ঢাকা, সোমবার, ৩১ ভাদ্র ১৪৩২, ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ২২ রবিউল আউয়াল ১৪৪৭

শিক্ষা

জাকসু নির্বাচন

একটি দলকে জেতাতে সব মনোযোগ দেওয়া হয়েছে: শিক্ষক নেটওয়ার্ক

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট   | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯:৪৮, সেপ্টেম্বর ১৫, ২০২৫
একটি দলকে জেতাতে সব মনোযোগ দেওয়া হয়েছে: শিক্ষক নেটওয়ার্ক ফাইল ছবি

 

 জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় শিক্ষার্থী সংসদ (জাকসু) নির্বাচনে পক্ষপাতদুষ্টতার অভিযোগ তুলে তা প্রত্যাখ্যান করেছে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক।   একইসঙ্গে নির্বাচনে যেকোনো প্রকারে একটি দলকে জিতিয়ে আনতে সব মনোযোগ দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ করেছে শিক্ষকদের সংগঠনটি।

 

সোমবার গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে এসব অভিযোগ করেছে দেশের বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষকদের একটি অংশের সংগঠন শিক্ষক নেটওয়ার্ক।  

১১ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত জাকসু নির্বাচনের ভোট গণনা চলে টানা দুই দিন। এর পর গত শনিবার বিকেলে ঘোষণা করা হয় ফলাফল। দীর্ঘ ৩৩ বছর পর আয়োজিত এ নির্বাচনে ২৫টি পদের মধ্যে জিএস ও দুটি এজিএসসহ মোট ২০টি পদে বিজয়ী হয়েছে ইসলামী ছাত্রশিবির–সমর্থিত প্যানেল সমন্বিত শিক্ষার্থী জোট।

জাকসু নির্বাচন নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্কের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, নির্বাচনটি একদিকে যেমন ছিল ত্রুটিপূর্ণ, তেমনি বিতর্কিত। অব্যবস্থাপনায় ভরা নির্বাচনটির এই প্রক্রিয়ায় মাশুল গুনতে হয়েছে আমাদের একজন তরুণ শিক্ষককে তার জীবন দিয়ে। নির্বাচন কমিশন গঠনের শুরু থেকেই এর অদক্ষতা, লোকবল বাড়াতে অনীহা, সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনার অভাব, প্রার্থীবিশেষের প্রতি বিরূপতা ইত্যাদি বিবেচনা করলে সহকর্মী জান্নাতুল ফেরদৌসের মৃত্যুর পটভূমিতে মারাত্মক অদক্ষতার একটা পরিবেশ আমরা দেখতে পাই। মরহুম জান্নাতুল ফেরদৌসের শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি আমরা সমবেদনা জানাই। একই সঙ্গে অদূরদর্শী কর্মপরিকল্পনাহীন নির্বাচন কমিশনের নিন্দা করি।

জাকসু নির্বাচন প্রক্রিয়ার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ১৬টি গুরুতর সমস্যা চিহ্নিত করেছে শিক্ষক নেটওয়ার্ক। তাদের বিবৃতিতে এই সমস্যাগুলো তুলে ধরা হয়েছে। এর প্রথমটি হলো- ত্রুটিপূর্ণ ভোটার তালিকা ও ত্রুটিপূর্ণ ব্যালট। দ্বিতীয় সমস্যা হিসেবে বলা হয়, ‘ভিপি প্রার্থী অমর্ত্য রায়কে চূড়ান্ত প্রার্থী তালিকা ঘোষণার পর ও নির্ধারিত সময় অতিবাহিত হওয়ার পর অনিয়মিত ছাত্র হিসেবে দেখিয়ে নির্বাচনের চার দিন আগে তার প্রার্থিতা বাতিল করা হয়।  

‘অমর্ত্যর বিরুদ্ধে এই সিদ্ধান্ত উচ্চতর আদালত স্থগিত করলেও চেম্বার আদালতে আপিল করে বিশ্ববিদ্যালয়, ব্যালট পেপার ছাপা হয়ে যাওয়ার যুক্তিতে ৯ সেপ্টেম্বর উচ্চতর আদালতের সিদ্ধান্ত স্থগিত করে দেওয়া হয়। প্রশাসন উচ্চতর আদালতের রায় মেনে নিয়ে অমর্ত্যর প্রার্থিতা ফিরিয়ে দিতে পারত, কিন্তু তারা সেটা করেনি। প্রশাসনের এই আচরণ এবং একজন প্রার্থীর প্রার্থিতা বাতিলের পুরো প্রক্রিয়াটিকে আমাদের কাছে প্রশাসনের পক্ষপাতদুষ্ট দুরভিসন্ধি বলে মনে হয়েছে। ’

