ঢাকা, শনিবার, ২১ আষাঢ় ১৪৩২, ০৫ জুলাই ২০২৫, ০৯ মহররম ১৪৪৭

ফিচার

এক প্রশ্নে শুরু, গিনেস আজ বিশ্বরেকর্ডের দলিল

আন্তর্জাতিক ডেস্ক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩:৩১, জুলাই ৪, ২০২৫
এক প্রশ্নে শুরু, গিনেস আজ বিশ্বরেকর্ডের দলিল

গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস—এ যেন মানুষের বিস্ময়ের এক দলিল। অদ্ভুত সব কীর্তি বা রেকর্ড লিপিবদ্ধ থাকে এই দলিলে।

শুধু মানুষ নয়, প্রাণী, জিনিস—সব কিছুরই রেকর্ড। আর এই বিখ্যাত বইয়ের শুরুটা হয়েছিল একেবারেই সাধারণ একটি প্রশ্ন থেকে।

১৯৫১ সালের ১০ নভেম্বর। আয়ারল্যান্ডের দক্ষিণ-পূর্বের এক নদীর ধারে শিকারে গিয়েছিলেন স্যার হিউ বিভার। সঙ্গে ছিলেন তার বন্ধু। শিকারের জন্য দিনটি ছিল আদর্শ। হঠাৎ চোখে পড়ে একঝাঁক গোল্ডেন প্লোভার পাখি। বন্দুক তাক করে গুলি ছোড়েন, কিন্তু পাখিগুলোর গায়ে আঁচড়ও লাগেনি।  

হতাশ হয়ে ফিরছিলেন তারা। হাঁটতে হাঁটতে তাদের মনে প্রশ্ন চলে আসে—গোল্ডেন প্লোভার, নাকি পারমিগান, কোন পাখি দ্রুত ওড়ে? হিউ বিভার বাজি ধরলেন—গোল্ডেন প্লোভারই দ্রুততম। তার বন্ধু রাজি হলেন না। কে ঠিক, কেউই জানত না। উত্তর খুঁজে পাননি তখন। কিন্তু এটিই জন্ম দিল এক নতুন চিন্তার।

হিউ বিভার ভাবলেন, এমন একটি বই তৈরি করা যায় কি, যেখানে সব ধরনের রেকর্ড থাকবে! সবচেয়ে বড়, সবচেয়ে লম্বা, সবচেয়ে ভারী, সবচেয়ে দ্রুত—সব বিষয়ের রেকর্ড এক জায়গায়। মানুষের আগ্রহের বিষয় হবে, বিশেষ করে পানশালায় যেসব মানুষ আড্ডা দেয়, তাদের জন্য বইটি হবে আকর্ষণীয়। সুযোগ পেলেন নিজের কোম্পানির বিয়ারের বিজ্ঞাপন দেওয়ারও। সিদ্ধান্ত নিলেন, কাজ শুরু করবেন।

এরপর খবরটি ছড়িয়ে পড়ে। ক্রীড়াবিদ ক্রিস চ্যাটাওয়ে বিষয়টি জানলেন। তিনিই পরামর্শ দিলেন নরিস ম্যাকহুইটার এবং রস ম্যাকহুইটারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে। যমজ এই দুই ভাই রেকর্ড আর তথ্যের ভাণ্ডার। ইতিহাস, ভূগোল, খেলা—সবখানেই তাদের অগাধ জ্ঞান। হিউ বিভার তাদের পাশে পেলেন। বই প্রকাশের পরিকল্পনা এগিয়ে গেল। খরচের দায়িত্ব নিলেন বিভার।

