ঢাকা, মঙ্গলবার, ৪ ভাদ্র ১৪৩২, ১৯ আগস্ট ২০২৫, ২৪ সফর ১৪৪৭

ফিচার

সিআইএ’র অভ্যুত্থান থেকে সাম্প্রতিক হামলা

ইরান কেন এখনও পশ্চিমা ‘শাসন পরিবর্তন’ নীতির নিশানায়?

আশরাফুর রহমান, তেহরান থেকে | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২:৫৯, আগস্ট ১৯, ২০২৫
ইরান কেন এখনও পশ্চিমা ‘শাসন পরিবর্তন’ নীতির নিশানায়? মোহাম্মদ মোসাদ্দেকের ছবি হাতে ইরানে মিছিল

আজ থেকে ৭২ বছর আগে ১৯৫৩ সালের ১৯ আগস্ট, যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা (সিআইএ) ও যুক্তরাজ্যের গোয়েন্দা সংস্থা এমআই৬ ইরানের গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ মোসাদ্দেককে ক্ষমতাচ্যুত করে এবং শাহ মোহাম্মদ রেজা পাহলভির নেতৃত্বাধীন রাজতান্ত্রিক একনায়কতন্ত্রকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করে।

১৯৫১ সালে ইরানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন জাতীয়তাবাদী মতাদর্শের নেতা মোহাম্মদ মোসাদ্দেক।

৩৫তম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেই প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে ইরানের তেল সম্পদকে জাতীয়করণ করেন তিনি। এতে করে মোসাদ্দেক সরকারের ওপর ক্ষিপ্ত হয় ব্রিটেন। কেননা সে সময় ইরানের তেল সম্পদের ওপর নিয়ন্ত্রণ ছিল ব্রিটিশদের।

তেল জাতীয়করণ আন্দোলন ও বিদেশি স্বার্থ

প্রধানমন্ত্রী মোসাদ্দেক ইরানের তেলশিল্পকে জাতীয়করণ করেছিলেন, যা আগে ব্রিটিশ মালিকানাধীন অ্যাংলো-ইরানিয়ান অয়েল কোম্পানি (বর্তমানে বিপি) নিয়ন্ত্রণ করত। মোসাদ্দেকের এই সিদ্ধান্ত জনগণের কাছে খুব জনপ্রিয় হয়েছিল। কিন্তু পশ্চিমা দেশগুলো তা পছন্দ করেনি।

মোসাদ্দেক নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তেল শিল্প জাতীয়করণ আন্দোলনের, যার মূল লক্ষ্য ছিল ব্রিটিশ প্রভাবমুক্ত হয়ে ইরানের সম্পদের ওপর জনগণের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা। বহু দশক ধরে কাজার ও পাহলভি শাসকগোষ্ঠী বিদেশি শক্তিকে যে অযৌক্তিক ছাড় দিয়েছে, তার বিরুদ্ধে জনসাধারণের ক্ষোভ জমা হয়েছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর শাসন এই আন্দোলনের গতি আরও বেড়ে যায়।

জাতীয়তাবাদী নেতা মোসাদ্দেক সংসদে আইন পাস করে অ্যাংলো-ইরানিয়ান অয়েল কোম্পানি জাতীয়করণ করলে ব্রিটিশ স্বার্থ সরাসরি হুমকির মুখে পড়ে। এরপর যুক্তরাষ্ট্রও প্রতিযোগিতায় নেমে পড়ে, সোভিয়েত ইউনিয়নসহ তিন শক্তিই ইরানের তেলের নিয়ন্ত্রণ চাইতে থাকে।

