দালাই লামার উত্তরসূরি কে হবেন, সেটি এখন আর শুধু ধর্মীয় বিষয় নয়। বিষয়টি জড়িয়ে পড়েছে আন্তর্জাতিক কূটনীতি ও শক্তির খেলায়।
১৪তম দালাই লামা এরইমধ্যে নিশ্চিত করেছেন, তার মৃত্যুর পরেও একজন উত্তরসূরি থাকবেন, যিনি তিব্বতি বৌদ্ধদের আধ্যাত্মিক নেতৃত্বের দায়িত্ব চালিয়ে যাবেন। কদিন আগেই তিনি এই ঘোষণা দেন। দালাই লামা জানান, তিব্বতের বিভিন্ন ধর্মীয় নেতা, ভারতের ধর্মশালায় অবস্থিত নির্বাসিত তিব্বতি সংসদ এবং নির্বাসিত সরকার—এদের সবাই তাকে লিখিতভাবে অনুরোধ করেছেন যেন দালাই লামা প্রতিষ্ঠানের ধারাবাহিকতা বজায় থাকে।
শুধু তাই নয়, তিব্বত এবং চীনের মূল ভূখণ্ড থেকে শুরু করে সারা বিশ্বের বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরাও তার কাছে এ ধরনের অনুরোধ পাঠিয়েছেন। তিনি বলেন, সব অনুরোধের কথা বিবেচনা করে আমি জানাচ্ছি, দালাই লামা প্রতিষ্ঠানের উত্তরসূরি থাকবে এবং এটি চলতে থাকবে।
সারা বিশ্বের বৌদ্ধ পণ্ডিত ও ভিক্ষুরা ভারতের ধর্মশালার ম্যাকলিওডগঞ্জ শহরে জড়ো হয়েছেন দালাই লামার ৯০তম জন্মদিন উদযাপনের জন্য। এই শহরটিই বর্তমানে নির্বাসিত তিব্বতি বৌদ্ধদের প্রধান কেন্দ্র। অনেকেই একে ‘লিটল লাসা’ নামেও ডাকেন। এখানে দালাই লামার নেতৃত্বে তিন দিনব্যাপী এক গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় সম্মেলনও অনুষ্ঠিত হবে।
তবে এই আয়োজনের গুরুত্ব শুধু ধর্মীয়ই নয়। পরবর্তী দালাই লামাকে কীভাবে বাছাই করা হবে, কে তাকে নির্বাচিত করবে—এই প্রশ্নের সঙ্গে জড়িয়ে আছে বড় ধরনের আন্তর্জাতিক রাজনীতি। বহু শতাব্দী ধরে তিব্বতি বৌদ্ধদের ঐতিহ্য অনুযায়ী, বর্তমান দালাই লামার মৃত্যুর পর বহু অনুসন্ধান ও দীর্ঘ প্রশিক্ষণের মাধ্যমে নতুন দালাই লামাকে খুঁজে বের করা হয়।
কিন্তু এবার যদি ১৪তম দালাই লামা জীবিত অবস্থায় তার উত্তরসূরির নির্বাচন পদ্ধতি বা সম্ভাব্য ব্যক্তির বিষয়ে বিস্তারিত কিছু জানান, তাহলে তা হবে শত বছরের প্রচলিত রীতির এক বড় ধরনের পরিবর্তন। তিনি কী বলেন, আর কী বলেন না—তা খুব সতর্কভাবে পর্যবেক্ষণ করে ওয়াশিংটন, নয়াদিল্লি ও বেইজিং।
দালাই লামা ১৯৫৯ সালে তিব্বত থেকে পালিয়ে ভারতে যান এবং পরে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। বেইজিং তাকে বিচ্ছিন্নতাবাদী হিসেবে দেখে। তাই দালাই লামার সর্ব সাম্প্রতিক মন্তব্যের পর চীন দ্রুত প্রতিক্রিয়া জানায়। চীনের দাবি, পরবর্তী দালাই লামা নির্বাচনে তাদেরই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা রয়েছে।
