান্বিত করেন।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কোটা সংস্কারের দাবি সরকার উপেক্ষা করলে প্রবাসীরা রেমিটেন্স পাঠানো বন্ধ করতে শুরু করেন। এমন পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগ সরকারের আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক হাত জোড় করে প্রবাসীদের কাছে রেমিটেন্স পাঠাতে অনুরোধ করেন। কিন্তু দেশের পরিস্থিতি অনুধাবন করে প্রবাসীরা তাদের সিদ্ধান্তে অটল ছিলেন। ফলে জুন-জুলাই মাসে প্রবাসী আয়ের প্রবাহ প্রায় ২৮ শতাংশ কমে যায়, যা আন্দোলনের সময় সরকারের ওপর উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক চাপ সৃষ্টি করে।
কোটা সংস্কার আন্দোলন জুনের শেষ দিকে তীব্র আকার ধারণ করলে এবং তা ধীরে ধীরে সরকার পতনের দিকে অগ্রসর হলে এই আয় হ্রাসের প্রবণতা শুরু হয়। প্রথমদিকে একে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বা মৌসুমি প্রভাব হিসেবে দেখা হলেও পরে স্পষ্ট হয়, এটি ছিল প্রবাসীদের সংগঠিত আর্থিক প্রতিবাদ। মালয়েশিয়া, সৌদি আরব, কাতার, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন বড় প্রবাসী গন্তব্য থেকে অনেকে অর্থ পাঠানো বন্ধের সিদ্ধান্ত নেন। তাদের যুক্তি ছিল, ‘দেশে নাগরিক অধিকার না থাকায় রেমিট্যান্স পাঠানো যাবে না। ’ এ ধরনের আর্থিক অবরোধ আন্দোলনের সময় সরকারকে বাড়তি চাপের মুখে ফেলে।
শুধু অর্থনৈতিক দিকেই নয়, রাজনৈতিক সচেতনতার ক্ষেত্রেও প্রবাসীদের সক্রিয়তা লক্ষ্য করা যায়। বিভিন্ন দেশের প্রবাসীরা বিদেশি গণমাধ্যম ও মানবাধিকার সংস্থার কাছে দেশের পরিস্থিতি তুলে ধরেন। লন্ডন, নিউইয়র্ক, টরন্টো, রিয়াদসহ কয়েকটি শহরে তারা ছোট আকারের মানববন্ধন ও বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করেন।
এছাড়া, কোটা সংস্কার আন্দোলনের প্রতি সংহতি জানিয়ে সংযুক্ত আরব আমিরাতে বিক্ষোভ করায় ৫৭ বাংলাদেশিকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেন দেশটির একটি আদালত। তাদের মধ্যে তিনজনকে যাবজ্জীবন, ৫৩ জনকে ১০ বছর এবং বাকি একজনকে ১১ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। আগস্টে ফ্যাসিস্ট সরকারের পতন হওয়ার পর অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের অনুরোধে গ্রেপ্তার বাংলাদেশিদের ক্ষমা করে আরব আমিরাত সরকার।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, ২০২৪ সালের জুলাই অভ্যুত্থানের পেছনে প্রবাসীদের নীরব ভূমিকা ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুঘটক। তারা শুধু অর্থনৈতিক দিক থেকে নয়, রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক পর্যায়েও পরিবর্তনের পক্ষে কাজ করেছেন। আন্দোলনের উত্তপ্ত সময়ে বহু প্রবাসী সচেতনভাবে রেমিট্যান্স পাঠানো বন্ধ করে সরকারের অর্থনৈতিক প্রবাহে চাপ সৃষ্টি করেন, যা আন্দোলনের গতি বাড়িয়ে দেয়। একই সঙ্গে বিদেশি গণমাধ্যম ও মানবাধিকার সংস্থার কাছে দেশের পরিস্থিতি তুলে ধরেন, বিভিন্ন শহরে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ আয়োজন করেন। তাদের এই কৌশলগত পদক্ষেপ আন্দোলনের ফলাফলে সরাসরি প্রভাব ফেলে।
প্রবাসীদের এমন ভূমিকা নিয়ে পরে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসও মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, আমাদের প্রবাসী শ্রমিকরা দেশ গড়ার কারিগর। জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানে তারা বড় ভূমিকা পালন করেছিল। আমরা তাদের কাছে সবসময় কৃতজ্ঞ থাকবো।
জুলাই-আগস্টের আন্দোলনে প্রবাসী বাংলাদেশি সাংবাদিকদের ভূমিকাও ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তারা দূর প্রবাসে থেকেও দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও সরকারের দমননীতির খবর আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে পৌঁছে দেন। বিশেষ করে পিনাকী ভট্টাচার্য, কনক সারোয়ার, ইলিয়াস হোসেন, জুলকারনাইন সায়ের খান সামি ও তাসনিম খলিল নিজ নিজ প্ল্যাটফর্ম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে আন্দোলনের পক্ষে জনমত গড়ে তোলেন।