১৯৪১ সালে ব্রিটিশ ও সোভিয়েত সেনারা ইরান আক্রমণ করে প্রথম পাহলভি সম্রাট রেজা শাহকে ক্ষমতাচ্যুত করে তার তরুণ ছেলে মোহাম্মদ রেজাকে সিংহাসনে বসায়। দ্বিতীয় পাহলভি শাহের শাসনের শুরুর দিকেই তেল জাতীয়করণ আন্দোলন এত শক্তিশালী হয়ে ওঠে যে, তা দমন করা সম্ভব হয়নি। এ সময় ইরানের শীর্ষস্থানীয় ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আবুল-কাসেম কাশানি সংসদের বাইরে বিদেশি হস্তক্ষেপবিরোধী গণআন্দোলনের নেতৃত্ব দেন এবং মোসাদ্দেকের গণতান্ত্রিক সরকারের পক্ষে জনসমর্থন গড়ে তোলেন।

তীব্র আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে সংসদে তেল কমিশনের সদস্যদের প্রস্তাবের ভিত্তিতে ১৯৫১ সালের ২০ মার্চ ইরানি তেল শিল্প জাতীয়করণের পরিকল্পনা অনুমোদিত হয় এবং ইরানি তেল আনুষ্ঠানিকভাবে জাতীয়করণ করা হয়। তেল শিল্পের জাতীয়করণের পর ব্রিটিশরা ধীরে ধীরে এই অঞ্চল থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে নেয়।


অভ্যুত্থান চলাকালে তেহরানের দৃশ্য

অপারেশন আজাক্স: পাঁচ দিনের অভ্যুত্থান নাটক

ইরানের তেলের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ব্রিটেন যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা চায় এবং মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডুইট আইজেনহাওয়ার মোসাদ্দেকবিরোধী অভ্যুত্থানের পরিকল্পনা অনুমোদন দেন। নেতৃত্বে ছিলেন সিআইএ কর্মকর্তা কেরমিট রুজভেল্ট, সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট থিওডোর রুজভেল্টের নাতি। শাহের সমর্থক ও সামরিক কর্মকর্তাদের প্ররোচিত করে তিনি অভ্যুত্থান পরিকল্পনা এগিয়ে নেন। এ লক্ষ্যে ১ মিলিয়ন ডলার ব্যয় অনুমোদন করা হয়। সিআইএ এজেন্টরা শাহের বোন প্রিন্সেস আশরাফকে দেশে ফিরিয়ে আনেন এবং সেনা কর্মকর্তা ফাজলুল্লাহ জাহেদিকে সহযোগী করেন। ১৫ থেকে ১৯ আগস্ট পর্যন্ত চলে বিশৃঙ্খলার নাটক। কুখ্যাত গুণ্ডা শাবান জাফারিকে কারাগার থেকে ছাড়িয়ে এনে ভাড়াটে জনতা দিয়ে তেহরানে দাঙ্গা ছড়ানো হয়। তারা মোসাদ্দেকের ছবি ব্যবহার করে ভাঙচুর চালিয়ে জনমতকে বিভ্রান্ত করে।


অভ্যুত্থানের প্রতিক্রিয়ায় রাজপথে ইরানিরা

শত শত মানুষের প্রাণহানি ঘটে। অবশেষে সিআইএর ‘অপারেশন আজাক্স’ ও এমআই৬-এর ‘অপারেশন বুট’ সফল হয়। ২০০৯ সালে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ওই অভ্যুত্থানে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা স্বীকার করেন। পরবর্তীতে ২০১৩ সালে সিআইএর কিছু গোপন নথি জনসমক্ষে আসে, যা প্রথমবারের মতো সংস্থাটির প্রত্যক্ষ জড়িত থাকার বিষয়টি নিশ্চিত করে।

অভ্যুত্থানের পর কী ঘটেছিল

অভ্যুত্থান সফল হওয়ার পর রেজা শাহ দেশে ফিরে মোসাদ্দেককে বরখাস্ত করে জেনারেল ফাজলুল্লাহ জায়েদিকে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগের আদেশ জারি করেন। আগেই প্রস্তুত করা এই ফরমানগুলো অভ্যুত্থানকে বৈধতা দেওয়ার কাজে ব্যবহার করা হয়।