দালাই লামা গত ৬৬ বছর ধরে ভারতে অবস্থান করছেন। দেশটি তার প্রতিষ্ঠানের ভবিষ্যতের সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত। ভারতের স্বাধীনতার পর থেকে সব প্রধানমন্ত্রীই দালাই লামার সঙ্গে পরিচিত ছিলেন এবং তার সঙ্গেও দীর্ঘদিনের সম্পর্ক রয়েছে দেশটির। আর তাইতো বৃহস্পতিবার চীনের প্রতি কড়া বার্তা দেন ভারতের সংখ্যালঘুবিষয়ক মন্ত্রী কিরেন রিজিজু। এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, দালাই লামার উত্তরসূরি কে হবেন, তা একমাত্র দালাই লামাই নির্ধারণ করবেন। অন্য কেউ নয়।
ভারতের সংখ্যালঘুবিষয়কমন্ত্রী কিরেন রিজিজু বলেন, দালাই লামাকে যারা অনুসরণ করেন, তারা বিশ্বাস করেন যে নতুন দালাই লামা নির্বাচিত হবেন প্রচলিত নিয়ম অনুসারে এবং দালাই লামার ইচ্ছার ভিত্তিতে। এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার তার এবং প্রচলিত রীতিনীতি ছাড়া আর কারও নেই।
তিব্বতি নির্বাসিত আন্দোলনকে দীর্ঘদিন ধরে চীনের মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রমাণ হিসেবে তুলে ধরে আসছে যুক্তরাষ্ট্র। তারা চায় দালাই লামার নেতৃত্বের এই প্রতিষ্ঠান যেন ভবিষ্যতেও টিকে থাকে। কারণ, এই প্রতিষ্ঠানই তিব্বতি আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু। এখন প্রশ্ন উঠছে—কে পরবর্তী দালাই লামাকে নির্বাচিত করবে? বর্তমান দালাই লামা কি চীনা সরকারকে চমকে দিতে পারেন? দুই দালাই লামা নির্ধারণের সম্ভাবনাও কি তৈরি হতে পারে?
দালাই লামা কীভাবে নির্বাচিত হন?
তিব্বতীয় বৌদ্ধধর্মে দালাই লামাকে বোধিসত্ত্ব করুণার দেবতা অবলোকিতেশ্বরের পুনর্জন্ম হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ধারাবাহিক পুনর্জন্মের মাধ্যমে একজন দালাই লামা থেকে আরেকজন দালাই লামার আগমন ঘটে, এমনটিই বিশ্বাস করা হয়ে থাকে।
দালাই লামার মৃত্যু হলে সাধারণত শোকের সময় শেষে তার উত্তরসূরি খোঁজার কাজ শুরু হয়। উচ্চপদস্থ লামারা (বৌদ্ধ ধর্মগুরু) মিলে একটি অনুসন্ধান কমিটি গঠন করেন। প্রাচীন বিশ্বাস অনুযায়ী, মৃত দালাই লামার দাহক্রিয়ার সময় ধোঁয়া কোন দিকে উড়ল, মৃত্যুর আগে তিনি কোন দিকে তাকিয়ে ছিলেন, তিব্বতের পবিত্র লামো লাতসো হ্রদের তীর্থ দর্শনে কী বার্তা এলো—এমন সব আধ্যাত্মিক সংকেতের ওপর ভিত্তি করে তারা উত্তরসূরির সন্ধান করেন।
প্রত্যাশিত উত্তরসূরি সাধারণত এমন একটি শিশুই হয়, যার জন্ম হয় আগের দালাই লামার মৃত্যুর কাছাকাছি সময়ে। ছোট শিশুটিকে নানা পরীক্ষা দিতে হয়—সে সত্যিই দালাই লামার পুনর্জন্ম কি না, তা নিশ্চিত করতে। তবে বর্তমান দালাই লামা বলেছেন, ভবিষ্যতে মেয়ে শিশুর মধ্যেও দালাই লামার পুনর্জন্ম হতে পারে।
উত্তরসূরি নির্ধারিত হলে সেই শিশুকে বৌদ্ধ দর্শন, ধর্মগ্রন্থ ও নেতৃত্বের কঠিন শিক্ষা দেওয়া হয়, যেন সে ভবিষ্যতে তিব্বতীয়দের আধ্যাত্মিক এবং ঐতিহ্যগত রাজনৈতিক নেতা হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে পারে।
বর্তমান দালাই লামা কে এবং কীভাবে তিনি নির্বাচিত হয়েছিলেন?
