গাজা সিটির এক তাঁবুর ভেতর থেকে ভেসে আসছিল এক কিশোরের মিষ্টি, সুরেলা কণ্ঠ। যন্ত্রসঙ্গীতের তারের ঝংকার আর সহশিল্পীদের কোমল সুর মিলেমিশে যেন এক অন্য রকম জগতের আবহ তৈরি করছিল।
ফিলিস্তিনি এই উপত্যকায় শিশু-কিশোরদের সংগীতের পাঠ দেওয়া প্রতিষ্ঠানের নাম এডওয়ার্ড সাঈদ ন্যাশনাল কনজারভেটরি অব মিউজিক। পশ্চিম তীরে শুরু হওয়া এই সংগীত প্রতিষ্ঠান ১৩ বছর আগে গাজায় শাখা খোলে। তখন থেকে এখানে ধ্রুপদি ও জনপ্রিয়—দুই ধরনের সংগীতই শেখানো হতো।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের হামলার পর ইসরায়েল যুদ্ধ শুরু করলে কার্যক্রমে বড় বাধা আসে। এই প্রতিষ্ঠানের মূল ভবন ইসরায়েলের হামলায় ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে ওঠে। এর শিক্ষকেরা এখন ক্লাস নেন শরণার্থী শিবিরের তাঁবুতে কিংবা ভাঙা ভবনে।
এমন এক ক্লাসে কথা হচ্ছিল ১৫ বছরের কিশোরী রিফান আল-কাসাসের সঙ্গে। তার বয়স যখন নয়, তখনই সে হাতে তুলে নিয়েছিল আরব অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী তারযন্ত্র ‘উদ’। সেই থেকে সুরই তার ভরসা, স্বপ্নের সিঁড়ি। ভাঙা দেয়াল আর খোলা জানালার ছোট ঘরে বসে রিফান বলছিল, ‘আমি যখন বাজাই, মনে হয় আমি উড়ে যাচ্ছি। ’ তার স্বপ্ন, সীমানা পেরিয়ে, রক্তমাখা আকাশের ওপারে গিয়ে বাজানো, এমন এক মঞ্চে যেখানে কেবল সংগীতই কথা বলবে।
যুদ্ধের আগে সেরা সংগীত শিক্ষার্থীরা মাঝে মাঝে ইসরায়েলের অনুমতি নিয়ে গাজা থেকে বাইরে গিয়ে প্যালেস্টাইন ইয়ুথ অর্কেস্ট্রার সঙ্গে অনুষ্ঠানে অংশ নিত। অন্যরা গাজার ভেতরে আরবি ও পাশ্চাত্য সংগীত পরিবেশন করত। গাজায় ইসরায়েলের যুদ্ধে তাদের অনেকে আর বেঁচে নেই বলে জানান সংগীত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধান সুহাইল খুরি। মারা যাওয়া এক শিক্ষার্থী লুবনা আলিয়ান। বেহালায় সুর তুলত, বয়স ছিল মাত্র ১৪। যুদ্ধের শুরুতে পরিবারের সঙ্গে নিহত হয় সে।
জানুয়ারিতে এক শিক্ষকের প্রকাশিত ভিডিওতে দেখা যায়, স্কুলের পুরোনো ভবন এখন ধ্বংসস্তূপে পরিণত। দেয়াল ভেঙে পড়েছে, কক্ষগুলোর ভেতর শুধু ধ্বংসাবশেষ। একটি গ্র্যান্ড পিয়ানোও উধাও হয়ে গেছে। রয়টার্স ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর কাছে স্কুলের এসব ক্ষয়ক্ষতির বিষয়ে জানতে চাইলে তারা আরও তথ্য ছাড়া মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানায়। ক্ষয়ক্ষতির তথ্য রয়টার্স যাচাই করতে পারেনি।
গত সপ্তাহের এক ক্লাসে এক ডজনেরও বেশি শিক্ষার্থী তাঁবুর নিচে জড়ো হয়েছিল। তারা যুদ্ধের মধ্যেও যত্নে রক্ষা করা কিছু বাদ্যযন্ত্রে অনুশীলন করছিল এবং সবাই মিলে গান ও যন্ত্রসংগীত পরিবেশনে অংশ নিচ্ছিল। সংগীত শিক্ষক আহমেদ আবু আমশা জানালেন, কীভাবে যুদ্ধের মধ্যেই এডওয়ার্ড সাঈদ ন্যাশনাল কনজারভেটরির গাজা শাখা আবারো ক্লাস শুরু করতে পারল।
