‘জুলাই গণ-অভ্যুত্থান দিবস’ উপলক্ষে দেশজুড়ে জেলা প্রশাসন আয়োজিত অনুষ্ঠানে ভিডিওবার্তা দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস।
তিনি বলেন, আজ আমরা পুরো জাতি একসঙ্গে স্মরণ করছি এক এমন দিনের কথা, যা এদেশের ইতিহাসে গভীর ছাপ রেখে গেছে।
‘আজ আমি গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের, যাদের আত্মত্যাগে আমরা পেয়েছি স্বাধীন, সার্বভৌম বাংলাদেশ। ১৯৭১ সালে সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এদেশের জনগণ সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল। লাখো প্রাণের বিনিময়ে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। ’
‘কিন্তু স্বাধীনতার অর্ধশতাব্দী পরও এ দেশের মানুষ সুবিচার ও গণতন্ত্র থেকে বঞ্চিত হয়েছে, বৈষম্যের শিকার হয়েছে। ২০২৪ সালের উত্তাল জুলাই ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসে এক সংকটময় অধ্যায়, ১৬ বছরের পুঞ্জীভূত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ। ’
অধ্যাপক ইউনূস বলেন, এ দেশের এ বিপুল সংখ্যক তরুণেরা ১৬ বছর ধরে ক্রমাগত হতাশায় নিমজ্জিত হয়েছে। ভালো ফল করেও চাকরির জন্য ক্ষমতাসীনদের দুয়ারে দুয়ারে ঘুরেছে। চাকরিকে ঘিরে তৈরি হয়েছিল দুর্নীতি-স্বজনপ্রীতি, তদবির বাণিজ্য। যে তরুণ ঘুষ দিতে পারেনি, এলাকার মাফিয়াদের সঙ্গে সখ্য গড়ে তুলতে পারেনি তার চাকরি হয়নি। সরকারি চাকরিতে বৈষম্যমূলক কোটা পদ্ধতি, যেটি মূলত ছিল দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির আরেকটি হাতিয়ার, এর বিরুদ্ধে তরুণ সমাজ দীর্ঘদিন ধরে প্রতিবাদ-বিক্ষোভ করলেও ফ্যাসিবাদী শাসকের টনক নড়েনি।
‘দীর্ঘ এই সময় প্রতিটি সেক্টরে মাফিয়াতন্ত্র কায়েম করে একটি সুবিধাভোগী শ্রেণি তৈরি করা হয়েছিল, যারা আর্থিক ও অন্যান্য সুবিধার বিনিময়ে স্বৈরাচারের পক্ষে কথা বলবে, কাজ করবে। স্বৈরাচারের পক্ষের সঙ্গী হলেই তার চাকরি হবে, কাজ মিলবে। সরকারি প্রতিষ্ঠান, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান এমনকি বিচার ব্যবস্থা, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী, গণমাধ্যম ও সাংস্কৃতিক মন্ডলেও এই ধরনের সুবিধাভোগী শ্রেণি তৈরি হয়েছিল। এ দেশের গরীব-মেহনতি মানুষের পয়সা লুট করে পতিত ফ্যাসিবাদ ও তাদের সহযোগীরা একেকজন টাকার পাহাড় গড়ে তোলে। সীমাহীন দুর্নীতির কবলে পড়ে অর্থনীতি ভেঙে পড়ে। ’
‘এই দেড় যুগে প্রতিটি ন্যায্য দাবি, প্রতিবাদ, বিক্ষোভ চলাকালে পুলিশের পাশাপাশি দলীয় সন্ত্রাসীরা অস্ত্র হাতে আন্দোলনকারীদের পিটিয়েছে। গত ১৬ বছরে যারাই সরকারের সমালোচনা করেছে, নাগরিকদের অধিকারের পক্ষে কথা বলেছে তাদেরকে গ্রেপ্তার অথবা গুম করা হয়েছে। লাখ লাখ বিরোধী দলীয় রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের নির্বিচারে আটক-গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ’
তিনি বলেন, এই ভয়াবহ পরিস্থিতিতে চব্বিশের জুলাইয়ে দেশের ছাত্রসমাজ, তরুণ প্রজন্ম, সাধারণ মানুষ—সবাই একত্রিত হয় এক নতুন দিনের প্রত্যাশায়। সমস্বরে তারা বলে ওঠে, এবার ফ্যাসিবাদকে যেতে হবে। তবু দেশের মানুষের বুকে গুলি চালিয়ে শেষ পর্যন্ত ক্ষমতা আঁকড়ে ধরে রাখতে চেয়েছিল ফ্যাসিবাদী সরকার। তারা নির্বিচারে গুলি করেছে, গ্রেপ্তার করেছে, ইন্টারনেট বন্ধ করে হত্যাকাণ্ডের তথ্য লুকাতে চেয়েছে, রাতের অন্ধকারে এলাকায় এলাকায় অভিযান চালিয়ে ছাত্রদের আটক করেছে।
