ঢাকা, মঙ্গলবার, ২১ শ্রাবণ ১৪৩২, ০৫ আগস্ট ২০২৫, ১০ সফর ১৪৪৭

জাতীয়

৫ আগস্ট লাশের গন্ধে ভারী হয়ে ওঠে সাভার-আশুলিয়ার বাতাস

মাহিদুল মাহিদ, সাভার (ঢাকা) | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪:০৬, আগস্ট ৫, ২০২৫
৫ আগস্ট লাশের গন্ধে ভারী হয়ে ওঠে সাভার-আশুলিয়ার বাতাস

কোটা আন্দোলন থেকে শুরু করে ছাত্র-জনতার এক দফা এক দাবির আন্দোলনে প্রায় প্রতিদিনই উত্তাল ছিল সাভার-আশুলিয়া। প্রতিদিন হামলার শিকার হতে হয়েছিল ছাত্র-জনতাকে।

তবে ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার ওপর পৈশাচিক বর্বরতা চালানো হয়। বুলেটবিদ্ধ হয় সহস্রাধিক জনতা।  সাভার-আশুলিয়া ধামরাইয়ে নিহত হন ৭৩ জন। যদিও প্রকৃত সংখ্যার হিসাব এখনও পাওয়া যায়নি। শুধু আশুলিয়াতেই নিহত হন ৫২ জন। দিনটির কথা মনে হলেই আঁতকে ওঠেন প্রত্যক্ষদর্শীরা।

সকাল থেকে মহাসড়কে কঠোর নিরাপত্তায় ছিল সেনাবাহিনী। সাভারের সড়ক-মহাসড়কের গুরুত্বপূর্ণ সব পয়েন্টে কাঁটাতারের ব্যারিকেড।  এসব ব্যারিকেড উপেক্ষা করে একত্রিত হতে থাকে ছাত্র জনতা।  একদল লংমার্চে যোগ দেওয়ার উদ্দেশ্য ঢাকার দিকে রওনা হয়, আরেক দল আশুলিয়ার বাইপাইল এলাকায় জড়ো হতে থাকে।

একপর্যায়ে জনতার ওপর গুলি বর্ষণ শুরু করে পুলিশ। বিপরীতে ট্রাফিক পুলিশ বক্সসহ বিভিন্ন স্থানে আগুন দিতে থাকে বিক্ষুব্ধ জনতা। গুলিবিদ্ধ শত শত ছাত্র-জনতাকে হাসপাতালে পাঠানো হয়। চোখের সামনেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে থাকেন অনেকে।  

দুপুরের দিকে ছাত্র-জনতা খবর পায় জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেবেন সেনাপ্রধান। তখন আন্দোলন যেন রূপ নেয় যুদ্ধে। পুলিশ ছাত্র-জনতার মধ্যে চলে গুলি আর ইটপাটকেল বিনিময়। ততক্ষণে ছাত্র-জনতার লাশ পড়ে যায় ডজনখানেক। ধীরে ধীরে ছাত্র-জনতার ঢল বাড়তে থাকে। পিছু হটতে থাকে পুলিশ।  

কিন্তু গুলি বর্ষণ থামে না। বিকেলে আশুলিয়া থানার সামনে পুলিশের গুলিতে ঝাঁঝরা হয় ছয়জনের বুক। তাদের লাশ তোলা হয় একটি পুলিশভ্যানে। আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয় ছয়জনেরই লাশ। ততক্ষণে সেনাপ্রধান জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন এবং শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেন। উল্লাসে ফেটে পড়ে সাধারণ মানুষ।  

সড়ক-মহাসড়কে নামে বিজয় মিছিল, সব মিছিল যায় আশুলিয়ার বাইপাইলের দিকে। সেখান থেকে থানা ঘেরাও এর জন্য মিছিল যায় থানার চারপাশে। শুরু হয় লাশের মিছিল। শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পরও গুলিবর্ষণ করেন পুলিশ সদস্যরা।  

