ফুটবলার হিসেবে ফিলিপে লুইস খেলেছেন যুগান্তকারী কয়েকজন কোচের অধীনে—হোসে মরিনহো, দিয়েগো সিমিওনে, হোর্হে জেসুস—যারা সবাই কমবেশি প্রভাব রেখেছেন তার ফুটবল চিন্তাধারায়। তবে যেটা তার হৃদয়ে গেঁথে আছে, সেটা লুইস আরাগোনেসের সেই বিখ্যাত বাক্য, 'জিততে হবে, আবার জিততে হবে, বারবার জিততে হবে।
আদর্শ নয়, দর্শন নয়—শুধু জেতার রাস্তা খুঁজে বের করা, এবং সেটা ধরে রাখা।
এক সাক্ষাৎকারে ফিফাকে দেওয়া কথায় লুইস বলেন, 'আমি কোনো আদর্শবাদী কোচ না। আমি খুবই বাস্তববাদী। পরের ম্যাচ জেতার বাইরে বড় কিছু ভাবি না। '
এই কথা বলার সময়ও ক্লাব বিশ্বকাপ শুরু হয়নি। এস্পেরঁসকে হারানো হয়নি, চেলসিকে বিধ্বস্ত করা হয়নি, কিংবা গ্রুপ ডি'র শীর্ষে থাকা হয়নি। এই সাফল্যগুলো কেউ আগেই বললে সমর্থকরা হয়তো বিশ্বাসই করত না, আর ফিলিপে লুইস সেটা শুনলে বলতেন—'অতদূর ভাববেন না!'
কিন্তু আট মাস আগে যখন ফ্ল্যামেঙ্গোর দায়িত্ব নেন, তখন থেকেই এই বাস্তববাদী ভাবনা কাজে দিয়েছে।
ব্রাজিলের সবচেয়ে বড় এবং সম্ভবত সবচেয়ে খুঁতখুঁতে সমর্থকগোষ্ঠীর দল ফ্ল্যামেঙ্গোর কোচ হওয়া সহজ কাজ নয়। অনেক নামী কোচ এখানে এসেছেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত বিদায় নিতে হয়েছে হতাশা নিয়ে।
২০১৯ থেকে ২০২৩—এই চার বছরে খেলোয়াড় হিসেবে ১৭৫টি ম্যাচে মাঠে নেমেছেন ফিলিপে লুইস। জিতেছেন দুইটি ব্রাজিলিয়ান শিরোপা ও দুইটি কোপা লিবার্তাদোরেস। সেই অভিজ্ঞতা ছিল সাফল্যের, তবে ব্যর্থতার স্বাদও পেয়েছেন তিনি। সব জেনেই এসেছেন কোচ হয়ে।
২০১৮ বিশ্বকাপে ব্রাজিলের হয়ে খেলা, ৪৪টি আন্তর্জাতিক ম্যাচ, আতলেতিকো মাদ্রিদের হয়ে দুইবার চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনালে ওঠা—এই সব অভিজ্ঞতা নিয়ে যিনি এসেছেন, তিনি শুধু ভালো ফুটবলারই ছিলেন না, বরং ছিলেন একজন চিন্তাশীল মানুষ। সাংবাদিকদের প্রিয়, যিনি রেফারির ভুল নিয়ে নয়, বরং রাজনীতি, বিজ্ঞান কিংবা চলচ্চিত্র নিয়ে কথা বলতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন। একবার বলেছিলেন, 'সিনেমা আমার ব্যক্তিত্ব গড়ে দিয়েছে। '
এমনকি বলেছিলেন, 'আমি অ্যাস্ট্রোফিজিক্সে মুগ্ধ। সব কিছু বুঝতে চাই, যদিও জানি সব কিছু কখনোই বোঝা যাবে না। '
২০২৩ সালের ডিসেম্বরে অবসরের পরেই কোচিংয়ে নামেন। শুরুটা ফ্ল্যামেঙ্গোর অনূর্ধ্ব-১৭ দল দিয়ে, এরপর দ্রুত উঠে যান অনূর্ধ্ব-২০ দলে। আর গত সেপ্টেম্বরে তিতে বরখাস্ত হওয়ার পর সরাসরি প্রথম দলের দায়িত্ব পেয়ে যান।
প্রথমেই তিনি জানান, 'ফ্ল্যামেঙ্গোকে খেলতে হবে আক্রমণাত্মক, চাপে রেখে—এটাই আপসহীন নীতি। '
প্রথম কয়েক সপ্তাহেই তার ছোটখাটো কিছু পরিবর্তন—উচ্চ প্রেসিং, গতিময়তা, পজিশনের হালকা পরিবর্তন—ফল দেয়। দল জিতে নেয় ব্রাজিলিয়ান কাপ।
তার সহকারী কোচ ভিনিসিয়ুস বারগান্তিন বলেন, 'ফিলিপে সবসময় প্রস্তুত থাকতেন, খেলোয়াড়দের সবকিছুর ব্যাখ্যা দিতেন—কেন এই কৌশল, কিভাবে এটা পরবর্তী প্রতিপক্ষের বিপক্ষে কাজে লাগবে। সব কিছুই যুক্তিসম্মত ছিল। '
ফ্ল্যামেঙ্গোর স্পোর্টিং ডিরেক্টর হোসে বোটো বলেন, 'এই মাত্র রিটায়ার করা কেউ এত বিশ্লেষণী, এত নিবেদিতপ্রাণ—এটা সত্যিই বিরল। '
২২ জানুয়ারি থেকে ৯ এপ্রিল পর্যন্ত টানা ১৬ ম্যাচ অপরাজিত ফ্ল্যামেঙ্গো। জিতেছে ১৩টি ম্যাচ। জিতেছে রিও চ্যাম্পিয়নশিপ। সাবেক কিংবদন্তি আন্দ্রাদে বলেন, 'অনেক বছর পর এমন ফুটবল দেখছি। প্রতিপক্ষের অর্ধেই খেলে, আক্রমণের মনোভাব নিয়ে—ঠিক যেমন ৮০ দশকে আমরা খেলতাম। '
দরিভাল জুনিয়র বরখাস্ত হওয়ার পর ব্রাজিল জাতীয় দলের কোচ হিসেবে তার নাম উঠে আসে। তবে ক্লাবের প্রেসিডেন্ট বলেন, 'ফিলিপে এই মুহূর্তে এমন কিছু নেবেন বলে মনে হয় না, যদিও একদিন ব্রাজিল দলের কোচ হবেন, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। '
কিছুটা ফর্মহীনতা আর চ্যালেঞ্জ এসেছে এরপর, তবে তিনি বলেন, 'বাইরের ঝড় নিয়ে চিন্তা করি না। ভেতরে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। আমি আমার কাজে বিশ্বাস রাখি। '
এখন ক্লাব বিশ্বকাপে চেলসিকে হারিয়ে সবার নজর কেড়েছেন। সামনে বায়ার্ন মিউনিখ—আরেকটি বড় মঞ্চের পরীক্ষা।
হোসে বোতো বলেন, 'একজন শীর্ষ কোচ হওয়ার সব গুণই তার মধ্যে আছে। '
সহকারী কোচ বারগান্তিন একটু এগিয়ে গিয়ে বলেন, 'সে তো ইতোমধ্যেই শীর্ষ কোচ হয়ে গেছে। '
এমএইচএম