মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের পাল্টাপাল্টি শুল্ক আরোপের মধ্য দিয়ে কি বিশ্বে নতুন করে বাণিজ্যযুদ্ধের দামামা বেজে উঠল? বিশ্ব কি আবার একটা মহামন্দার দিকে এগিয়ে যাবে? বিশ্ব এখন এসব প্রশ্নে তোলপাড়। এ উদ্বেগ, উৎকণ্ঠার মধ্যে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ কী হবে? আমরা কি বাণিজ্যযুদ্ধের বলি হতে যাচ্ছি? আমাদের অর্থনীতির জন্য এটিই এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
৫ আগস্টের গণ অভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশের অর্থনীতির চেহারা ভালো নয়। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে একমাত্র ভরসা এখন প্রবাসীদের রেমিট্যান্স। প্রবাসীরা উজাড় করে বাংলাদেশে টাকা পাঠাচ্ছেন। কিন্তু এই রেমিট্যান্সপ্রবাহ সারা বছর একই রকম থাকবে, এটি ভাবা ঠিক নয়। কারণ প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স এবার এসেছে মূলত ঈদ সামনে রেখে। প্রতিবার ঈদে এই রেমিট্যান্সপ্রবাহ বাড়ে। এবার ঈদে রেমিট্যান্সপ্রবাহ অতীতের রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। কিন্তু বাংলাদেশে প্রবাসী আয়ের জন্য যে করণীয়গুলো করার দরকার ছিল সেটাও আমরা কতটুকু করতে পেরেছি, তা নিয়ে বিতর্ক আছে। কারণ বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের জনশক্তি রপ্তানি সংকুচিত হচ্ছে। কয়েকটি জনশক্তি গ্রহণকারী দেশ বাংলাদেশিদের এখন ভিসা দিচ্ছে না। অর্থাৎ জনশক্তির বিশ্ববাজারে বাংলাদেশ এখন কঠিন প্রতিযোগিতার মুখে। এ সময়ে বাংলাদেশের বৈদেশিক রপ্তানিতেও একটা ভাটার টান লক্ষ করা যাচ্ছে। বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের জন্য প্রবাসীদের রেমিট্যান্স যেমন গুরুত্বপূর্ণ, ঠিক তেমনি গুরুত্বপূর্ণ আমাদের পোশাক খাত। কিন্তু পোশাক খাতে নানা রকম সংকট এখন দৃশ্যমান। বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই শুল্ক আরোপের পর পোশাক খাত বড় ধরনের হুমকিতে পড়বে বলেই মনে করছেন অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞরা। পাশাপাশি ৫ আগস্টের পর বহু পোশাক খাত বন্ধ হয়ে গেছে। অনেক পোশাক খাতের মালিক দেশ থেকে পালিয়ে গেছেন বা আত্মগোপনে আছেন। তাদের কারখানাগুলো বন্ধ। গণ অভ্যুত্থানের পর বিভিন্ন শিল্প কলকারখানায় ব্যাপকভাবে হামলা হয়েছে। অগ্নিসংযোগ হয়েছে, লুটপাট হয়েছে। ফলে এসব শিল্পকারখানার অনেকগুলো বন্ধ। যেগুলো এখন পর্যন্ত চালুর কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।
অর্থনীতিতে বিগত সরকারের আমলে বিপুল পরিমাণ খেলাপি ঋণ এবং অর্থ পাচারের কারণে একটা সংকট আগে থেকেই ছিল। সেই সংকট কাটিয়ে ওঠার জন্য অর্থনৈতিক সংস্কারের যে উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে সেই উদ্যোগগুলো অবশ্যই ভালো। কিন্তু ব্যাংকিং খাতের সংস্কার বা খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনা, পাচার করা অর্থ ফেরত আনা, এ রকম প্রত্যেকটি কাজ দীর্ঘমেয়াদি। চটজলদি এর সুফল পাওয়া যাবে না। এর মধ্যে বাংলাদেশে আইএমএফের উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিদল ঢাকায় এসেছে। এই প্রতিনিধিদলের সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংক এবং অর্থ মন্ত্রণালয়ের বৈঠক হচ্ছে। তারা বাংলাদেশে পরবর্তী কিস্তির ছাড় দেবে কি না, সে নিয়ে আলাপ-আলোচনা হচ্ছে। এখন পর্যন্ত যেটুকু খবর পাওয়া গেছে তাতে জানা গেছে যে এই ছাড় করার আগে তারা বাংলাদেশে কিছু দৃশ্যমান সংস্কার দেখতে চায়। এসব সংস্কারের মধ্যে করব্যবস্থাপনা সংস্কার, করের পরিধি বাড়ানো এবং খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনার বিষয়টিকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। এটি করতে গিয়ে সরকারকে হয়তো জনগণের ওপর বাড়তি করের বোঝা চাপাতে হবে। নতুন কর্মসংস্থান প্রায় বন্ধ হওয়ার উপক্রম। অর্থনীতির যখন এ চেহারা তখন বিশ্ববাণিজ্যে অস্থিরতা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের অনড় যুদ্ধাবস্থা বাংলাদেশের জন্য কঠিন পরিস্থিতি তৈরি করবে। এ সময় পরিস্থিতি সামাল দিতে হবে দক্ষতার সঙ্গে, সম্মিলিতভাবে। তা না হলে শুধু অর্থনীতি বিপর্যস্ত হবে না, রাজনৈতিক সংস্কারসহ অন্য সংস্কারগুলো মুখ থুবড়ে পড়বে, হবে প্রশ্নবিদ্ধ।