বর্তমান দালাই লামার নাম তেনজিন গিয়াৎসো। তিনি ১৪তম দালাই লামা। তিনি ১৯৩৫ সালের ৬ জুলাই চীনের বর্তমান চিংহাই প্রদেশের একটি কৃষক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার নাম ছিল লামো ধোন্দুপ। মাত্র দুই বছর বয়সেই তাকে আগের দালাই লামার পুনর্জন্ম হিসেবে শনাক্ত করা হয়।
১৩তম দালাই লামার মৃত্যুর পর অনুসন্ধানকারী দল প্রায় চার বছর ধরে উত্তরসূরির খোঁজ চালায়। শেষ পর্যন্ত ছোট্ট লামো ধোন্দুপকে নিয়ে যাওয়া হয়, যেখানে তিনি আগের দালাই লামার ব্যবহৃত জিনিস চিনে নিয়ে বলেছিলেন, ‘এটা আমার, এটা আমার। ’ এটি ছিল তার পুনর্জন্ম হওয়ার অন্যতম বড় প্রমাণ।
বেশিরভাগ দালাই লামার জন্ম তিব্বতে হলেও, ইতিহাসে একজন দালাই লামা মঙ্গোলিয়ায় এবং আরেকজন ভারতের বর্তমান উত্তর-পূর্বাঞ্চলে পাওয়া গিয়েছিল।
১৯৫৯ সালের মার্চে চীনা শাসনের বিরুদ্ধে তিব্বতে ব্যর্থ বিদ্রোহের পর দালাই লামা ছদ্মবেশে লাসা থেকে পালিয়ে যান। তিনি পাহাড় ও দুর্গম পথ পেরিয়ে ঘোড়ায় ও হেঁটে ভারত পৌঁছান ৩১ মার্চ। বর্তমানে প্রায় এক লাখ তিব্বতি শরণার্থী ভারতের বিভিন্ন স্থানে বাস করছেন। দালাই লামার পালিয়ে যাওয়ার মধ্য দিয়েই তিব্বতের ঐতিহ্যবাহী শাসন ব্যবস্থার অবসান ঘটে এবং শুরু হয় তার নির্বাসিত জীবনের, যেখান থেকে তিনি তিব্বতের স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন পরিচালনা করে আসছেন।
১৪তম দালাই লামা তার উত্তরসূরি সম্পর্কে কী বলেছেন?
জুনের ৩০ তারিখ, ম্যাকলিওডগঞ্জে অনুসারী ও ভিক্ষুদের সামনে উপস্থিত হয়ে ১৪তম দালাই লামা বলেন, দালাই লামার প্রতিষ্ঠান যেন চলমান থাকে, সে জন্য একটি কাঠামো থাকবে। তিনি আরও বলেন, আমি মনে করি, আমি ধর্ম এবং সমস্ত জীবজন্তুর সেবা করতে পেরেছি এবং এ কাজ চালিয়ে যাওয়ার জন্য আমি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। ৯০ বছর বয়সেও তিনি নিজেকে শারীরিকভাবে সুস্থ এবং ভালো বোধ করছেন বলেও জানান।
আগামী দালাই লামার কোথায় খুঁজে পাওয়া যাবে সে সম্পর্কে তিনি ইঙ্গিত দিয়েছেন। তার বই ‘ভয়েস ফর দ্য ভয়েসলেস’ (২০২৫ সালের মার্চে প্রকাশিত)-এ তিনি লেখেন, নতুন দালাই লামা হবে মুক্ত পৃথিবীতে জন্মানো কোনো শিশু। অর্থাৎ, তিনি পরিষ্কার করে দিয়েছেন যে তার পুনর্জন্ম চীন বা চীন নিয়ন্ত্রিত তিব্বতে হবে না। এর আগে তিনি বলেছিলেন যে তার পুনর্জন্ম ভারতেও হতে পারে।
তিব্বত সরকারের নির্বাসিত শাখার সঙ্গে কাজ করা ম্যাকলিওডগঞ্জের বাসিন্দা ৩৯ বছর বয়সী তেনজিন জিগমে বলেন, দালাই লামা চলে যাওয়ার কথা ভাবলেই মন ভারী হয়ে যায়। আমরা সবাই মুক্ত পৃথিবীতে বাস করি, কারণ তিনি আমাদের এখানে নিয়ে এসেছেন।
তিনি বলেন, নির্বাসিত হিসেবে আমাদের জন্য তার পিতা সদৃশ ভূমিকা রয়েছে। আমরা তার পুনর্জন্ম চাই, কারণ এই কঠিন সময়ে আমাদের এমন কাউকে দরকার, যিনি দয়া শেখান।
উত্তরসূরি না থাকার কোনো ঝুঁকি ছিল?
