দিনাজপুর: সুন্দরভাবে ইংরেজিতে কথা বলাটা প্রত্যেক শিক্ষার্থীর স্বপ্ন থাকে। অনেকেই এজন্য বিভিন্ন কোর্সও করে থাকেন।
ইংরেজিতে ভ্লগ বানিয়ে ব্যাপক ভাইরাল হয়ে ইংলিশ ম্যান নামে পরিচিতি পেয়েছেন তিনি। হৃদয় চন্দ্র পেশায় একজন ট্রাকচালক। প্রতিদিন কাজে যাওয়া থেকে শুরু করে বিভিন্ন কর্মস্থলে গিয়েও ইংরেজি ভাষায় ভ্লগ তৈরি করে থাকেন তিনি। বর্তমানে তিনি কাজের পাশাপাশি অবসর সময়ে অনলাইনে ৭০ জন আর বাড়িতে ৭ থেকে ৮ জনকে ইংরেজিতে পাঠদান করেন।
হৃদয়ের এমন সাফল্যে খুশি এলাকাবাসী। কথা হলে হৃদয়ের প্রতিবেশী মাগফুর রহমান বলেন, ছোট থেকেই আমরা হৃদয়কে দেখে এসেছি। ছেলে হিসেবে সে অনেক ভালো। কাজ করা, আচার ব্যবহার সব দিক থেকেই সে পারফেক্ট। হৃদয় ইংরেজিতে খুব সুন্দরভাবে কথা বলতে পারে। হৃদয় কাজের পাশাপাশি এটা চর্চা করতে করতে এই পর্যায়ে এসেছে। আমরা যেটা পারিনি হৃদয় সেটা করে দেখিয়েছে। তার জন্য এলাকার পরিচিতি আর সুনাম বেড়েছে। আমরা তার এই সাফল্যের জন্য গর্বিত।
মতিজাপুর এলাকার ফাহিম ইসলাম বলেন, হৃদয় অনেক কষ্ট করে লেখাপড়া চালাচ্ছিলেন। যদিও শেষ পর্যন্ত তা সম্পূর্ণ করতে পারেননি। তবুও তিনি ভালো ইংরেজিতে কথা বলতে পারেন। অনেক শিক্ষার্থীও এমন সুন্দরভাবে ইংরেজিতে কথা বলতে পারেন না। আমাদের সাথে দেখা হলেও তিনি ইংরেজিতে কথা বলেন। আমাদের কাছে খুব ভালোই লাগে।
সাধুপাড়া এলাকার শান্ত রায় বলেন, কাজের মধ্যেও হৃদয় দাদা তার ইংরেজি চর্চা ধরে রেখেছেন। আমরা এখন তার কাছ থেকে ইংরেজি শিখছি। আমার মতো অনেকেই তার কাছে ইংরেজি শিখে। কিন্তু কাজের জন্য বেশিক্ষণ সময় দিতে পারে না। সে যদি তার লেখাপড়াটা সম্পন্ন করতে পারতেন, তাহলে ভবিষ্যতে আরও ভালো কিছু করতে পারতেন।
সরেজমিনে দেখা যায়, ট্রাক্টরে বসে ইংরেজিতে ভ্লগ তৈরি করছেন হৃদয় চন্দ্র। ইংরেজি বিষয়ে অনেক নির্দেশনা তার সেই ভ্লগে। কাজে যাওয়ার আগে তিনি এভাবেই ভ্লগ তৈরি করে থাকেন।
কথা হয় হৃদয়ের বড় নয়ন চন্দ্র রায়ের সঙ্গে। তিনি বলেন, আমি ইংলিশম্যান হৃদয়ের বড় ভাই। যে একটি পজিশনে গেছে তাতে আমাকে খুব ভালো লাগে। তার অক্লান্ত পরিশ্রমের কারণে এখন বেশ পরিচিত। তার একটি কর্মের ফল, তার এই সাফল্যে আমরা আনন্দিত। তার এলাকায় জনপ্রিয়তা রয়েছে। মানুষ তাকে খুব ভালোবাসে। আমাদের আর্থিক অনটনের ওই পড়ালেখা বন্ধ হয়ে যায়। মূলত করোনা দুর্যোগ,আর্থিক অনটনের জন্য পড়ালেখা থেকে ছিটকে পড়েছে। আমরা দুই ভাই এখন কাজ করি। সরকারের কাছে আবেদন, যদি হৃদয়ের পড়ালেখার ব্যবস্থা করে দিতে পারে তাহলে সে দেশের জন্য ভালো কিছু করতে পারবে।