মোসাদ্দেককে গ্রেপ্তার করে শাহের সামরিক আদালতে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় বিচার করা হয়। ১৯৫৩ সালের ২১ ডিসেম্বর তাকে তিন বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়, পরবর্তীতে আজীবন গৃহবন্দি করে রাখা হয়। তার সমর্থকদের অনেককে কারারুদ্ধ করা হয় এবং কয়েকজনকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়।


রেজা শাহ পাহলভি এবং সিআইএ কর্মকর্তা থিওডোর রুজভেল্ট

জাতীয়করণ থেকে বিপ্লব: ইরানি প্রতিরোধের যাত্রা

মোসাদ্দেকের তেল জাতীয়করণের ঘোষণাকে তরুণ রেজা শাহ, ব্রিটেন ও যুক্তরাষ্ট্র কেউই মেনে নিতে পারেনি। তাই তারা মোসাদ্দেকের গণতান্ত্রিক সরকারকে উৎখাত করতে অভ্যুত্থান ঘটায়। অভ্যুত্থানের পর শাহ তার একনায়কতন্ত্র আরও দৃঢ় করে এবং ১৯৫৪ সালে ব্রিটিশদের সঙ্গে এক কনসোর্টিয়াম চুক্তি স্বাক্ষর করে। এর ফলে ইসলামি বিপ্লব (১৯৭৯) পর্যন্ত ইরানের তেলসম্পদ পশ্চিমা কোম্পানির নিয়ন্ত্রণে থাকে।  

এই বিদেশি হস্তক্ষেপ ইরানিদের মধ্যে দীর্ঘস্থায়ী ক্ষোভ তৈরি করে এবং মার্কিনবিরোধী মনোভাবকে আরও উসকে দেয়। ১৯৭০-এর দশকের শেষ দিকে রাজপথে মিলিয়ন মানুষ রেজা শাহ পাহলভি ও তার মদদদাতা যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সরব হয়। অবশেষে ১৯৭৯ সালে ইমাম খোমেনির নেতৃত্বে ইসলামি বিপ্লব সংঘটিত হয়, যার মধ্য দিয়ে পশ্চিমা সমর্থিত রাজতন্ত্রের অবসান ঘটে এবং ইরানে ইসলামি প্রজাতন্ত্রের সূচনা হয়। কিন্তু ইসলামি বিপ্লব যুক্তরাষ্ট্রকে ইরান থেকে বিতাড়িত করার পরও ওয়াশিংটন ষড়যন্ত্র বন্ধ করেনি। তারা সামরিক অভিযান (অপারেশন ঈগল ক্ল’), বিপ্লববিরোধী অভ্যুত্থানচেষ্টা, ইরান-ইরাক যুদ্ধে সাদ্দাম হোসেনকে সর্বাত্মক সমর্থন এবং নিষেধাজ্ঞা আরোপের মতো পদক্ষেপ নেয়, যা আজও অব্যাহত রয়েছে।

বর্তমান প্রেক্ষাপট: শাসন পরিবর্তনের নতুন প্রচেষ্টা

ইরানে মার্কিন হস্তক্ষেপ আসলে বৃহত্তর মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির অংশ, যেখানে তারা এমন রাষ্ট্রগুলোকে উৎখাত করতে চায় যারা ওয়াশিংটনের ক্রীড়নক হতে অস্বীকৃতি জানায়। গত ১৩ জুন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মদদে ইসরায়েল আকস্মিকভাবে ইরানে হামলা চালায়। পরবর্তীতে যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি এই আগ্রাসনে যুক্ত হয় এবং ইরানের তিনটি পরমাণু স্থাপনায় আঘাত হানে। এই হামলার লক্ষ্য কেবল ইরানের পরমাণু কর্মসূচি ধ্বংস নয়, বরং এর অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য ছিল ইসলামী শাসনব্যবস্থার পরিবর্তন।