১৪তম দালাই লামা আগে ইঙ্গিত দিয়েছিলেন, হয়তো তার কোনো উত্তরাধিকারী নাও থাকতে পারে। ২০১১ সালে তিনি বলেছিলেন, যখন তিনি ৯০ বছর বয়সে পৌঁছাবেন, তখন অন্য লামা ও তিব্বতি জনগণের সঙ্গে পরামর্শ করবেন এবং দালাই লামার প্রতিষ্ঠানের ভবিষ্যৎ চালিয়ে নেওয়া হবে কি না, তা নতুন করে বিবেচনা করবেন।
২০১৪ সালে রোমে অনুষ্ঠিত নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ীদের বিশ্ব সম্মেলনে অংশ নিতে গিয়ে এই আধ্যাত্মিক নেতা বলেছিলেন, তার মৃত্যুর পর আরেকজন দালাই লামাকে দায়িত্ব দেওয়া হবে কি না, তা সেই সময়ের পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করবে এবং এটি তিব্বতি জনগণের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী হবে।
বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে দালাই লামা বলেছিলেন, দালাই লামার প্রতিষ্ঠান একদিন বন্ধ হয়ে যাবে। মানুষের তৈরি এই ধরনের প্রতিষ্ঠান একসময় শেষ হয়। তিনি আরও বলেন, পরবর্তী সময়ে যদি কোনো বোকা দালাই লামা আসেন, যিনি নিজেকে বা প্রতিষ্ঠানকে অপমানিত করবেন, তাহলে তা অত্যন্ত দুঃখজনক হবে। তাই বরং ভালো হবে, কয়েক শতাব্দীপ্রাচীন এই ঐতিহ্য তখনই বন্ধ হোক, যখন একজন জনপ্রিয় দালাই লামার সময়ই চলছে।
লন্ডনের ওয়েস্টমিনস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক দিব্যেশ আনন্দ বলেন, আগামী কয়েক দশকে দালাই লামার প্রতিষ্ঠান বড় ধরনের অনিশ্চয়তার মুখে পড়বে। তবে তিনি বলেন, ইতিহাসে দেখা যায়, দালাই লামার এই প্রতিষ্ঠান অনেক বেশি নমনীয় এবং টিকে থাকার ক্ষমতায় শক্তিশালী, অনেক রাষ্ট্রের তুলনায়ও বেশি।
তিনি আরও বলেন, ভবিষ্যতে নির্বাসিত দালাই লামারা হয়তো আর প্রচলিত অর্থে রাজনৈতিক ক্ষমতা রাখবেন না, তবে তারা তিব্বতি জাতির প্রতীক এবং তিব্বতি বৌদ্ধধর্মের সবচেয়ে সম্মানিত নেতা হিসেবেই থেকে যাবেন।
চীনের অবস্থান কী?