ম্যাকহুইটার ভাইরা নেমে পড়লেন খোঁজে। বিজ্ঞানী, গবেষক, ইতিহাসবিদ—সবাইকে ডাক পাঠালেন, পৃথিবীর নানা রেকর্ড তাদের জানাতে। তিন মাসে তথ্য জমা পড়ল। পরের চার মাস ধরে চলল বাছাই। একটানা দিনে ১৫ ঘণ্টা করে সপ্তাহে ৯০ ঘণ্টা কাজ করলেন তারা। ১৯৫৪ সালের শেষ নাগাদ বই তৈরি হলো।

প্রথমে এই বই শুধু হিউ বিভারের পানশালায় বিনামূল্যে পড়ার সুযোগ ছিল। মানুষের আগ্রহ দেখে তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন বই বিক্রি করবেন। ১৯৫৫ সালের ২৭ আগস্ট ‘দ্য গিনেস বুক অব রেকর্ডস’ প্রথমবার বিক্রির জন্য প্রকাশিত হলো। দাম মাত্র ৫ শিলিং। প্রথম দিনে বিক্রি হলো মাত্র ৬ কপি। কিন্তু খুব দ্রুত বদলে গেল দৃশ্যপট। সেই বছরই বিক্রি হলো এক লাখ ৮৭ হাজার কপি। তিনবার বই ছাপাতে হলো। ক্রিসমাসের আগেই নতুন সংস্করণও শেষ।

পরের বছর বইটি পৌঁছাল যুক্তরাষ্ট্রে। বিক্রি হলো ৭০ হাজার কপি। একটি সাধারণ কৌতূহল থেকে জন্ম নেওয়া বইটি পেল আন্তর্জাতিক রূপ। মানুষের আগ্রহ যেন উন্মাদনায় রূপ নিল। সবাই চাইল নিজের নাম লেখাতে গিনেসের পাতায়। অদ্ভুত সব কাজ শুরু করল মানুষ। কেউ দাঁড়িয়ে রইল সবচেয়ে বেশি সময় খুঁটি ধরে, কেউ বাড়াল নখ, কেউ গোসল না করে পার করল দীর্ঘ সময়। কারণ একটাই—বিশ্ব রেকর্ড।

বিবিসি-ও হাত লাগাল এই উন্মাদনায়। ‘রেকর্ড ব্রেকার’ নামে অনুষ্ঠান শুরু করল ১৯৭২ সালে। হোস্ট ছিলেন রয় ক্যাসেল, নরিস এবং রস ম্যাকহুইটার। অনুষ্ঠান চলল টানা প্রায় ৩০ বছর। ব্রিটেনের টেলিভিশনে সেটিও রেকর্ড গড়ল।

প্রথম দিকে বইয়ে ছিল সাধারণ রেকর্ড—নদীর দৈর্ঘ্য, ভবনের উচ্চতা, দেশের রাজধানী। কিন্তু সময়ের সঙ্গে বদলাতে লাগল বইয়ের চরিত্র। মানুষকে টানতে শুরু করল অদ্ভুত আর অবিশ্বাস্য রেকর্ড।

সবচেয়ে মজার বিষয়, যে প্রশ্ন থেকে বইয়ের জন্ম, তার উত্তর হিউ বিভার জীবিত অবস্থায় জানতেই পারেননি। ১৯৮৯ সালে জানা গেল—দ্রুততম পাখি গোল্ডেন প্লোভার নয়, পারমিগান। ঘণ্টায় ১০৮ কিলোমিটার গতিতে উড়ে। অর্থাৎ হিউ বিভারই বাজিতে জিতেছিলেন। তার মৃত্যুর ২২ বছর পর গিনেস বইয়ের ৩৬তম সংস্করণে এই তথ্য যুক্ত করা হয়।

২০০০ সালে বইয়ের নাম হয় ‘গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস’। এখনও এটি প্রতি বছর প্রকাশিত হয়। এখনও মানুষ এই বইয়ের পাতায় নিজের নাম লেখাতে চায়। এখনও কেউ কেউ অপেক্ষা করে, কখন তার অদ্ভুত কাজটা হবে বিশ্ব রেকর্ড।

এনডি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।