এই সাংবাদিকরা শুধু সংবাদ পরিবেশন করেননি; সরকারের বিভিন্ন অনিয়ম, মানবাধিকার লঙ্ঘন ও আন্দোলনকারীদের ওপর নির্যাতনের তথ্য-প্রমাণ সংগ্রহ করে তা বিশ্ব গণমাধ্যম ও মানবাধিকার সংস্থার কাছে পৌঁছে দেন। অনলাইনে তাদের বিশ্লেষণ ও অনুসন্ধানী প্রতিবেদন দেশের ভেতরের মানুষকে যেমন সচেতন করেছে, তেমনি প্রবাসীদেরও আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত করেছে।
সঙ্গে ছিলেন আরও বহু অ্যাক্টিভিস্ট। শেখ হাসিনার ফ্যাসিস্ট রেজিমের বিরুদ্ধে তাদের দেওয়া ন্যারেটিভ ইতিবাচকভাবে কাজে লেগেছে। জুলাই বিপ্লব ও তৎপরবর্তী সময়ে ফ্যাসিস্টদের দেশবিরোধী কার্যক্রমের বিরুদ্ধেও এসব অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। আন্দোলনের সময় ফেসবুক, টুইটার ও ইউটিউবের মতো প্ল্যাটফর্মে তথ্যের অবাধ প্রবাহ আরও বেড়ে যায়। মূলধারার গণমাধ্যমকে পাশ কাটিয়ে তারা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বিভিন্ন তথ্য নিয়ে হাজির হতে থাকেন।
পিনাকী রাজনৈতিক বিষয়ে ফেসবুক ও ইউটিউবে নানা ধরনের কন্টেন্ট নিয়ে নিয়মিত সরব ছিলেন। শেখ হাসিনা সরকার, ভারতের আধিপত্যবাদ, দেশের রাজনীতিতে ভারতের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর ভূমিকার বিশ্লেষণ তিনি বারবার বাংলাদেশের মানুষের কাছে তুলে ধরেন।
আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে নানাভাবে অনলাইন প্ল্যাটফর্মে ভূমিকা রাখেন সাংবাদিক ইলিয়াস হোসেনও। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে অনলাইন অ্যাক্টিভিস্টদের সম্মুখ সারিতে ছিলেন তিনি। শেখ হাসিনা সরকারের ভিত কাঁপানো অন্যতম প্রতিবেদন ছিল আল জাজিরার আলোচিত ‘অল দ্য প্রাইম মিনিস্টার্স মেন’ প্রতিবেদন। সচিত্র প্রতিবেদনটি সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ ও তার পরিবারের নানা অপকর্ম নিয়ে তৈরি। যারা তৎকালীন ফ্যাসিস্ট সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আশীর্বাদ ও সহায়তায় গড়ে তোলেন দুর্নীতি ও অপরাধের স্বর্গরাজ্য। শেখ হাসিনার সঙ্গে গোপন চুক্তির মাধ্যমে ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনের বৈতরণী পাড়ি দিতে সহায়তা করেন আজিজ আহমেদ। এ বিষয়গুলো প্রতিবেদনটি তৈরিতে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখেন যুক্তরাজ্য প্রবাসী সাংবাদিক জুলকারনাইন সায়ের খান সামি।
সুইডেন প্রবাসী সাংবাদিক ড. তাসনিম খলিলও ফ্যাসিস্ট হাসিনার পতনের একজন কাণ্ডারী। নিজের পরিচালিত সংবাদমাধ্যম নেত্র নিউজের মাধ্যমে হাসিনা ও তার দোসরদের নানা তথ্য তুলে ধরেন তিনি। ২০২২ সালের ১৪ আগস্ট আলোচিত ‘আয়নাঘরের’ সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশ করে নেত্র নিউজ। সচিত্র সেই প্রতিবেদনে আওয়ামী লীগ সরকারের সমালোচক, অ্যাক্টিভিস্ট ও ধর্মীয় কারণে সরকারের রোষানলে পড়া ব্যক্তিদের গুম করে আলোচিত সেই আয়নাঘরের বিষয়টি সামনে আসে। জুলকারনাইন সায়েরের সঙ্গে তৈরি প্রতিবেদনটিতে দেখা যায়, গুম থেকে ফিরে এসে অনেকে মুখে কুলুপ আঁটেন, কাউকে পাওয়া যায় ভারতে, কারও লাশ মিললেও অনেকেরই জীবিত বা মৃত কোনোভাবেই মেলেনি অনুসন্ধান। নেত্র নিউজের সেই প্রতিবেদন থেকেই আয়নাঘর শব্দটি বহুল আলোচিত হয়। শেখ হাসিনার পতনের পর যুদ্ধাপরাধ মামলায় দণ্ডিত দুজন জামায়াত নেতার সন্তান আব্দুল্লাহিল আমান আযমী ও মীর আহমদ বিন কাসেম এবং ইউপিডিএফ নেতা মাইকেল চাকমা আয়নাঘর থেকে মুক্তি পান।
উল্লেখযোগ্য এসব অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট ছাড়াও অনেকে দীর্ঘদিন ধরে ব্যক্তিগত প্ল্যাটফর্ম থেকে জনমত তৈরিতে ভূমিকা পালন করেছেন। যার মধ্যে রয়েছে সাংবাদিক— তাজ হাশমি, খালেদ মহিউদ্দিন, সাংবাদিক ড. কনক সারোয়ার, সাংবাদিক মোস্তফা ফিরোজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী সাইয়্যেদ আব্দুল্লাহ, কন্টেন্ট ক্রিয়েটর নুরুজ্জামান কাফি প্রমুখ।
তারা বিদেশি গণমাধ্যম, মানবাধিকার সংস্থা ও আন্তর্জাতিক নীতিনির্ধারকদের কাছেও বাংলাদেশের সংকটের বাস্তব চিত্র পৌঁছে দেন, যা বৈশ্বিক পর্যায়ে আন্দোলনের নৈতিক ভিত্তিকে আরও শক্তিশালী করে। তাদের নিরবচ্ছিন্ন ও সাহসী সাংবাদিকতা আন্দোলনের কণ্ঠকে বিশ্বমঞ্চে পৌঁছে দিয়েছে, যা জুলাই-আগস্টের বিপ্লবের জন্য ছিল এক অমূল্য সহায়ক শক্তি।
এমজে