হৃদয়ের মা রাঁধা রানি রায় বলেন, ছোট থেকেই সে ভালো ছাত্র ছিল। মনে করতাম তার ভালো ভবিষ্যৎ। কিন্তু অভাব-অনটনের জন্য এবং তার বাবা কাজ করতে না পারায় পড়ালেখা বন্ধ হয়ে যায়। পরে সে কাজে যোগদান করেন, এখন কোনোমতে সংসার চলে। তার এই সাফল্যে আমি খুশি, আমি ভগবানের কাছে আবেদন করি হে ভগবান আমার ছেলে যেন আরও বড় হতে পারে।
হৃদয়ের বাবা সুধীর চন্দ্র রায় বলেন, আমার ছেলেকে কষ্ট করে মানুষ করেছি। আমার আশা-আকাঙ্ক্ষা ছিল ছেলেকে পড়ালেখা করাবো। কিন্তু এইচএসসি পাস করার পর আর সংসার চালাতে পারছিলাম না। আমার আয়-উপার্জন বন্ধ হয়ে যায়। পরে তাকে ট্রাক্টর চালনা শিখিয়ে দেই। এখন সে তার বড় ভাইয়ের সাথে কাজকর্ম করে সংসার চালাচ্ছে। তার যে ইংরেজিতে কথা বলা এখন এই বিষয়টি এলাকার সবাই জানে। এখন আমাকে অনেকেই হৃদয়ের বাবা হিসেবে চেনে। এটা আমাকে খুব ভালো লাগে, আমি গর্বিত হই।
কথা হলে হৃদয় বলেন, ২০১৮ সালে এসএসসি পরীক্ষায় পাস করি আর ২০২০ সালে এইচএসসি। এরপর সারা বিশ্বে করোনার প্রভাব। বাবা ট্রাক্টরচালক, তার উপার্জনের সংসারের আয়-উপার্জন বন্ধ। অভাব-অনটনে আর অনার্সে ভর্তি হতে পারিনি। বাবা একটু অসুস্থ হয়ে পড়লে বড় ভাই নয়ন চন্দ্র রায়ের সাথে ট্রাক চালানো শিখি।
তিনি বলেন, প্রথমে একা একাই ইংরেজিতে কথা বলতে চেষ্টা করি। ইউটিউব দেখে দেখে ইংরেজিতে দক্ষ হওয়ার কৌশল আয়ত্ত করতে চেষ্টা করি। পরবর্তীতে আমার ভাইয়ের সাথে ইংরেজি ভাষায় কথা বলতে চেষ্টা করি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি পেজ রয়েছে। যেটির নাম হৃদয় চন্দ্র। সেই মাধ্যমেই আমি ইংরেজিতে ভ্লগ তৈরি করি।
পড়ালেখা সম্পন্ন করার ইচ্ছা আছে কি না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ছোট থেকেই আমার পড়ালেখার আগ্রহ। তাই কাজের পাশাপাশি কষ্ট করে হলেও এইচএসসি পাস করেছি। অনার্সে খরচ বেশি। যেটা চালানো আমার পক্ষে কষ্ট সাধ্য। তবে কোনো ধরনের সহযোগিতা পেলে পড়ালেখা চালিয়ে যাওয়ার কথা জানান তিনি।
ওই ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক সদস্য আনোয়ার হোসেন নান্নু বলেন, হৃদয় আমাদের ভাতিজা ও প্রতিবেশী। হৃদয়ের ব্যাপারে অনেক শুনেছি। তার যে চর্চা তা সত্যিই প্রশংসার দাবিদার। আমাদের গ্রামের উজ্জ্বল আলো হৃদয়। তার মাধ্যমে এলাকার ছেলে-মেয়েরা জ্ঞান আহরণ করছে। তাকে নিয়ে আমরা গর্ব করি। আমরা চাই সে লেখাপড়া সম্পন্ন করে আরও সামনে এগিয়ে যাক।
প্রবল ইচ্ছা শক্তির কাছে কোনো বাধা যে টিকে না তা আবারও প্রমাণ করলেন হৃদয় চন্দ্র। দারিদ্র্য জয় করে আর পড়ালেখা মাঝপথে থামিয়ে দিয়েও নিজ প্রচেষ্টায় হৃদয় চন্দ্র থেকে তিনি এখন ইংলিশম্যান হৃদয় চন্দ্র।
বাংলাদেশ সময়: ১৭৩৩ ঘণ্টা, এপ্রিল ১০, ২০২৫
এএটি