চীন বলছে, দালাই লামার পরবর্তী জন্ম (পুনর্জন্ম) অনুমোদনের অধিকার শুধু চীনা সরকারের। তাদের মতে, এটি তাদের দেশের আইন ও ধর্মীয় নিয়মের অংশ। ২০০৭ সালে চীন এক আইন করে, যেখানে বলা হয়, তিব্বতি বৌদ্ধ ধর্মের সব নতুন নেতা নির্বাচন চীনের অনুমতি নিয়ে হতে হবে এবং সেটা তাদের নিয়ম মেনে হবে।
চীন বারবার বলছে, পরবর্তী দালাই লামার জন্ম অবশ্যই চীনের ভেতর হতে হবে। যদি তিনি বিদেশে জন্মান বা তিব্বতি নির্বাসিতরা কাউকে নেতা ঠিক করে, তাহলে চীন তাকে মানবে না। চীন বলছে, দালাই লামা নির্বাচনের জন্য ‘স্বর্ণপাত্র’ নামে এক পুরনো পদ্ধতি আছে। এই পদ্ধতিতে কয়েকজনের নাম একটি স্বর্ণের পাত্রে রাখা হয়, তারপর লটারির মতো করে একজনকে বেছে নেওয়া হয়।
বুধবার চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আবার বলেছে, দালাই লামা, পাঞ্চেন লামা এবং বড় বড় বৌদ্ধ নেতাদের নির্বাচন এই স্বর্ণপাত্র পদ্ধতিতে হতে হবে এবং অবশ্যই চীনা সরকারের অনুমোদন নিতে হবে। চীন বলছে, তারা ধর্ম পালনের স্বাধীনতা দেয়, তবে ধর্মীয় বিষয়ে কিছু নিয়ম আছে, আর তিব্বতিরা তাদের ধর্মীয় নেতাকে কীভাবে নির্বাচন করবে, সেটারও নিয়ম আছে।
কিন্তু বর্তমান দালাই লামা এই স্বর্ণপাত্র পদ্ধতি পছন্দ করেন না। তিনি মনে করেন, এই পদ্ধতিতে ধর্মীয় ভাব বা আধ্যাত্মিক গুণ থাকে না। ২০১৫ সালে তৎকালীন তিব্বতের গভর্নর বলেছিলেন, দালাই লামা ধর্ম অবমাননা করছেন এবং বেইজিংয়ের সিদ্ধান্তের উপর নিজের নিয়ন্ত্রণ বসাতে চাইছেন। তিনি আরও বলেছিলেন, দালাই লামা যদি বলেন, তার আর পুনর্জন্ম হবে না, সেটা কেউ মেনে নেবে না।
সাধারণভাবে, নতুন দালাই লামা খোঁজা শুরু হয় বর্তমান দালাই লামার মৃত্যুর পর। কিন্তু চীনের জোরালো অবস্থানের কারণে নির্বাসিত তিব্বতি ও ভিক্ষুরা চিন্তিত। তারা মনে করছেন, চীন জোর করে দালাই লামার নির্বাচন নিজের নিয়ন্ত্রণে নিতে চায়।
অধ্যাপক দিব্যেশ আনন্দ বলেন, দালাই লামা তিব্বতিদের আন্দোলনের প্রাণ এবং তিনি বিশ্বে পরিচিত একজন নেতা। এটি চীনের জন্য সমস্যা। তিনি বলেন, এটি মূলত বৈধতা নিয়ে লড়াই। চীন এই লড়াই জিততে চায়, কিন্তু ১৪তম দালাই লামা এবং তার প্রতিষ্ঠান চীনের নিয়ন্ত্রণের বাইরে।
আরেক গবেষক রবার্ট বার্নেট বলেন, কিছু চীনা পরিকল্পনাকারী এই সুযোগটিকে নির্বাসিত তিব্বতিদের কার্যক্রম ব্যাহত করার উপায় হিসেবে দেখেন। তিনি বলেন, চীন হয়তো ভবিষ্যতে তিব্বতিদের নতুন করে বিক্ষোভ করার আশঙ্কা করছে। তাই তারা এমন একজন ‘অনুগত’ দালাই লামা তৈরি করতে চায়, যিনি তিব্বতিদের আন্দোলন থামিয়ে দিতে পারবেন।
চীন কি আগেও দালাই লামার উত্তরসূরি নির্বাচনে হস্তক্ষেপ করেছে?