পরিস্থিতি বেগতিক দেখে মাইকে আত্মসমর্পণ করে পুলিশ। এতে করে ছাত্র জনতা কিছুটা শান্ত হলেও অবস্থা ক্রমশ খারাপের দিকে যেতে থাকে। আত্মসমর্পণের পরেও গুলি চালাতে থাকে পুলিশ। পরে সেনাবাহিনী ঘটনাস্থলে এসে এই পুলিশ সদস্যদের নিয়ে ক্যান্টনমেন্টে চলে যায়। এরপর থানা ভবনে হামলা চালিয়ে আগুন দেওয়া হয়। অস্ত্রসহ লুটপাট করা হয় থানার বিভিন্ন মালামাল।  

আশুলিয়া থানার পাশের ভবনেই ভাড়া থাকতেন হৃদয় আহমেদ। তিনি বাংলানিউজকে বলেন, ৫ আগস্ট দুপুর ১২টা-১টার দিকে থানায় হঠাৎ হইহুল্লোড় শুরু হয়ে হয়। এ সময় বাসা থেকে বের হয়ে দেখি অনেক পুলিশ অস্ত্র নিয়ে থানার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। ছাত্র-জনতার সঙ্গে মারমুখী পরিস্থিতি দেখতে পাই। যে সামনে আসছে তাকেই গুলি করছে।  

তিনি বলেন, একটু সামনে যেতেই দুই থেকে তিনজন পুলিশ আমাকে ধমক দিয়ে বাসার দিকে পাঠিয়ে দেয়। পরে বাসায় গিয়ে দুইতলা থেকে দেখতে পাই পুলিশ অনবরত গুলি করছে। যখন ছাত্র জনতা থানার দিকে অগ্রসর হয়েছে, তখনই তাদের সরাসরি গুলি করে মেরে ফেলেছে। বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে যখন ছাত্র-জনতা জেনে যায় শেখ হাসিনা পালিয়েছে, তখন বিধ্বংসী একটি রূপ থানার সামনে দেখতে পাই। ছাত্র-জনতা তখন চতুর্দিক দিয়ে ঘিরে ফেলে। তখন পুলিশ যার কাছে যে অস্ত্র ছিল, সেই অস্ত্র দিয়েই গুলিবর্ষণ করছিল। আমার চোখের সামনে ২০ থেকে ১৫ জন গুলিবিদ্ধ হয়ে পড়ে ছিল। তাদের মধ্যে অনেকেই মারা গেছেন।  

তিনি বলেন, লাশে যে আগুন দেওয়ার ঘটনা সরাসরি দেখতে পাইনি। যখন অসংখ্য গুলির শব্দ শুনতে পাই, তখন দরজা বন্ধ করে ঘরের ভেতর আশ্রয় নেই। ছয় থেকে সাতটার দিকে বাসা থেকে বের হয়ে দেখি ছাত্র জনতা থানার ভেতরে প্রবেশ করেছে, অনেকে থানা লুটপাট শুরু করে। এ সময় তো অসংখ্য লোক ছিল যে কারণে কাউকে চেনা সম্ভব হয়নি।  

তিনি আরও বলেন, থানা লুটপাট এর পর থানায় আগুন ধরিয়ে দেয় ছাত্র-জনতা। রাতে যখন সবকিছু শান্ত, তখন থানার ওপর থেকে নিচ পর্যন্ত সবকিছু লুটপাট করে নিয়ে যাচ্ছিল। থানার সামনে লাশ পড়েছিল, থানা থেকে একটু এগোতেই বাইপাইল কেন্দ্রীয় মসজিদের সামনে সাতটি লাশ দেখতে পাই। ফুট ওভারব্রিজে আরও দুটি লাশ ঝোলানো ছিল। সব মিলে ভয়ানক পরিস্থিতির মুখোমুখি আমরা। এরপর বেশ কিছুদিন আমরা ট্রমার মধ্যে ছিলাম।

ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সামনের সারিতে ছিলেন মেহেদী হাসান। তিনি বাংলানিউজকে বলেন, গত বছরের ৪ আগস্ট সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত ছাত্র-জনতার ওপর হামলা করে আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীরা। কিন্তু দুপুরের পর হাজার হাজার ছাত্র-জনতার মুখে তারা আর টিকতে পারেনি। তবে ৫ আগস্ট তারা পুলিশকে সহযোগিতা করতে থাকে।  