আমরা লক্ষ করেছি যে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যখন বাংলাদেশের ওপর ৩৭ শতাংশ শুল্ক আরোপ করলেন, তার পরপরই প্রধান উপদেষ্টা সংশ্লিষ্টদের নিয়ে জরুরি বৈঠক করেছেন। এ বৈঠকের মাধ্যমে দ্রুত করণীয় বিষয় চটজলদি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। প্রধান উপদেষ্টা এবং বাণিজ্য উপদেষ্টা দুজনই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বকে চিঠি পাঠান। তিন মাসের জন্য আরোপিত শুল্ক স্থগিত রাখার জন্য আহ্বান জানান। বুধবার বাংলাদেশসহ ৭৫টি দেশে বাড়তি শুল্ক আরোপের আদেশ ৯০ দিনের জন্য স্থগিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টা মার্কিন প্রেসিডেন্টকে ধন্যবাদ জানান। এটি খুবই ইতিবাচক। বাংলাদেশ কিছু বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণের কথাও ভাবছে। কিন্তু শুধু বাংলাদেশ ব্যাংক, আমলা কিংবা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষদের সঙ্গে নিয়ে বর্তমান পরিস্থিতি সামাল দেওয়া সম্ভব নয়। আমাদের মনে রাখতে হবে বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রায় ৯০ ভাগ অবদান রাখে বেসরকারি খাত। বেসরকারি শিল্পোদ্যোক্তা, ব্যবসায়ী, ক্ষুদ্র, মাঝারি শিল্প এবং ছোট ছোট শিল্প কারখানা এ দেশের অর্থনীতির প্রধান শক্তি। বাংলাদেশের মোট কর্মসংস্থানের ৯০ ভাগের বেশি বেসরকারি খাত থেকে আসে। এই যে বিনিয়োগ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হলো, এ বিনিয়োগ সম্মেলনে যেসব বিনিয়োগকারী বাংলাদেশে বিনিয়োগের জন্য প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন, তারা বিনিয়োগ করবেন বেসরকারি খাতেই। কিন্তু বেসরকারি খাত যদি আতঙ্কিত থাকে, উদ্বিগ্ন থাকে এবং সরকার যদি তাদের আস্থায় না নেয় তাহলে এ ধরনের বেসরকারি বিনিয়োগ প্রতিশ্রুতিগুলো বাস্তবায়িত হবে না। আর এ কারণেই সরকারকে এখন বেসরকারি খাতকে আস্থায় নিতে হবে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যখন ৩৭ শতাংশ শুল্ক আরোপ করলেন, তখন বাণিজ্য উপদেষ্টার উচিত ছিল পোশাক খাতের ব্যবসায়ী এবং মালিকদের সঙ্গে দ্রুত বৈঠক করা। এ বৈঠকের মাধ্যমে তাদের আস্থায় নেওয়া, তাদের পরামর্শ নেওয়া। কারণ ৩৭ শতাংশ শুল্কের পর পরিস্থিতি কী হবে? প্রতিযোগিতামূলক বাজারে বাংলাদেশকে কীভাবে মোকাবিলা করতে হবে সেটা সবচেয়ে ভালো জানেন পোশাক খাতের মালিকরাই। পোশাক খাতের মালিকরা সরাসরি ক্রেতাদের সঙ্গে বৈঠক করছেন, কথা বলছেন এবং করণীয় নিয়ে তারা চিন্তাভাবনা করছেন। তাদের চিন্তাভাবনাগুলোকে সামষ্টিক রূপ দিয়ে সরকারের একটি রূপপরিকল্পনা গ্রহণ করা উচিত। অর্থনীতিতে যে সংকটগুলো এখন চলছে সেই সংকট সমাধানের পথও খুঁজে পেতে হবে বেসরকারি উদ্যোক্তাদের মাধ্যমে। আমরা জানি যে বেসরকারি শিল্পোদ্যোক্তারা তাদের কারখানা এবং ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানকে সচল রাখতে চান। শুধু নিজেদের প্রয়োজনে নয়, দেশের স্বার্থে তাদের রয়েছে অসাধারণ উদ্ভাবনী প্রাণশক্তি, কর্মমুখরতা। এই কর্মমুখরতা এবং উদ্দীপনাকে অন্তর্বর্তী সরকার কাজে লাগাতে পারে। বাংলাদেশের বেসরকারি খাত আমাদের অর্থনীতির প্রধান চালিকাশক্তি। তারাই আমাদের অর্থনীতিকে আজকের জায়গায় নিয়ে এসেছে। ছোট উদ্যোক্তা থেকে শুরু করে বড় বড় শিল্প গ্রুপগুলোই বাংলাদেশের অর্থনীতিকে বাঁচিয়ে