অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস আজ ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণ-আন্দোলনে শেখ হাসিনার সরকারের পতনের বর্ষপূর্তিতে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় ঘোষণা করতে পারেন। এদিন তিনি বিকেল ৫টায় জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজায় জুলাই ঘোষণাপত্রও পাঠ করবেন।
সরকারের একাধিক সূত্র জানায়, ৫ আগস্ট অথবা ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের বর্ষপূর্তিতে প্রধান উপদেষ্টার জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে জাতীয় নির্বাচনের সময় ঘোষণা করার পরিকল্পনা রয়েছে। তবে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের তারিখকে বেশি গুরুত্ব দিতে আগ্রহী নন প্রধান উপদেষ্টা।
সে কারণে আজ ৫ আগস্টই এই ভাষণ দেওয়ার সম্ভাবনা বেশি। সূত্রগুলো আরো জানায়, ‘আগামী ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচন হবে’—এই ঘোষণা দিতে পারেন। পরে ভোট গ্রহণের তারিখসহ নির্বাচনের বিস্তারিত সময়সূচি এখতিয়ার অনুসারে নির্বাচন কমিশন ঘোষণা করবে।
এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনার আব্দুর রহমানেল মাসুদ গতকাল বলেন, প্রধান উপদেষ্টা আগামী ফেব্রুয়ারি মাসে নির্বাচন হলে ওই মাসের প্রথমার্ধে রোজার আগেই নির্বাচন হতে পারে।
সাধারণত ভোট গ্রহণের ৫০ থেকে ৬০ দিন আগে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা হয়। সে ক্ষেত্রে আগামী ডিসেম্বরে তফসিল ঘোষণা হতে পারে। নির্বাচন অনুষ্ঠানে নির্বাচন কমিশনের প্রস্তুতি সম্পর্কে তিনি বলেন, প্রস্তুতি চলমান। ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন অনুষ্ঠানে কোনো সমস্যা হবে না।
‘গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ-১৯৭২’-এর কিছুটা সংস্কার প্রয়োজন। নির্বাচন কমিশনের আগামী সভায় এর খসড়া চূড়ান্ত হবে বলে আশা করছি। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতির জন্য অন্তর্বর্তী সরকার থেকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।
এদিকে নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা জানান, আগামী বছর রোজা শুরু হতে পারে ১৮ ফেব্রুয়ারি থেকে। এ ক্ষেত্রে ১২ ফেব্রুয়ারি, বৃহস্পতিবার বা তার আগে যেকোনো দিন ভোট গ্রহণের তারিখ নির্ধারণ হতে পারে।
সে ক্ষেত্রে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা হতে পারে ১৪ ডিসেম্বর থেকে ২৪ ডিসেম্বরের মধ্যে।
নির্বাচন কমিশনের তথ্য অনুসারে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা হয়েছিল ভোট গ্রহণের ৫৬ দিন আগে। দশম জাতীয় সংসদের বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতার নির্বাচনী তফসিল ঘোষণা হয় ভোট গ্রহণের ৪৫ দিন আগে। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা হয় ভোটগ্রহণের ৫১ দিন আগে। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের একতরফা নির্বাচনে তফসিল ঘোষণা হয় ভোটগ্রহণের ৫২ দিন আগে। ১৯৯০-এর পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা হয় ভোটগ্রহণের ৭৩ দিন আগে।
নির্বাচনের সময় নিয়ে যত আলোচনা: গত ১৩ জুন লন্ডনে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে বৈঠকের পর এক যৌথ বিবৃতিতে প্রধান উপদেষ্টার বরাতে বলা হয়েছিল, ‘সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করা গেলে ২০২৬ সালের রমজান শুরু হওয়ার আগের সপ্তাহেও নির্বাচন আয়োজন করা যেতে পারে। ’ তার আগে গত ৬ জুন জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা বলেছিলেন ২০২৬ সালের এপ্রিলের প্রথামার্থে যেকোনো দিন ভোট হতে পারে। কিন্তু এই সময় সম্পর্কে বিএনপি ও তাদের সমমনা দল ও বামদলগুলো আপত্তি জানায়। এরপর তারেক রহমানের সঙ্গে লন্ডনে বৈঠকের পর এই সময় পরিবর্তন হতে পারে বলে জানানো হয়। গত ৬ জুলাই স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা রাজধানীর উত্তরায় শিল্পাঞ্চল পুলিশ সদর দপ্তর ও উত্তরা পূর্ব থানা পরিদর্শন শেষে সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, পাঁচ-ছয় মাস পর নির্বাচন ধরেই আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী প্রস্তুতি নিচ্ছে।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ এম এম নাসির উদ্দিন প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক করে আসার পর গত ৮ জুলাই সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘নির্বাচনের জন্য ফুল গিয়ারে প্রস্তুতি চলছে। ’ সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান গত বছরের সেপ্টেম্বরের শেষদিকে বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, আগামী ১৮ মাসের মধ্যে যাতে নির্বাচন হতে পারে। আগামী ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন ওই সময়ের মধ্যেই পড়ে।
