রাজধানী তেহরানসহ গোটা ইরানে বর্তমানে মারাত্মক পানি সংকট চলছে, যা শুধু পরিবেশ নয়, অর্থনীতি ও সমাজজীবনকেও গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে। এই সংকটকে পুঁজি করে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এক ভিডিও বার্তায় ইরানিদের উদ্দেশে পানি দেওয়ার নাম করে ‘কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা’ দিয়েছেন।
ইরানের পানি সংকট: মাত্রা ও কারণ
সম্প্রতি তেহরান প্রদেশের পানি ব্যবস্থাপনা সংস্থা জানিয়েছে, রাজধানীর পানির যোগানদাতা বাঁধগুলোর মজুদ গত ১০০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে নিচে নেমে গেছে। এ সংকটের পেছনে টানা পাঁচ বছরের খরা এবং চলতি বছরে কম বৃষ্টিপাত দায়ী, যা গত ৬০ বছরে নজিরবিহীন। বাঁধের পানি কমে যাওয়ায় সরাসরি পানির সরবরাহ ব্যবস্থায় চাপ বেড়েছে এবং বহু শহুরে এলাকায় পানির চাপ দৃশ্যমানভাবে হ্রাস পেয়েছে।
বিশ্বসম্পদ ইনস্টিটিউটের (ডব্লিউআরআই) মতো আন্তর্জাতিক সূত্রের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ইরান এখন উচ্চমাত্রার পানিসংকট–চাপের মধ্যে রয়েছে, কারণ দেশটি প্রতিবছর তার নবায়নযোগ্য পানিসম্পদের ৮৩ শতাংশেরও বেশি ব্যবহার করছে, যেখানে আন্তর্জাতিকভাবে এই চাপের সীমা ৪০ শতাংশের নিচে থাকাকে নিরাপদ ধরা হয়।
খরায় চৌচির ফসলের মাঠ
এই পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশটি বহু আগেই সতর্কতার সীমা অতিক্রম করেছে। অদক্ষ ব্যবস্থাপনা, ধারাবাহিক খরা ও ভূগর্ভস্থ পানির অতিরিক্ত উত্তোলনের ফলে দেশটি এক সর্বব্যাপী সংকটের মুখোমুখি।
উদ্বেগজনক বর্তমান চিত্র: পরিসংখ্যান যা বলছে
ইরানের বড় বড় পানি–সংরক্ষণকারী বাঁধগুলোর মধ্যে অন্তত ১৯টি বর্তমানে মাত্র ২০ শতাংশের কম পানি ধারণ করছে। অর্থাৎ ৮০ শতাংশের বেশি ধারণক্ষমতা ফাঁকা—যা আসন্ন মাসগুলোর জন্য গুরুতর সতর্কবার্তা।
গত জুন মাসে বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পরিশোধিত পানির ২৮ শতাংশ সরবরাহ–ব্যবস্থায় হারিয়ে যায়—১৫ শতাংশ পাইপলাইনের ফুটো বা পুরনো নেটওয়ার্কের কারণে এবং ১৩ শতাংশ অবৈধ সংযোগ ও মিটার ত্রুটির কারণে। এর সাথে মিলিয়ে রাজধানীর প্রতিজন বাসিন্দা গড়ে দিনে ১৯৫ লিটার পানি ব্যবহার করছেন— যা আদর্শ ব্যবহার–মানের দ্বিগুণের কাছাকাছি।
ইরানের পানি সংকটকে ঘিরে নেতানিয়াহুর বার্তা
পানি সংকট নিরসনে ইরান সরকার যখন হিমশিম খাচ্ছে তখন গত ১২ আগস্ট এক ভিডিও বার্তায় ইরানিদের উদ্দেশে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বলেছেন, “আপনাদের দেশ মুক্ত হলেই ইসরায়েলি পানি বিশেষজ্ঞরা প্রতিটি ইরানি শহরে আসবে এবং আপনার পানি সমস্যা সমাধান করবে। ”
নেতানিয়াহু দাবি করেন, “ইসরায়েল বিশ্বের এক নম্বর পানি পুনর্ব্যবহারকারী দেশ— আমরা ৯০ শতাংশ বর্জ্যপানি পুনঃব্যবহার করি। লবণ অপসারণ প্রযুক্তিতেও আমরা শীর্ষে। আমরা জানি ঠিক কীভাবে ইরানকে প্রচুর পানি সরবরাহ করা সম্ভব। ”
তিনি ইসরায়েলের বর্জ্যজল পুনর্ব্যবহার (রিসাইক্লিং) ও সমুদ্রের পানি লবণমুক্তকরণে (ডিস্যালিনেশন) অগ্রণী অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করে ইরানিদের রাস্তায় নামতেও আহ্বান জানান।
নেতানিয়াহু ২০১৮ সালেও ইরানিদের উদ্দেশে অনুরূপ ভিডিও বার্তা দিয়ে ফার্সি ভাষায় পানির জ্ঞানভিত্তিক প্রযুক্তি দেওয়ার ঘোষণা করেছিলেন; কিন্তু তা কোনো বাস্তব দ্বিপাক্ষিক প্রকল্পে রূপ নেয়নি। এবারের বার্তাটি অনেকাংশে সেই বক্তব্যের আপডেটেড রাজনৈতিক সংস্করণ।
‘পানি প্রবঞ্চক সরকার, পানি আনবে?’
