ঢাকা, শুক্রবার, ৩ শ্রাবণ ১৪৩২, ১৮ জুলাই ২০২৫, ২২ মহররম ১৪৪৭

জাতীয়

দম্পতিসহ ৩ সন্তান না ফেরার দেশে, পুড়ে ছারখার স্বপ্নভরা সংসার

সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮:৪৪, জুলাই ১৮, ২০২৫
দম্পতিসহ ৩ সন্তান না ফেরার দেশে, পুড়ে ছারখার স্বপ্নভরা সংসার এই রুমে থাকতো ওই পরিবার।

ঢাকা: রাজধানীর সূত্রাপুরের কাগজিটোলার এক নিস্তব্ধ রাত। সবকিছুই ছিল স্বাভাবিক।

পরিবারের পাঁচ সদস্য ঘুমিয়ে ছিলেন নিজেদের ছোট্ট ঘরে। হয়তো আগামী দিনের স্বপ্ন নিয়ে কথা বলেই ঘুমিয়ে পড়েন তিন শিশু সন্তানকে নিয়ে দম্পতি। কিন্তু সেই রাত ছিল একই পরিবারের জীবনের প্রদীপ নিভে যাওয়ার রাত। রাতেই ঘরের মধ্যে আগুনে দগ্ধ হলো দম্পতিসহ তিন সন্তান। একে একে তিন সন্তানের মৃত্যুর পর মারা গেলেন তাদের বাবা-মাও।

বৃহস্পতিবার (১০ জুলাই) রাতে নিচতলায় ভাড়া বাসায় জমে থাকা গ্যাসে কোনো কারণে আগুনের স্পর্শে স্বামী-স্ত্রী ও তাদের তিন সন্তান দগ্ধ হয়। তবে পুলিশ বলছে, মশার কয়েল থেকে মশারিতে আগুন লেগে ছড়িয়ে পড়ে। সেই আগুনেই ঘুমন্ত অবস্থায় তারা দগ্ধ হয়ে একে একে সবাই মারা যান।

পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালীর সন্তান রিপন ঢাকায় এসেছিলেন জীবনের চাকা ঘোরাতে। স্ত্রী চাঁদনী আর তিন সন্তান তামিম, রোকন ও ছোট্ট আয়েশাকে নিয়ে গড়ে তুলেছিলেন ভালোবাসার একটি ঘর। ভাড়া বাসা হলেও সংসারে কোনো অভাব ছিল না। কিন্তু মাত্র কয়েক সেকেন্ডের একটি বিস্ফোরণ সবকিছু নিঃশেষ করে দিল।

সূত্রাপুর কাগজিটোলার একটি পাঁচতলা বাড়ির নিচতলায় ঘটে সেই মর্মান্তিক ঘটনা। আগুনে মুহূর্তেই ঝলসে যান তারা। পুড়ে যায় শরীর, পুড়ে যায় স্বপ্ন। ঘটনার দিন প্রতিবেশীরা ছুটে গিয়ে দরজা ভেঙে দগ্ধদের বের করে আনেন। নিয়ে যান শাহবাগে অবস্থিত জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে।

প্রথমেই চলে যায় কোলের দেড় বছরের মেয়ে আয়েশা। এরপর একে একে চোখের সামনে মৃত্যু হয় দুই ছেলে তামিম (১৮) ও রোকনের (১৪)। বৃহস্পতিবার (১৭ জুলাই) রাত সাড়ে ১১টার দিকে চলে গেলেন তাদের বাবা ৪০ বছর বয়সী ভ্যানচালক রিপন।

রিপনের স্ত্রী চাঁদনী, যার শরীরের ৪৫ শতাংশ দগ্ধ ছিল। থাকতে পারলেন না হাসপাতালে। তিন সন্তানকে হারিয়ে তিনি দিশেহারা হয়ে পড়েন। জানিয়ে দেন আর না, মরলে বাড়িতেই মরবো। সেই সিদ্ধান্তে গত বুধবার নিজে থেকেই ফিরে যান গ্রামের বাড়ি। সঙ্গে ছিলেন আত্মীয়-স্বজনরা। গ্রামে পৌঁছানোর দুয়েক মিনিট আগেই রাস্তায় মারা যান চাঁদনী।

চাঁদনী ছাড়া বাকি তিন শিশুসহ তাদের বাবার মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করেন হাসপাতালের চিকিৎসক। এ ছাড়া মোবাইলে চাঁদনীর মৃত্যু বিষয়টি নিশ্চিত করেন তার মামা মোহাম্মদ রাসেল।

কাগজিটোলার সেই বাড়ির নিচতলায় এখন শূন্যতা। পোড়া গন্ধ, দেয়ালে ঝলসে যাওয়া দাগগুলো বলছে এখানে এক সময় একটি পরিবার বাস করতো। যারা হাসতেন, খেতেন, ভালোবাসতেন।

রিপনের মামা জাকির হোসেন বলেন, এই পরিবারের কোনো শত্রু ছিল না। তার দাবি, গ্যাস লিকেজেই হয়েছে বিস্ফোরণটি। মা-বাবার পাশাপাশি যে তিনটা জীবন চলে গেল—তাদের তো জীবনের শুরুই হয়নি।

গত বৃহস্পতিবার (১৭ জুলাই) রাত সাড়ে ১১টার দিকে জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটে মারা যান রিপন। গত মঙ্গলবার (১৫ জুলাই) রাত পৌনে ৩টার দিকে মারা যায় রোকন। সোমবার (১৪ জুলাই) রাতে মারা যায় আয়েশা। বুধবার (১৬ জুলাই) সকালে মারা যান তামিম। সন্তানদের মা চাঁদনী মারা যান দেশের বাড়ি নেওয়ার পথে।

শুক্রবার (১৮ জুলাই) জাতীয় বার্ন এন্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের আবাসিক সার্জন ডা. শাওন বিন রহমান জানান, রিপন ৬০ শতাংশ দগ্ধ নিয়ে মারা যান। তার মৃত্যুর আগে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন তার তিন সন্তানরা মারা যায়। রিপনের স্ত্রী চাঁদনী ৪৫ শতাংশ দগ্ধ নিয়ে ইচ্ছাকৃতভাবে আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে বাড়ি চলে গেছেন।  

এদিকে সূত্রাপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, ঘটনার পর শোনা গিয়েছিল জমে থাকা গ্যাসের কারণে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে, কিন্তু ঘটনাস্থলে গিয়ে গ্যাসের কোনো অস্তিত্ব পায়নি পুলিশ। তারা ছোট্ট একটি রুমে একসঙ্গে থাকতো। স্টপের চুলায় রান্নাবান্না করতো।

যতটুকু অনুসন্ধান করে জানা গেছে, মশার কয়েল থেকে মশারিতে আগুন ধরে ঘুমন্ত অবস্থায় তারা দগ্ধ হন। ঘটনার দিন ঘরে দগ্ধদের চিৎকারে আশপাশের লোকজন এসে দরজা ভেঙে তাদের উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যান। এই দরজা ভাঙার বিকট আওয়াজের কারণে মানুষজন বলছে, বিকট শব্দে বিস্ফোরণ হয়েছে। আসলে বিস্ফোরণের কোনো ঘটনা ঘটেনি। এই ঘটনায় থানায় মামলা হয়েছে।

তিনি ঘটনাটি খুবই মর্মান্তিক উল্লেখ করে বলেন, একটি আগুন একই পরিবারের পাঁচটি প্রাণ নিভিয়ে দিল।

এজেডএস/আরবি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।