ব্রিটিশ অনুসন্ধানী সাংবাদিক কিট ক্লারেনবার্গ এক নিবন্ধে লিখেছেন, পুরো অপারেশন ছিল অপরিকল্পিত, ব্যয়বহুল এবং কৌশলগতভাবে বিপর্যয়কর। তাদের উদ্দেশ্য ছিল ইরানে ‘শাসন পরিবর্তন’, কিন্তু বাস্তবে এটি ইরানি জনগণকে আরও ঐক্যবদ্ধ করেছে।

ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সাবেক গবেষক ইহুদ এয়লাম সম্প্রতি বিবিসি ফার্সিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে স্বীকার করেছেন, “ইসরায়েল ইরানে পরিবর্তন চাইছে, কিন্তু তা ঘটানোর সামর্থ্য আমাদের নেই। ” তার এই বক্তব্য পশ্চিমা-ইসরাইলি প্রকল্পগুলোর ব্যর্থতাকে নতুনভাবে প্রকাশ করে।

সাম্প্রতিক মাসগুলোতে, বিশেষত গত কয়েক দিনে, ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু প্রকাশ্যে ইরানি জনগণকে রাস্তায় নেমে আসার আহ্বান জানিয়েছেন এবং দেশের ভেতরে সামাজিক বিভাজন উসকে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু ইতিহাস বলছে ভিন্ন কথা। ১৯৫৩ সালে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য ষড়যন্ত্র করে ইরানে শাসক পরিবর্তনে সফল হলেও ১৯৭৯ সালের ইসলামি বিপ্লব তাদের সব পরিকল্পনাকে ভণ্ডুল করে দেয়। এরপর থেকেই পশ্চিমারা বিভিন্নভাবে ইরানকে অস্থিশীতিশীল করার চেষ্টা চালাচ্ছে। তাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য একটাই—ইসলামী শাসনব্যবস্থার পরিবর্তন, আর এ কাজে পশ্চিমাদের হয়ে কাজ করছে ইহুদিবাদী ইসরায়েল।

ষড়যন্ত্রের জবাব প্রতিরোধে

আজ ইরানি সমাজে জাতীয়তাবাদ ও ইসলামী চেতনার মিশ্রণে স্বাধীনতা ও ঔপনিবেশিকবিরোধী মনোভাব গভীরভাবে প্রোথিত। ১৯৫৩ সালের অভিজ্ঞতা তাদের শিখিয়েছে, পশ্চিমাদের প্রকৃত লক্ষ্য কখনো গণতন্ত্র নয়, বরং ভূ-রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ।

এ কারণেই যুক্তরাষ্ট্র, ইসরায়েল ও ইউরোপীয় শক্তিগুলোর বহু বছরের শাসন পরিবর্তনের প্রচেষ্টা ইরানি জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। বরং প্রতিটি ষড়যন্ত্রই ইরানিদের প্রতিরোধ ও ঐক্যকে আরও দৃঢ় করেছে। জাতীয়তাবাদ ও ইসলামী চেতনার মিশ্রণে ইরানি জনগণের মধ্যে প্রতিরোধ, স্বাধীনতা ও ঔপনিবেশিকবিরোধী মনোভাব এত গভীরভাবে প্রোথিত যে, যে কোনো সুর যা এই ধারার বিপরীতে যায়, তা জনগণের তীব্র সমালোচনা ও প্রতিক্রিয়ার মুখে পড়ে।

ইতিহাসের এই দিনে, ১৯৫৩ সালের ১৯ আগস্ট, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের হাতে পতন হয়েছিল মোসাদ্দেক সরকারের। ৭২ বছর পরও নতুন রূপে, নতুন কৌশলে একই লক্ষ্যেই কাজ করছে পশ্চিমারা। পার্থক্য একটাই—তখন যেমন বিদেশি স্বার্থরক্ষায় শাহকে বসানো হয়েছিল, আজ তেমনি ইসলামি শাসনব্যবস্থাকে উৎখাত করার চেষ্টা চলছে। কিন্তু ইরানি জনগণ এখন অনেক বেশি সজাগ, ঐক্যবদ্ধ এবং স্বাধীনতার চেতনায় দৃঢ়।

এমজেএফ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।