শুরুতে যে কিশোরের কথা বলছিলাম, সে গাইছিল, ‘আমাদের অন্তরের সবুজ কখনো মলিন হবে না’। ১৯৪৮ সালে ইসরায়েল প্রতিষ্ঠার পর থেকে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে ফিলিস্তিনিদের উৎখাত ও হারানোর বেদনা বয়ে আনা এক জনপ্রিয় শোকগানের পঙ্ক্তি এটি। তাঁবুর বাইরে তিন ছাত্রী গিটার হাতে ‘গ্রিনস্লিভস’ গানটি অনুশীলন করছিল।
আরেকদল ছেলে মধ্যপ্রাচ্যের হাতঢোল বাজিয়ে তাল দিচ্ছিল। যুদ্ধের মধ্যে খুব কম বাদ্যযন্ত্রই টিকে আছে। কনজারভেটরির পুনরায় চালু হওয়া ক্লাসের সমন্বয়ক ফুয়াদ খাদের এমনটাই জানালেন। শিক্ষকেরা শিক্ষার্থীদের জন্য অন্য বাস্তুচ্যুতদের কাছ থেকে কিছু বাদ্যযন্ত্র কিনেছেন। তবে সেগুলোর কিছু বোমাবর্ষণে ভেঙে গেছে। তাই শিশুদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য খালি টিন ও পাত্র দিয়ে নিজস্ব তালবাদ্য বানিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাচ্ছেন প্রশিক্ষকরা, বলছিলেন খাদের।
চওড়া হাসি
বড় দাড়ি আর চওড়া হাসির গিটার ও বেহালা শিক্ষক আহমেদ আবু আমশা। ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা শিক্ষক-শিক্ষার্থী যারা গাজায় পুনরায় স্কুলের কার্যক্রম শুরু করেন, তাদের মধ্যে তিনিই ছিলেন অগ্রপথিক। গাজার দক্ষিণাঞ্চলে সন্ধ্যায় তিনি গিটার বাজাতেন। ইসরায়েলি বোমাবর্ষণ আর সামরিক অভিযানে ২১ লাখের বেশি মানুষকে দক্ষিণাঞ্চলে তাঁবুতে আশ্রয় নিতে হয়।
চলতি বছরের জানুয়ারিতে যুদ্ধবিরতি শুরু হওয়ার পর ৪৩ বছর বয়সী আবু আমশা গাজা উপত্যকার উত্তরের দিকে ফিরে আসেন। তার মতো কয়েক লাখ লোক গাজা সিটিতে ফেরেন। এই শহরের বড় অংশ ইসরায়েলের বোমাবর্ষণে ধ্বংস হয়ে গেছে।
গত ছয় মাস ধরে তিনি এই শহরে বসবাস করছেন। সহকর্মীদের সঙ্গে তিনি উদ, গিটার, হাতঢোল ও নে— নামে এক ধরনের বাঁশি বাজানো শেখাচ্ছেন শিক্ষার্থীদের। যারা তাঁবু বা গোলাবর্ষণে ক্ষতিগ্রস্ত গাজা কলেজের ভবনে পৌঁছাতে সক্ষম, তাদেরই ক্লাস নিচ্ছেন শিক্ষকেরা। তারা ছোট শিশুদের সঙ্গে সেশন করার জন্য কিন্ডারগার্টেনেও যান।
কনজারভেটরির তথ্য বলছে, জুন মাসে দক্ষিণ ও মধ্য গাজায় ১২ জন বাদ্যযন্ত্র শিক্ষক এবং তিনজন সংগীত শিক্ষিকা প্রায় ৬০০ শিক্ষার্থীর ক্লাস নেন। শিক্ষক আবু আমশা বলেন, ইসরায়েলি মন্ত্রিসভার ৮ আগস্টের গাজা সিটি নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার সিদ্ধান্তের পর শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীদের অভিভাবকেরা গভীর উদ্বেগে রয়েছেন।
ক্ষুধা আর ক্লান্তি