নেতানিয়াহুর বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ান সামাজিকমাধ্যম এক্স-এ এক পোস্টে লিখেছেন, “গাজার মানুষকে পানি ও খাদ্য থেকে বঞ্চিত করে ইসরায়েলি রেজিম বলে— তারা ইরানের জন্য পানি আনবে— এটা মরীচিকা ছাড়া আর কিছু নয়!”
তেহরানে মন্ত্রিসভার এক বৈঠকেও পেজেশকিয়ান বলেন, “যারা প্রতারণাময় চেহারা নিয়ে ইরানের জনগণের জন্য মমতা দেখাচ্ছে, তারা আসলে মিথ্যাবাদী। ”
ইরানের প্রেসিডেন্ট বলেন, “প্রথমে গাজার ভয়াবহ পরিস্থিতি এবং নিরস্ত্র জনগণের দিকে তাকান, বিশেষ করে শিশুদের যারা ক্ষুধা, পানীয় জল ও ওষুধের অভাবে সংগ্রাম করছে... এই নিষ্ঠুর শাসনের অবরোধের কারণে। ”
ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ান
পেজেশকিয়ান স্পষ্ট করে বলেছেন, নেতানিয়াহুর গাজা ও পশ্চিম তীরে কর্মকাণ্ড স্পষ্ট করেছে যে, তিনি রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে পানিকে ব্যবহার করেছেন। তাই ‘ইরানের পানি সমস্যা সমাধান’ প্রতিশ্রুতি প্রযুক্তিগত ও নৈতিক উভয় দিক থেকেই অগ্রহণযোগ্য; এটি এমন একটি রাজনৈতিক প্রচারণা, যা বিভ্রান্তিকর।
ইসরায়েলের পানির উৎস ও প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে বিরোধ
নেতানিয়াহু ইরানে ‘প্রচুর’ পানি সরবরাহ করার লোভ দেখালেও ইসরায়েল নিজেই পানি সংকটে রয়েছে। গত ১০ বছরে খরা ও গ্যালিলি হ্রদের (তিবেরিয়াস লেক) পানিস্তর কমে যাওয়া বারবার পানিসঙ্কটের সতর্কবার্তা দিয়েছে, যার ফলে সরকারকে জরুরি লবণ অপসারণ প্রকল্প হাতে নিতে হয়েছে।
শুধু তাই নয়, পানি সংকট মোকাবিলায় প্রতিবেশী দেশগুলো থেকে নিয়মিত পানি চুরি করছে তেল আবিব। ১৯৬৭ সালের যুদ্ধের পর ইসরায়েল জর্দান নদীর পানি নিয়ন্ত্রণ করে, যা জর্দান ও ফিলিস্তিনিদের জন্য সংকট তৈরি করেছে। সিরিয়া অভিযোগ করে যে, ইসরায়েল দখলকৃত গোলান মালভূমি থেকে বানিয়াস নদীর পানি জোরপূর্বক ব্যবহার করছে। সিরিয়া ও জর্দানের ভেতর দিয়ে বয়ে আসা নদী ইয়ারমুক থেকেও ইসরায়েল বছরে ১০ কোটি কিউসেক পানি সরিয়ে নিচ্ছে।
দক্ষিণ লেবানন যখন ইসরাইলের দখলে ছিল, তখন সেখানকার তিনটি নদীর পানি ইহুদিবাদীরা চুরি করতো এবং এর পরিমাণ ছিল ৭০ কোটি কিউসেক। কিন্তু হিজবুল্লাহর তীব্র প্রতিরোধ আন্দোলনের মুখে ২০০০ সালে ইহুদিবাদী সরকার দক্ষিণ লেবানন থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়। কিন্তু তারপরও তারা লেবাননের পানি চুরি করা বন্ধ রাখেনি। তারা খাল খনন ও পাইপলাইন স্থাপনের মাধ্যমে লেবাননের ওয়াজানি নদী ও অন্যান্য জলাধার থেকে পানি উত্তোলন করছে। এ ছাড়া, তুরস্কের বিভিন্ন নদী এবং মিশরের নীল নদ থেকে পানি আনার পরিকল্পনা মাথায় রেখেছে ইসরায়েল।