‘গুলিবিদ্ধ আহতদের তারা হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে দেয়নি। হাসপাতালগুলোকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল যেন আহতদের ভর্তি না করা হয়। এ কারণে বহু মানুষ চিকিৎসা না পেয়ে চিরতরে দৃষ্টি হারিয়েছে, পঙ্গু হয়েছে। ’
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, আজ জুলাই গণ-অভ্যুত্থান দিবসে আমি জাতির সূর্যসন্তান জুলাই শহীদদের গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি। তাদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি। জুলাইয়ে যারা আহত হয়েছেন, চিরতরে পঙ্গু হয়েছেন, দৃষ্টি হারিয়েছেন জাতির পক্ষ থেকে আমি তাদের প্রতি শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। এ জাতির আপনাদের কাছে চিরকৃতজ্ঞ থাকবে।
‘গত বছর ডিসেম্বর মাসে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে শহীদ পরিবার ও আহতদের কল্যাণ এবং যাবতীয় বিষয়াদির প্রশাসনিক দায়িত্ব মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় ওপর ন্যস্ত করা হয়েছিল। এখন পর্যন্ত ৮৩৬টি শহীদ পরিবারের মধ্যে ৭৭৫টি শহীদ পরিবারকে মোট ৯৮ কোটি ৪০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র ও মাসিক ভাতা বাবদ ব্যাংক চেক দেওয়া হয়েছে। অবশিষ্ট যারা আছেন, তাদেরও কয়েকটি বিষয় নিষ্পত্তি সাপেক্ষে সঞ্চয়পত্র দেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে। ’
‘এর পাশাপাশি আহত ১৩ হাজার ৮০০ জন জুলাই যোদ্ধাকে তিনটি ক্যাটাগরিতে নগদ টাকা ও চেক বাবদ মোট ১৫৩ কোটি ৪ লাখ ২৫ হাজার টাকা দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ৭৮ জন অতি গুরুতর আহত জুলাইযোদ্ধাকে সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, তুরস্ক এবং রাশিয়ায় উন্নত চিকিৎসার জন্য পাঠানো হয়েছে এবং চিকিৎসা ব্যয় বাবদ এ পর্যন্ত ৯৭ কোটি ৫০ লাখ টাকা ব্যয় হয়েছে। ’
তিনি বলেন, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের সব সরকারি হাসপাতাল বা ক্লিনিক বা স্বাস্থ্য কেন্দ্র, মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং সরকার কর্তৃক নির্ধারিত বিশেষায়িত হাসপাতালগুলোতে সব শ্রেণির আহত জুলাই যোদ্ধাদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে জুলাই শহীদ ও আহতদের জন্য আরও নানা উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। তবে জুলাইয়ের মহানায়কদের আত্মত্যাগ তখনই সার্থক হবে যখন এই দেশকে আমরা একটি সত্যিকারের জনকল্যাণকর দেশ হিসেবে গড়ে তুলতে পারব।
‘আজ আমরা কেবল অতীত স্মরণ করতে আসিনি— আমরা একটি শপথ নিতে এসেছি। শপথ এই যে— আমরা কোনো ধরনের নিপীড়নের কাছে মাথা নোয়াব না, আমরা প্রতিষ্ঠা করব একটি জবাবদিহিমূলক, মানবিক, গণতান্ত্রিক এবং বৈষম্যহীন রাষ্ট্র। এমন রাষ্ট্র—যা সবসময় জনকল্যাণে কাজ করবে। ’
তিনি বলেন, জুলাই শহীদের আত্মত্যাগ আমরা বৃথা যেতে দেব না। তাদের আত্মত্যাগই হবে আমাদের পথচলার প্রেরণা। তাদের স্বপ্নই হবে আমাদের আগামী বাংলাদেশের নির্মাণরেখা— আজকের দিনে এটাই হোক আমাদের শপথ।
এমআইএইচ/আরএইচ