শিক্ষক নেটওয়ার্ক বলেছে, ৯ সেপ্টেম্বর প্রার্থীদের ডোপ টেস্টের দিন ধার্য করা হয়। ব্যালট পেপার ছাপানো হয়ে যাওয়ার পর ডোপ টেস্টের প্রাসঙ্গিকতা জানতে চাইলে বলা হয়, ব্যালট পেপার ছাপানো হয়নি। এ ধরনের পরস্পরবিরোধী কথা নির্বাচন কমিশনকে খেলো করে তোলে। চতুর্থ সমস্যা, নির্বাচনের আগের রাতে ব্যালট বাক্স হলে হলে পাঠানোর অভিযোগ উঠেছে, অথচ এই ক্যাম্পাসে ব্যালট বাক্স নির্বাচনের দিন সকালে পাঠানোয় কোনো অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। ’

‘প্রথমে প্রার্থীদের পোলিং এজেন্ট রাখতে না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেও শেষ মুহূর্তে জাকসু নির্বাচনের আগের রাত আড়াইটার দিকে পোলিং এজেন্ট রাখা যাবে বলে ঘোষণা দেয় নির্বাচন কমিশন। এটি প্রার্থীদের মধ্যে বড় ধরনের বৈষম্যের সৃষ্টি করে। পাশাপাশি পোলিং এজেন্টদের পরিচয়পত্র দিতে গড়িমসি করা এবং সকালে কয়েক ঘণ্টা ধরে ভোট চললেও কোনো কোনো প্রার্থীর পোলিং এজেন্ট না থাকা নির্বাচনের স্বচ্ছতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। বিষয়টিকে নির্বাচনের পঞ্চম সমস্যা বলেছে শিক্ষক নেটওয়ার্ক। তাদের দৃষ্টিতে জাকসু নির্বাচনে ষষ্ঠ সমস্যা ছিল, ভোটকেন্দ্রে প্রার্থীদের ঢুকতে বাধা দেওয়া এবং ছাত্রীদের হল পরিদর্শনে প্রার্থী ও সাংবাদিকদের বাধা দেওয়া। ’

নির্ধারিত ভোটারের চেয়ে অতিরিক্ত ব্যালট পেপার সরবরাহ করার ঘটনা বড় রকমের সংশয় তৈরি করে বলে উল্লেখ করেছে শিক্ষক নেটওয়ার্ক। তারা বলেছে, কোনো কোনো হলে মাটিতে ব্যালট পেপার পড়ে থাকতে দেখা যায়। বিষয়টিকে শিক্ষক নেটওয়ার্ক জাকসু নির্বাচনের সপ্তম সমস্যা বলেছে। অষ্টম সমস্যা ছিল, অমোচনীয় কালির দাগ উঠে যাওয়ার ঘটনা, যা ভোট কারচুপির সুযোগ সৃষ্টি করে।

ভোটার তালিকায় নাম না থাকায় বৈধ শিক্ষার্থী হওয়া সত্ত্বেও অনেকে ভোট দিতে পারেননি ও জাল ভোটের প্রমাণ পাওয়া গেছে- শিক্ষক নেটওয়ার্কের দৃষ্টিতে এটি জাকসু নির্বাচনের নবম সমস্যা। দশম সমস্যা ছিল কোনো কোনো হলের একাধিক প্রার্থীর নাম ছাপা না হওয়া বা কয়েকজন সদস্যকে ভোট দিতে হবে সেই নির্দেশনায় ভুল অঙ্ক লেখা থাকা। নির্ধারিত সময়ে সব হলে ভোট দেওয়া শেষ না হওয়া ও নির্ধারিত সময়ের আড়াই ঘণ্টা পরও ভোট গ্রহণ চলতে থাকাকে শিক্ষক নেটওয়ার্ক বলেছে একাদশ সমস্যা।

