ঢাকা: অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, ‘এক-এগারো’র সরকারের মাধ্যমে শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদের পথ সুগম হয়।
মঙ্গলবার (৫ আগস্ট) জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজায় জুলাই ঘোষণাপত্রে তিনি এসব কথা বলেন।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, দেশি-বিদেশি চক্রান্তে সরকার পরিবর্তনের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ব্যাহত হওয়ায় ১/১১-এর ষড়যন্ত্রমূলক ব্যবস্থার মাধ্যমে বাংলাদেশে শেখ হাসিনার একচ্ছত্র ক্ষমতা, আধিপত্য ও ফ্যাসিবাদের পথ সুগম করা হয়।
জাতীয় সংসদ নির্বাচন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অনাস্থা সৃষ্টি হওয়ার প্রেক্ষাপটে ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারির দেশে জরুরি অবস্থা জারি করা হয়। রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয় সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার। জরুরি অবস্থা জারির পর বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. ফখরুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করা হয়।
এর আগে ২০০৬ সালের ২৮ নভেম্বর তৎকালীন বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর সেসময়কার রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদকে প্রধান উপদেষ্টা করে তার নেতৃত্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হয়।
নির্বাচনী কার্যক্রম পরিচালনার জন্য গঠিত এই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিভিন্ন কর্মকাণ্ড নিয়ে সমালোচনা করতে থাকে আওয়ামী লীগ। তাদের নেতৃত্বাধীন মহাজোট আন্দোলনও চালিয়ে যায়। ছবিসহ ভোটার তালিকা প্রণয়ন, ভুয়া ভোটার তালিকা সংশোধন, নির্বাচন কমিশন সংস্কারসহ বিভিন্ন দাবিতে ওই আন্দোলন চলতে থাকে।
ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদের নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের কিছু দিন পর উপদেষ্টা পরিষদ থেকে উপদেষ্টারা একে একে পদত্যাগ করতে থাকেন।
এ অবস্থায় ২০০৭ সালের ২২ জানুয়ারি নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করা হয়। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট নির্বাচনে অংশগ্রহণের প্রস্তুতি নেওয়ার পাশাপাশি অবাধ সুষ্ঠু নিরপেক্ষ নির্বাচন নিশ্চিত করতে আন্দোলন অব্যাহত রাখে।
এক পর্যায়ে সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনে অন্তরায় হতে পারে এমন নানা অনিয়মের আশঙ্কা ব্যক্ত করে নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেয় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট।
এ পরিস্থিতিতে দেশে জরুরি অবস্থা ঘোষিত হয়। রাষ্ট্রপতি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ভেঙে দিয়ে জরুরি অবস্থা জারি করেন।
সেনাবাহিনীর তৎকালীন প্রধান জেনারেল মইন ইউ আহমদ সব আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসেন। তিনিই এক অনুষ্ঠানে ১১ জানুয়ারির জরুরি অবস্থা জারির দিনটিকে ‘ওয়ান-ইলেভেন’ বা ‘এক এগারো’ নামে আখ্যায়িত করেন।
জরুরি অবস্থা জারির পর দলগুলোর সব ধরনের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করা হয়। শুরু হয় রাজনৈতিক নেতাদের ধরপাকড়। দুর্নীতির অভিযোগসহ বিভিন্ন অভিযোগে দায়ের করা মামলায় প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতাদের অনেকেই গ্রেপ্তার হন।
আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা ও বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া এবং ছাত্র, শিক্ষক, ব্যবসায়ীসহ অনেকেই এ সরকারের সময় গ্রেপ্তার হন।
২০০৭ সালের ১৬ জুলাই আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ হাসিনাকে গ্রেপ্তার করে বিশেষ কারাগারে রাখা হয়। এরপর ৩ সেপ্টেম্বর বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকেও গ্রেপ্তার করে বিশেষ কারাগারে নেওয়া হয়। এই সময় দুই নেত্রীকে রাজনীতি থেকে বাদ দেওয়ার গুঞ্জন ওঠে। ‘মাইনাস-টু’ ফর্মুলা তখন ছিল একটি বহুল আলোচিত বিষয়।
রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ করা হলেও বিভিন্নভাবে আন্দোলন গড়ে ওঠে। দ্রুত নির্বাচনের দাবিতে অনির্বাচিত সরকারের বিরুদ্ধে বিভিন্ন দিক থেকে ক্ষোভ-বিক্ষোভ শুরু হয়। এক পর্যায়ে আন্দোলন রাজপথে নেমে আসে। পরিস্থিতি অনুধাবন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করে। সেই সঙ্গে ঘরোয়া রাজনীতিরও অনুমতি দেয়। এর পর ধীরে ধীরে শেখ হাসিনা, খালেদা জিয়াসহ অন্যান্য রাজনৈতিক নেতারাও মুক্তি পান।
বর্তমান অন্তর্বতী সরকারের প্রধান ‘এক-এগারো’র সরকারের সময় নিজে রাজনীতিতে আসতে চাইলেও পরে আর আসেননি। ওই সরকারের সময় নির্বাচন কমিশনার হিসেবে নিয়োগ পেয়েছিলেন নির্বাচন কমিশনার বিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন, যিনি বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের একজন উপদেষ্টা।
প্রায় দুই বছর অনির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় থাকার পর ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে সরকার গঠন করে।
বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের অভিযোগ, ‘এক-এগারোর’ কুশীলবদের দায়মুক্তি দেওয়ার শর্তে ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে বিজয়ী করা হয়। ২০০৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে জেনারেল মঈন ইউ আহমেদের ছয়দিনের ভারত সফরে ওই নির্বাচনের গতিপথ নির্ধারিত হয়।
এরপর ২০১৪ সালের দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয় বিনা ভোটে, এতে ১৫৩ জন সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়। ব্যাপক কারচুপির কারণে ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় নির্বাচনকে ‘রাতের ভোট’ বলা হয়। আবার ২০২৪ সালের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ‘ডামি নির্বাচন’ বলা হয়। কেননা, সেই নির্বাচনে বিএনপি ও সমমনা দলগুলো বর্জন করায় আওয়ামী লীগের নেতারাই নিজেদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন।
দ্বাদশ সংসদ গঠনের ছয় মাসের বছরের মাথায় জুলাই আন্দোলনের মাধ্যমে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগের শাসনের পতন হয়।
ইইউডি/এইচএ/