হ্যাঁ, চীন এর আগেও এমন করেছে। ১৯৯৫ সালে দালাই লামা তিব্বতের এক ছোট ছেলেকে পাঞ্চেন লামার পুনর্জন্ম বলে ঘোষণা দেন। ছেলেটির নাম ছিল গেধুন চোকি নিয়ামা। সে তখন মাত্র ছয় বছর বয়সী। তার বাবা-মা তিব্বতের নাগচু শহরের সাধারণ চাকরিজীবী ছিলেন। এই ঘোষণা দেওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই চীনা কর্তৃপক্ষ ছেলেটিকে তুলে নিয়ে যায়। এরপর তার পরিবারকেও অন্য কোথাও সরিয়ে ফেলা হয়। আজ পর্যন্ত তারা কোথায় আছে, কেউ জানে না।
চীন এরপর নিজের মতো করে আরেকজন পাঞ্চেন লামা ঠিক করে দেয়। কিন্তু তিব্বতিরা, বিশেষ করে যারা নির্বাসনে আছেন, এবং অনেক তিব্বতি এই চীনের মনোনীত পাঞ্চেন লামাকে মানেন না। তারা মনে করেন, চীনের বেছে নেওয়া এই পাঞ্চেন লামা অবৈধ।
গবেষক রবার্ট বার্নেট বলেন, ১৯৯৫ সালের এই ঘটনা ছিল তিব্বত-চীন সম্পর্কের বড় একটা মোড়। তিনি বলেন, চীন তখন থেকে শুধু বেছে নেওয়া নয়, পুরো নিয়ন্ত্রণ নিতে চায়। কোন শিশু বাছাই হবে, কোথায় সে জন্মাবে, কে খুঁজবে—সবকিছু চীন ঠিক করতে চায়।
চীন স্পষ্ট করে জানিয়ে দিয়েছিল, দালাই লামাকে এই প্রক্রিয়া থেকে বাদ রাখতে হবে। এই কারণেই ভবিষ্যতে কোনো দালাই লামার উত্তরসূরি নির্বাচন চীনের ভেতরে হোক, বর্তমান দালাই লামা এবং নির্বাসিত তিব্বতিরা চান না। তারা ভয় পান, ভবিষ্যতে কোনো শিশুকেও হয়তো তুলে নিয়ে যাবে, যেমনটি ৩০ বছর আগে হয়েছিল।
অধ্যাপক দিব্যেশ আনন্দ বলেন, চীন আসলে তিব্বতিদের মনোবল ভাঙতে এবং তাদের বিভক্ত করতে চায়। তিনি বলেন, চীন যদি তিব্বতিদের ভালোবাসা বা বিশ্বাস না পায়, তাহলে তারা ভাগ করে শাসনের পথ বেছে নেয়। দালাই লামার উত্তরসূচি নিয়ে চীনের এই লড়াইকে ঠিক এভাবেই দেখতে হবে।
দুই প্রতিদ্বন্দ্বী দালাই লামা নির্বাচনের সম্ভাবনা কি আছে?
তিব্বতবিষয়ক বিশেষজ্ঞ ও গবেষকরা মনে করেন, ১৪তম দালাই লামার মৃত্যুর পর এমন পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে, যেখানে দুই জন দালাই লামা দেখা যাবে। একজন হবেন নির্বাসিত তিব্বতি সমাজের পছন্দের নেতা, যিনি বর্তমান দালাই লামার অনুসারী অন্য লামারা মনোনয়ন দেবেন। অপরজন হবেন চীনা সরকারের মনোনীত নেতা।
তিব্বতি বৌদ্ধধর্মের ইতিহাসে এমন ঘটনা আগে কখনো ঘটেনি, কিন্তু গবেষক রবার্ট বার্নেট বলেন, এটি খুবই সম্ভব, এটিই হয়তো ঘটবে।
নির্বাসিত তিব্বতিদের কাছে ধর্মীয়ভাবে দুই দালাই লামা তেমন সমস্যা নাও হতে পারে। কিন্তু তিব্বতের ভেতরে বসবাসকারী তিব্বতিদের জন্য এটা হতে পারে বড় সংকট। কারণ তাদের আবার আবার চীনা সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করতে বাধ্য করা হতে পারে।