এ ছাড়া প্রধান উপদেষ্টা গত ২৬ জুলাই রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে এক বৈঠকে বলেন, নির্বাচনের নির্দিষ্ট সময় শিগগিরই জানানো হবে। বৈঠক শেষে জাতীয় পার্টি (কাজী জাফর) চেয়ারম্যান ও ১২ দলীয় জোটের নেতা মোস্তফা জামাল হায়দার সাংবাদিকদের বলেন, ‘প্রধান উপদেষ্টা খুব স্পষ্টভাবে বলেছেন, আগামী চার-পাঁচ দিনের মধ্যে তিনি নির্বাচনের নির্দিষ্ট সময় ঘোষণা করবেন। ’
গত ৯ জুলাই ও ২৮ জুলাই নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে প্রধান উপদেষ্টা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সঙ্গে বৈঠক করেন এবং ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি শেষ করতে বলেন। ২৮ জুলাইয়ের বৈঠকে নির্বাচনকালে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী কিভাবে মোতায়েন হবে, সেটি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। বিজিবি বা সেনাবাহিনী স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে কিভাবে থাকবে, তা নিয়েও আলোচনা হয়। জানানো হয়, ৪৭ হাজার ভোটকেন্দ্র থাকবে। এর মধ্যে ১৬ হাজারের মতো ভোটকেন্দ্র ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে। এসব কেন্দ্রে শান্তিপূর্ণভাবে ভোট নেওয়ার জন্য পুলিশের বডিক্যাম, কেন্দ্রগুলোতে সিসিটিভি রাখার নির্দেশনা দেওয়া হয়। ভোট বিষয়ে জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটদের প্রশিক্ষণ এবং ভোটের আগে-পরে সাত দিনের জন্য আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী মোতায়েন করা যায় কি না, তা নিয়েও ওই বৈঠকে আলোচনা হয়।
ভোটের প্রস্তুতি কতটা জানালেন ইসি সচিব : আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পরিস্থিতি ও প্রস্তুতি পর্যবেক্ষণের জন্য ইউরোপীয় ইউনিয়নের একটি পর্যবেক্ষকদল আগামী সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি দেশে আসবে। এর মধ্যে তিনজন বিদেশি ও চারজন স্থানীয় পর্যবেক্ষক থাকবেন। গতকাল সোমবার নির্বাচন কমিশনের সচিব আখতার আহমেদ সাংবাদিকদের এই তথ্য জানান এবং ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নির্বাচন কমিশনের প্রস্তুতির সর্বশেষ অবস্থা তুলে ধরেন।
নির্বাচনের প্রস্তুতি সম্পর্কে সচিব বলেন, ‘তফসিল ঘোষণার ব্যাপার একান্তভাবে নির্বাচন কমিশনের এখতিয়ার। যখনই ইসি সিদ্ধান্ত নেবে আমরা জানাব। এখন আমাদের সব প্রস্তুতি জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে। আগামী সেপ্টেম্বরের মধ্যে কেনাকাটা শেষ হয়ে যাবে। এর পরও কিছু কাজ থাকবে, যেগুলো সম্পর্কে পর্যালোচনা করে বলা যাবে। ’
তিনি বলেন, প্রধান উপদেষ্টা যে টাইমলাইন দিয়েছেন, সে অনুযায়ী কাজ করছি। এরই মধ্যে সংসদীয় আসনের সীমানা পুনর্নির্ধারণের খসড়া প্রকাশ করা হয়েছে। ১০ আগস্টের মধ্যে দাবি-আপত্তি জানানোর সময় রয়েছে। এরপর শুনানি শেষে আগস্টের মধ্যেই সীমানা চূড়ান্ত করার পরিকল্পনা রয়েছে। নির্বাচন পর্যবেক্ষক সংস্থার নিবন্ধনের জন্য আবেদন আহবান করা হয়েছে। ১০ আগস্টের মধ্যে আবেদন পেলে বিধি অনুযায়ী চূড়ান্ত করা হবে। এরই মধ্যে সীমানা আইন সংশোধন অধ্যাদেশ, ভোটার তালিকা সংশোধন অধ্যাদেশ, ভোটকেন্দ্র স্থাপন নীতিমালা, স্থানীয় পর্যবেক্ষক নীতিমালা, বিদেশি পর্যবেক্ষক ও গণমাধ্যম নীতিমালা, পর্যবেক্ষক সংস্থা নীতিমালা জারি ও আবেদন আহবান করা হয়েছে। আগামী বৃহস্পতিবার নির্বাচন কমিশনের সভা রয়েছে। এতে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) সংশোধনের প্রস্তাব চূড়ান্ত করা হবে। রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীর আচরণ বিধিমালাও চূড়ান্ত হতে পারে। আচরণবিধিতে এআই অপব্যবহার রোধে কার্যকর ব্যবস্থা রোধেও কারিগরি ব্যবস্থাও বিধিতে যুক্ত করার চেষ্টা করা হচ্ছে।
ভোটের জন্য সব ধরনের নির্বাচন সামগ্রীর কেনাকাটা ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে শেষ করা হবে। অনলাইনে নিবন্ধনের মাধ্যমে পোস্টাল ব্যালটের মাধ্যমে প্রবাসীদের ভোটদানসংক্রান্ত প্রকল্প অনুমোদনের প্রক্রিয়া চলছে। এতে প্রায় ৪৮ কোটি টাকা ব্যয়ের প্রাক্কলন করা হয়েছে। শিগগিরই পরিকল্পনা কমিশনের আনুষ্ঠানিক অনুমোদন পাওয়া যাবে।
দলনিবন্ধন বিষয়ে তিনি জানান, নিবন্ধিত ৫১টি দলের মধ্যে ৩০টি গত ৩১ জুলাইয়ের মধ্যে তাদের আয়-ব্যয়ের নিরীক্ষা প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। ১৫টি দল সময় বাড়াতে আবেদন করেছে। বাকি ছয়টি দলের মধ্যে পাঁচটি প্রতিবেদন দেয়নি। একটি এ বছর নিবন্ধন পাওয়ায় দলটি এবার প্রতিবেদন দেয়নি। দল নিবন্ধনের জন্য ১৪৫টি দল আবেদন করেছিল। তথ্য ঘাটতি পূরণ চেয়ে চিঠি দেওয়ার পর ৩ আগস্টের মধ্যে ৮০টি দল প্রয়োজনীয় নথি দিয়েছে।
সৌজন্য: কালের কণ্ঠ