তিনি বলেন, সরাসরি তাদের রাজপথে দেখা যায়নি। ৫ আগস্ট সকালে কোনো ঝামেলা হয়নি। কিন্তু বেলা গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ সরাসরি ছাত্র-জনতাকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে। সেদিন গুলিবিদ্ধ শত শত লোক জনকে হাসপাতালে ফ্রি-তে নিয়ে যান রিকশাচালকরা।  

তিনি আরও বলেন, যখন শেখ হাসিনা পালিয়ে যায়, তখন উল্লাসে ফেটে পড়ে ছাত্র-জনতা। আশুলিয়া থানার দিকে যেতে থাকে তারা। এ সময় পুলিশ ছাত্র-জনতাকে লক্ষ্য করে আবারও গুলি ছোড়ে। লাশ নিশ্চিহ্ন করতে পুলিশ ভ্যানে তুলে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। ছাত্র-জনতার ক্ষোভ আরও বাড়ে। তারা থানার চারপাশ দিয়ে ঘিরে ফেলে। এমন সময় পুলিশ আত্মসমর্পণ করে মাইকে ঘোষণা দেয়। তখন ছাত্র-জনতা কিছুটা শান্ত হলে আবারও গুলি ছোড়ে পুলিশ। এবার আত্মসমর্পণেও আর ছাড় না দিয়ে পুলিশের ওপর আক্রমণ করার চেষ্টা করে। পুলিশ গুলি চালাতে থাকে।  

মেহেদী হাসান বলেন, আন্দোলন শেষে সন্ধ্যার পরও রাস্তাঘাটে আনন্দ উল্লাস করছিল জনতা। থানার সামনে গিয়ে দেখি থানা ভাঙচুর লুটপাট চলছে। চারদিকে আগুন, থানায় আগুন, যেখানে সেখানে লাশ পড়ে থাকা, পরিস্থিতিটা খুবই ভয়ানক ছিল। আমাদের এলাকার মধ্যে বিভিন্ন স্থানে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়েছিল।  আমরা আগুন নেভানোর চেষ্টা করছিলাম। কোনো সিলিন্ডার যেন বিস্ফোরণ না হয়, এমনকি এই আগুন যেন হলো বসতবাড়ি পর্যন্ত না ছড়ায় সেই চেষ্টাটাই করছিলাম আমরা।  

তিনি বলেন, থানা থেকে অনেকেই অস্ত্র লুট করে নিয়ে যায়, পড়ে সেনাবাহিনী এসে এলাকায় মাইকিং করে অস্ত্র জমা দেওয়ার বিষয়ে জানালে অনেকেই অস্ত্র জমা দেয়। ৬ আগস্ট দেখলাম থানার সামনে লাশ পড়ে আছে, ফুট ওভারব্রিজে পায়ে কিছু একটা দিয়ে বেঁধে দুটি লাশ ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। এই দুটি লাশ ছিল পুলিশ সদস্যের।  

শহীদ আস-সাবুরের মা বলেন, আন্দোলনে আমার ছেলেকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। কী নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে তাকে। প্রথমে গুলি করে হত্যা পরে লাশে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। এত বড় নির্মমতা, তারা লাশের সঙ্গেও পৈশাচিক বর্বরতা চালিয়েছে। আওয়ামী লীগের জড়িত সব নেতাকর্মীসহ শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে এনে তার শাস্তি দাবি করছি।  

ঢাকা জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার শাহীনুর কবির বাংলানিউজকে বলেন, গণঅভ্যুত্থানে সাভার ও আশুলিয়ায় সব চেয়ে বেশি ম্যাসাকার হয়েছে। এখন পর্যন্ত সাভার এবং আশুলিয়া থানা মিলে হত্যা মামলাসহ ১২৫টি মামলা দায়ের হয়েছে। এসব মামলায় আসামি ১০ হাজারেরও বেশি।  

তিনি বলেন, এই মামলা গুলো আমরা সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে আসামিদের গ্রেপ্তার,  লাশ উত্তোলনের যে সব প্রক্রিয়া ছিল সেসবও শেষ হয়েছে। চার্জশিট প্রস্তুত করার জন্য যেসব প্রক্রিয়া থাকে, এ ছাড়া অন্যান্য যে প্রক্রিয়া রয়েছে সবই মোটামুটি সম্পন্ন হয়েছে। শিগগিরই আমরা আদালতে চার্জশিট দেওয়া শুরু করব।

আরএইচ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।