বার্নেট আরও বলেন, এই উত্তরাধিকার ইস্যু চীন বিদেশি সরকারগুলোর ওপর চাপ দিতেও ব্যবহার করতে পারে, যেন তারা নির্বাসিত তিব্বতিদের সংগঠনগুলোকে দূরে সরিয়ে রাখে।
অধ্যাপক দিব্যেশ আনন্দ বলেন, চীনের জোর করে নিজের মনোনীত দালাই লামা নির্বাচন করার চেষ্টা তিব্বত-চীন সম্পর্ককে অস্থির করে তুলবে এবং একদিন এই সিদ্ধান্ত চীনা কমিউনিস্ট পার্টির জন্যও বিপদ ডেকে আনতে পারে।
২০১৯ সালের মার্চ মাসে এক সাক্ষাৎকারে দালাই লামা নিজেও বলেছিলেন, ভবিষ্যতে দুই দালাই লামা দেখা যেতে পারে। তিনি বলেছিলেন, ভবিষ্যতে যদি এমন হয়—একজন দালাই লামা হবে স্বাধীন দেশে এবং আরেকজন হবে চীনের মনোনীত, তাহলে চীনের নির্বাচিত দালাই লামাকে কেউ বিশ্বাস করবে না, কেউ শ্রদ্ধাও করবে না।
হাসতে হাসতে তিনি আরও বলেন, তাহলে চীনের জন্য আরও একটি সমস্যা তৈরি হবে! এটি সম্ভব, আর এমনটি ঘটতেও পারে।
দালাই লামা নির্বাচন কি একটি ভূ-রাজনৈতিক বিষয়?
হ্যাঁ, বিশেষ করে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের জন্য এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূ-রাজনৈতিক বিষয়। ভারতে তিব্বতি নির্বাসিত সরকার আশ্রয় পেয়েছে। দালাই লামার উত্তরাধিকার দেশটির জাতীয় নিরাপত্তা এবং চীনের সঙ্গে সীমান্ত বিরোধের সঙ্গে সরাসরি জড়িত।
অধ্যাপক দিব্যেশ আনন্দ বলেন, নয়াদিল্লি দালাই লামা ও তার অনুসারীদের আতিথেয়তা ও আশ্রয় দেওয়া অব্যাহত রাখতে চায়। তিনি আরও বলেন, ভারতে থাকা তিব্বতি নির্বাসিতরা ভারতের জন্য একটি কৌশলগত ব্যবধান গড়ে তোলে এবং শক্তি হিসেবে কাজ করে, যা চীনের হিমালয় অঞ্চলে প্রভাব মোকাবিলায় সহায়ক।
তিব্বতে যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহ বেশ আগে থেকেই। ১৯৫০-এর দশকে যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ তিব্বতিদের চীনের দখলদারতের বিরুদ্ধে সহায়তা দিয়েছিল। এরপর থেকে যুক্তরাষ্ট্র সবসময় তিব্বতিদের ধর্মীয় স্বাধীনতার পক্ষেই থেকেছে।
২০১৫ সালে চীন দাবি করেছিল, পরবর্তী দালাই লামা নির্বাচন করার অধিকার শুধু তাদের। তখন যুক্তরাষ্ট্র স্পষ্ট বলেছিল, দালাই লামা কে হবেন, সেটি তিব্বতিরাই ঠিক করবেন।
২০২০ সালে ডোনাল্ড ট্রাম্পের সময় যুক্তরাষ্ট্রে নতুন আইন পাস হয়। সেটি হলো ‘তিব্বত নীতি ও সহায়তা আইন’ । এই আইনে বলা হয়, দালাই লামা নিজেই তার ভবিষ্যৎ পুনর্জন্মের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন। এ ছাড়া, যারা এই প্রক্রিয়ায় বাধা দেবে বা চীনের পক্ষে চাপ সৃষ্টি করবে, তাদের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হবে।
অধ্যাপক আনন্দ বলেন, ভবিষ্যতে দালাই লামা নির্বাচন নিয়ে তিব্বতিরা যে আন্তর্জাতিক সমর্থন পাবে, সেটা চীন-যুক্তরাষ্ট্র এবং চীন-ভারতের মধ্যে বড় রাজনৈতিক প্রতিযোগিতায় পরিণত হবে।
আরএইচ