সংগীতের ক্লাসের তাঁবুর বাইরে গাজা সিটি ছেয়ে আছে ভাঙা কংক্রিটের পাহাড়ে। প্রায় সব মানুষ আশ্রয়কেন্দ্র বা শিবিরে জড়ো হয়েছে, খাবার নেই, পরিষ্কার পানি নেই, চিকিৎসা নেই। শিক্ষার্থী ও শিক্ষকেরা বলেন, ক্ষুধা আর দুর্বলতা কাটিয়ে কষ্ট করে তাদের ক্লাসে আসতে হয়।
ব্রিটেন, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া এবং তাদের কয়েকটি ইউরোপীয় মিত্র ১২ আগস্ট সতর্ক করে বলেছে, গাজায় ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ ছড়িয়ে পড়ছে। অবশ্য ইসরায়েল অনাহারের পরিসংখ্যান অস্বীকার করেছে।
২০ বছর বয়সী সারাহ আল-সুয়ারকি বলেন, কখনো কখনো ক্ষুধা আর ক্লান্তির কারণে সপ্তাহে দুইবার ক্লাসে যাওয়া তার জন্য কঠিন হয়ে যায়। তবু তিনি গিটার শেখা খুব পছন্দ করেন। তিনি বলেন, আমি নতুন সংগীতের ধারা খুঁজে বের করতে ভালোবাসি, বিশেষ করে রক। রক আমার খুবই প্রিয়।
ফিলিস্তিনি স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ইসরায়েলের সামরিক অভিযানে এ পর্যন্ত ৬১ হাজারের বেশি মানুষের প্রাণ গেছে। এর মধ্যে খাবার বা ত্রাণ সংগ্রহে গিয়ে প্রাণ গেছে এক হাজার চারশর বেশি ফিলিস্তিনির।
‘গোলাবর্ষণ যখন তীব্র হয়, তখন আমি ভরসা করি শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যায়াম কিংবা নীরব বাজানোর ওপর। কিন্তু যখন সত্যি বাজাই, তখন মনে হয় আমি আবার শ্বাস নিচ্ছি। যেন বাঁশি আমার ভেতরের সমস্ত যন্ত্রণাকে মুক্ত করে দিচ্ছে’, বলছিলেন বাঁশি প্রশিক্ষক ওসামা জাহজুহ।
সংগীত থেরাপি
গাজা কলেজের দেয়ালে দেয়ালে গুলির চিহ্ন। জানালাগুলো উড়ে গেছে, তিনজন মেয়ে আর একজন ছেলে গিটার ক্লাসে বসেছে। ৩২ বছর বয়সী শিক্ষক মোহাম্মদ আবু মাহাদি তাদের শিক্ষক। তিনি মনে করেন, সংগীত গাজার মানুষকে বোমাবর্ষণ, ক্ষতি ও অভাবের মানসিক আঘাত নিরাময়ে সাহায্য করতে পারে।
ব্রিটেনের সাউথ ওয়েলস বিশ্ববিদ্যালয়ে সংগীত থেরাপি প্রোগ্রামের পরিচালক এলিজাবেথ কুম্বস পশ্চিম তীরের ফিলিস্তিনিদের নিয়ে কাজ করেছেন। তিনি বলেন, সংগীত থেরাপি তরুণদের ট্রমা ও মানসিক চাপ সামলাতে এবং তাদের আত্মপরিচয়ের অনুভূতি শক্তিশালী করতে সাহায্য করতে পারে। এলিজাবেথ কুম্বস বলেন, যে শিশুরা খুবই আঘাতপ্রাপ্ত বা সংঘর্ষপূর্ণ অঞ্চলে বসবাস করছে, সংগীত তাদের সাহায্য করতে পারে।
‘উদ’ বাদ্যযন্ত্রের শিক্ষক ৪৫ বছর বয়সী ইসমাইল দাউদ বলেন, যুদ্ধ মানুষের সৃজনশীলতা ও কল্পনাশক্তি কেড়ে নিয়েছে, তাদের জীবন শুধু খাবার ও পানি যোগাড়ের দৌড়ে সীমাবদ্ধ হয়ে গেছে। শিল্পের পথে ফিরে আসা ছিল এক মুক্তির নিঃশ্বাস। তিনি বলেন, বাদ্যযন্ত্র হলো শিল্পীর আত্মার প্রতিচ্ছবি, তার সঙ্গী, তার অস্তিত্ব এবং তার নিকটতম বন্ধু।
রয়টার্স অবলম্বনে লিখেছেন রকিবুল সুলভ, সিনিয়র নিউজরুম এডিটর
আরএইচ/এমজেএফ