রেখেছে। তাদের দূরে ঠেলে দিয়ে বা তাদের মধ্যে বিভেদ বিভক্তি সৃষ্টি করে অর্থনীতিকে চাঙা করা যাবে না। আমরা একটা কঠিন বিশ্ব বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে একদিকে যেমন বৈদেশিক নানা প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হচ্ছে, অন্যদিকে একটি অনিশ্চিত রাজনৈতিক ভবিষ্যতের কারণে বিনিয়োগকারী শিল্পপতিরা বিনিয়োগের নতুন উদ্যোগ গ্রহণে আগ্রহ দেখাচ্ছেন না। তা ছাড়া ৫ আগস্টের পর থেকে আমরা লক্ষ করেছি যে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কোনো কোনো মহল আক্রমণাত্মক আচরণ করছে। তাদের নানা রকম অপবাদ দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। আমরা সবাই জানি যে বিগত ১৫ বছর বাংলাদেশের কী অবস্থা ছিল। ব্যবসায়ীদের ব্যবসা করার জন্য সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক করতেই হবে এর কোনো বিকল্প ছিল না। এটি বাংলাদেশের বাস্তবতা। যেখানে একটি গ্যাসের লাইন পাতার জন্য মন্ত্রী বা নীতিনির্ধারকদের কাছে ধরনা দিতে হয়। ব্যাংকঋণের জন্য সরকারের সুনজরে থাকতে হয়। এই বাস্তবতাকে যদি কেউ অস্বীকার করে কোনো ব্যবসায়ীকে ফ্যাসিবাদের দোসর বা সাবেক সরকারের সুবিধাভোগী হিসেবে তকমা দেওয়া হয়, সেটা হবে দুর্ভাগ্যজনক। কারণ ব্যবসায়ীরা কোনো দলের নন, ব্যবসায়ীরা কোনো ব্যক্তিকে সমর্থন করেন না। তাদের দায়বদ্ধতা শুধু দেশের প্রতি।
৮ এপ্রিল বিনিয়োগ সম্মেলনে বিডার নির্বাহী পরিচালক একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, ‘রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের ফলে যেন বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে। ’ এটি হলো সব শিল্পোদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীর মনের কথা। সরকার যাবে, সরকার আসবে। কিন্তু ব্যবসায়ীরা দেশের অর্থনীতির চাকাকে সচল রাখবে। তাদের যদি হাত পা বেঁধে দেওয়া হয়, তাদের কাজে যদি প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হয় তাহলে কোনোভাবেই সেটি ইতিবাচক ফলাফল বয়ে আনবে না। এটি অর্থনীতিকে আরও সংকটের গভীরে নিয়ে যাবে। এখন শুধু বাংলাদেশ নয়, গোটা বিশ্ব একটা অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের মুখে। মার্কিন-চীনের বাণিজ্যযুদ্ধ ইতোমধ্যেই শুরু হয়ে গেছে। এ কঠিন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশকে খুব সাবধানে এগোতে হবে। আমাদের পথপরিক্রমা কী হবে, সে ব্যাপারে শুধু আমলাদের ওপর নির্ভর করলে চলবে না। একেবারে মাঠে যারা যুদ্ধ করছেন, সেসব অর্থনৈতিক যোদ্ধা হলেন আমাদের শিল্পপতি, ব্যবসায়ী এবং দেশি বিনিয়োগকারী। তাদের আস্থায় নিতে হবে। তাদের সঙ্গে বৈঠক করতে হবে। সরকার যদি রাজনৈতিক সংস্কারের জন্য রাজনীতিবিদদের সঙ্গে বারবার বৈঠক করে, তাহলে অর্থনৈতিক সংস্কারের জন্য বেসরকারি শিল্পোদ্যোক্তা বা শিল্পপতিদের সঙ্গে বারবার বৈঠক করতে অসুবিধা কোথায়? তাদের বাস্তব অভিজ্ঞতা দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা পুনরুদ্ধারের ক্ষেত্রে একটি বড় ভূমিকা রাখতে পারে বলে অনেকে মনে করেন।
প্রধান উপদেষ্টা একজন বিচক্ষণ মানুষ। তিনি উদার মনের অধিকারী। যেকোনো প্রয়োজনে তিনি সবাইকে ডেকে ডেকে আলাপ-আলোচনার একটি গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি চালু করেছেন। তাঁর সঙ্গে সাক্ষাতের যে আমলাতন্ত্র বাধাও তিনি দূর করেছেন। এখন তাঁর দ্রুত উচিত বেসরকারি শিল্পোদ্যোক্তা, ব্যবসায়ীদের সঙ্গে অবিলম্বে বৈঠক করা। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে আশু, মধ্য এবং দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার একটি রূপরেখা প্রণয়ন করা। বর্তমান বিশ্বপরিস্থিতি আমাদের মোকাবিলা করতে হবে সম্মিলিতভাবে।
লেখক : নাট্যকার ও কলাম লেখক
ইমেইল : auditekarim@gmail.com