জাকসু নির্বাচনের দ্বাদশ সমস্যা হিসেবে শিক্ষক নেটওয়ার্ক বলেছে, ওএমআর পদ্ধতিতে ভোট গণনায় প্রশ্ন ওঠায় হাতে ভোট গণনার সিদ্ধান্তের পর বাস্তব পদ্ধতি অনুসরণ না করা। এ ব্যাপারে তাদের পর্যবেক্ষণ হলো এতে ধীরগতিতে ভোট গণনা চলে এবং ৪৮ ঘণ্টা পর নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণা করা হয়। এত দীর্ঘ সময় ব্যালট বাক্সগুলো নিশ্ছিদ্র থাকা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। নির্বাচনে নানা দায়িত্বে থাকা তিনজন সহকর্মী (শিক্ষক) নির্বাচনের অতিরিক্ত ব্যালট পেপার সরবরাহ ও অমোচনীয় কালির দাগ উঠে যাওয়ার অভিযোগ তুলে দায়িত্ব থেকে সরে যান- বিষয়টিকে শিক্ষক নেটওয়ার্ক বলেছে নির্বাচনের ত্রয়োদশ সমস্যা। চতুর্দশ সমস্যা হিসেবে তারা নানা অভিযোগ তুলে নির্বাচনের দিন দুপুরের পর অংশগ্রহণকারী ৮টি প্যানেলের মধ্যে ৫টি প্যানেলের নির্বাচন বর্জনের কথা উল্লেখ করেছে।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে সব খাবারের দোকান ও চায়ের দোকান বন্ধ রেখে জাকসু নির্বাচনের উৎসবমুখর পরিবেশকে দমবদ্ধ দশায় পরিণত করা হয় বলে বিবৃতিতে উল্লেখ করে শিক্ষক নেটওয়ার্ক। তাদের বিবৃতিতে বলা হয়, নির্বাচনের দিন দুপুরের পর থেকে জামায়াতে ইসলামীর নেতা-কর্মীদের বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ফটকে জড়ো হয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, শিক্ষার্থী, নির্বাচন কমিশন, তথা বিশ্ববিদ্যালয়ের সব বাসিন্দার ওপর মানসিক চাপ প্রয়োগ করতে দেখা যায়। বিষয়টিকে তারা বলছে জাকসু নির্বাচনের পঞ্চদশ সমস্যা। শিক্ষক নেটওয়ার্কের দৃষ্টিতে এই নির্বাচনের ষোড়শ ও শেষ সমস্যাটি হলো পাঁচজন নির্বাচন কমিশনারের মধ্যে দুজনের নির্বাচনে পক্ষপাতের অভিযোগ তুলে পদত্যাগ সত্ত্বেও তিনজন কমিশনারের স্বাক্ষরে নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণা।

 ‘এসব থেকে প্রতীয়মান হয় যে যেকোনো প্রকারে একটি দলকে জিতিয়ে নিয়ে আসার লক্ষ্যে সব মনোযোগ দেওয়া হয়েছে এবং প্রার্থী, রিটার্নিং কর্মকর্তা ও নির্বাচন কমিশনারদের বর্জন, পদত্যাগ ও সব অভিযোগকে উপেক্ষা করা হয়েছে। দুজন কমিশন সদস্যের পদত্যাগকে আমরা নির্বাচন পরিচালনায় প্রশাসনের সর্বাত্মক ব্যর্থতা হিসেবে দেখি। ’

নেটওয়ার্ক বলেছে, নির্বাচনের প্রাক্কালে ওএমআর যন্ত্রের দরপত্রবিষয়ক অভিযোগ ওঠে। একাধিক দল পরস্পরকে দোষারোপ করে। প্রশাসন সমস্যা সমাধানের রাস্তা হিসেবে ওএমআর ব্যবহার না করে সনাতনী ম্যানুয়েল পদ্ধতিতে গণনা শুরু করে। এ ধরনের কর্মকাণ্ড নেহাত প্রশাসনের দুর্বলতাকেই তুলে ধরে। এই বিপুল টাকা লগ্নির পর যন্ত্র ব্যবহার করতে না পারা নিছকই লজ্জাজনক। উপরন্তু সহকর্মীদের (শিক্ষক) ওপর অকথ্য পরিশ্রম চাপানোর কারণ তৈরি করেছে এটি। তখনই প্রশাসনের তাৎক্ষণিক জনবল বাড়ানো আবশ্যক ছিল।

বিবৃতির শেষে বলা হয়, ‘এটা স্পষ্টত প্রতীয়মান হয় যে নির্বাচনটি পক্ষপাতদুষ্ট হয়েছে এবং গ্রহণযোগ্যতা হারিয়েছে। এর দায়ভার বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের ওপরই বর্তায়। একই কারণে আমরা এই নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করি এবং মনে করি, সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে এসব কারসাজি উন্মোচন হওয়া জরুরি। ’

এনডি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।