ইতিহাসে ইসরায়েলের ‘পানি সাম্রাজ্যবাদ’
ইহুদিবাদী মতবাদের প্রতিষ্ঠাতা থিওডোর হার্জেল যখন মধ্যপ্রাচ্যের বুকে একটি বৃহৎ ইসরায়েল রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখেন, তখন সব কিছুর আগে ওই কল্পিত রাষ্ট্রের পানি চাহিদা কীভাবে মেটানো হবে, সে বিষয়টি মাথায় রেখেছিলেন তিনি। হার্জেল ১৮৮৬ সালে নীল নদ থেকে ফোরাত পর্যন্ত বিস্তৃত ইসরাযেল প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনার কথা উল্লেখ করতে গিয়ে বলেছিলেন, ভবিষ্যতে যারা ইসরায়েল প্রতিষ্ঠা করবে তাদের নেতৃত্বে থাকবে পানি বিষয়ক কিছু বিশেষজ্ঞ।
ইসরায়েলের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ডেভিড বেন গুরিয়ন ১৯৫৫ সালে ইসরায়েলের পানির উৎস সম্পর্কে বলেছিলেন, বর্তমানে ইসরায়েল পানি সম্পদের উৎস দখল করার জন্য আরবদের সঙ্গে যুদ্ধ করছে। কাজেই এ যুদ্ধের ফলাফলের ওপর ইসরায়েলের ভবিষ্যৎ অস্তিত্ব সরাসরি নির্ভরশীল।
ওয়ার্ল্ড ওয়াটার রিসার্স সেন্টারের অন্যতম গবেষক রোস্টভা ইসরায়েলের ‘নীল থেকে ফোরাত’ পরিকল্পনা সম্পর্কে বলেছেন, ইসরায়েল তার পতাকায় সাদা ভূমির ওপর যে নীল রংয়ের তারকা চিহ্ণ এঁকেছে, তার মধ্যেও আরবদের পানি সম্পদ কুক্ষিগত করার বাসনা লুকিয়ে আছে। ওই নীল রঙের দাগগুলো হচ্ছে নীল ও ফোরাত নদীর কাল্পনিক প্রতীক। ইহুদিবাদী নেতাদের বিভিন্ন সময়ের বক্তব্যে ওয়ার্ল্ড ওয়াটার রিসার্স সেন্টারের ওই গবেষকের কথার সত্যতার প্রমাণ পাওয়া যায়।
নেতানিয়াহুর প্রতিশ্রুতি কতটা বাস্তবসম্মত?
আরব দেশগুলোর সম্পদ দখলের মাধ্যমে ইসরায়েল তার পানির সক্ষমতা কিছুটা বাড়ালেও—‘ইরান মুক্ত হলেই ইসরায়েল এসে সংকট সমাধান করে দেবে’—এ ধরনের দাবি বাস্তবে অতিসরলীকৃত। কারণ ইসরায়েল নিজেই পানির ঘাটতিতে ভুগছে এবং দখলদারিত্ব ও চৌর্যবৃত্তির মাধ্যমে প্রয়োজন মেটায়।
যে ইসরায়েল পশ্চিম তীর ও গাজার মানুষের জন্য পর্যাপ্ত পানি সরবরাহে ব্যর্থ, তারা ‘ইরানকে বাঁচাতে পানি পাঠাবে’—এ ধারণা বাস্তবের চেয়ে বেশি রাজনৈতিক বাগাড়ম্বর। নেতানিয়াহুর ভিডিও মূলত একটি রাজনৈতিক বার্তা, যেখানে ইরানের পানি–সংকটকে ইরান-ইসরায়েল ভূরাজনীতির আলো–আঁধারিতে ফ্রেম করা হয়েছে।
বাস্তবতা হলো—ইরানের পানি–সংকটের স্থায়ী সমাধান নিহিত রয়েছে দেশের অভ্যন্তরীণ পানি–শাসন ব্যবস্থার সংস্কার, কৃষি–পুনর্গঠন, অববাহিকাভিত্তিক পরিকল্পনা ও জলবায়ু–সহনশীলতা বৃদ্ধিতে। তবে, ইরানের পানি–সংকট একটি বহুমাত্রিক চ্যালেঞ্জ, যার সমাধান একদিনে সম্ভব নয়। মূল কৌশল হতে হবে চাহিদা–নির্ভর ব্যবস্থাপনা, কৃষিতে পানি–ব্যবহার হ্রাস এবং ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ।
এমজেএফ