চট্টগ্রাম: রাত দুইটা। সবাই যখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন, হঠাৎ বাড়িতে কড়া নাড়ে ডাকাত দল।
স্থানীয় ইউপি সদস্য আমানুল হক বলেন, গত বুধবার গভীর রাতে প্রায় ৩০ সদস্যের ডাকাত দল এলাকায় আসে। তাদের কাছে বন্দুক, ছুরিসহ দেশি অস্ত্র ছিল। এ সময় তারা আবুল কাসেমের ঘর থেকে ৬০ হাজার টাকা, ৪টি মুঠোফোন, আড়াই ভরি সোনার গয়নাসহ মালামাল লুট করে। এ ছাড়া মেহেদী হাসানের ঘর থেকে ৩ লাখ টাকা, সোনার গয়না, মুঠোফোনসহ অন্যান্য মালামাল নিয়ে যায়। বাধা দিলে মেহেদী হাসানের দুই ছেলেকে কুপিয়ে জখম করে তারা। পরে আশপাশের এলাকার মসজিদের মাইকে ডাকাত আসার খবর প্রচার করা হলে তারা পালিয়ে যায়। স্থানীয় লোকজন আহত ব্যক্তিদের উদ্ধার করে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যান।
চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকায় প্রতিনিয়ত ঘটছে চুরি-ছিনতাইসহ প্রকাশ্যে হত্যাকাণ্ডের ঘটনা। অপরাধ পরিস্থিতি ক্রমেই চলে যাচ্ছে নিয়ন্ত্রণের বাইরে। বিগত সময়ের তুলনায় চট্টগ্রামে চুরি-ছিনতাই ও ডাকাতির ঘটনা বেড়েছে। পুলিশ বলছে, সবসময় চেষ্টা থাকে এই অপরাধগুলো নিয়ন্ত্রণে রাখার। ছিনতাই রোধে পুলিশ বেশি সচেষ্ট। ছিনতাইয়ের ঘটনা যাতে কমে যায়, সে বিষয়ে সব ইউনিটের দায়িত্বশীলদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
গত ২২ মে ভোররাতে মীরসরাই সদর ইউনিয়নের তালবাড়িয়া এলাকার হাজি নুর আহমদ বাড়িতে চুরি হয়। এ সময় চোরের দল নগদ ৫ লাখ টাকা ও দেড় ভরি স্বর্ণালংকার নিয়ে যায়। চুরির ঘটনায় ভুক্তভোগী পরিবার থানায় লিখিত অভিযোগ দায়ের করে। ভুক্তভোগী ব্যবসায়ী সালাউদ্দিন জানান, তিনি রেন্ট-কার ও গরুর ব্যবসা করেন। সেদিন রাতে বাসায় ফিরে নগদ টাকা আলমারিতে রাখেন। পরে ফজরের নামাজ পড়তে উঠলে দেখেন, চোরের দল আলমারির তালা ভেঙ্গে নগদ ৫ লাখ টাকা ও দেড় ভরি স্বর্ণ নিয়ে যায়। এ সময় আলমারিতে থাকা প্রয়োজনীয় কাগজপত্রসহ একটি ব্যাগও নিয়ে যায় চোরের দল।
এর আগে ১৫ ডিসেম্বর মীরসরাই থানার পাশে ফারুকীয়া মাদ্রাসা সংলগ্ন একটি ভাড়া বাসা থেকে সন্ধ্যায় ১০ ভরি স্বর্ণালংকার লুট হয়। এতে ভুক্তভোগী দলিল লেখক আফসার নিঃস্ব হয়ে গেছেন। পুলিশকে অভিযোগ দিলেও প্রতিকার পাননি।
মীরসরাই থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আতিকুর রহমান জানান, চুরির ঘটনায় একটি অভিযোগ দিয়েছে ভুক্তভোগী পরিবার। আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
চলতি বছরের ৮ মার্চ পটিয়া উপজেলায় সংঘবদ্ধ ডাকাতি ঘটে। রাত ২টার দিকে উপজেলার হাইদগাঁও ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ডের শ্রীমতি বাড়ি এলাকায় ডাকাত দলের হামলায় আহত হন একই পরিবারের দুইজন উজ্জ্বল চন্দ (৪২) ও তার মা সন্ধ্যা রাণী চন্দ (৭৬)।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, গভীর রাতে ১০-১৫ জনের সংঘবদ্ধ ডাকাত হাইদগাঁও ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ডে হানা দেয়। প্রথমে তারা লোকনাথ মন্দির ও বিটন চন্দ নামে এক ব্যক্তির দোকানে লুটপাট চালায়। এরপর উজ্জ্বল চন্দের ঘরে ঢুকে ডাকাতি করার সময় চিৎকার করায় মা ও ছেলেকে মারধর করে রক্তাক্ত করে। ডাকাত দল বৃদ্ধা সন্ধ্যা রাণীর কানের দুল, টাকা ও অন্যান্য মূল্যবান সামগ্রী লুট করে নিয়ে যায়।
এর আগে বুধবার রাত দেড়টার দিকে উপজেলার ভাটিখাইন মাহবুব চেয়ারম্যানের বাড়ি এলাকায়ও একই কায়দায় ডাকাতি হয়। ওবাইদুল আলম শহিদ, আবু তাহের ও শামসুল আলমের ঘরে ডাকাত দল হানা দিয়ে স্বর্ণালঙ্কার, নগদ টাকা ও মূল্যবান সামগ্রী লুট করে নেয়।
প্রায় প্রতি সপ্তাহে দু’একটি বড় ডাকাতির ঘটনা ঘটছে পটিয়ায়। চুরি, ছিনতাই ও ডাকাতি বৃদ্ধি পাওয়ায় নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন উপজেলার কয়েক হাজার মানুষ। স্থানীয়রা দ্রুত প্রশাসনের কার্যকর পদক্ষেপ দাবি করেছেন।
চট্টগ্রামের প্রায় সব উপজেলার মানুষও অজানা আশঙ্কায় দিন কাটাচ্ছেন। বিশেষ করে বোয়ালখালী, সীতাকুণ্ড, সাতকানিয়া, লোহাগাড়া ফটিকছড়িসহ গ্রামীণ এলাকায় ডাকাতির ঘটনা প্রায়ই ঘটছে। এক্ষেত্রে স্থানীয় প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসন ব্যাপক তৎপরতা শুরু করেছে, তবে অপরাধীদের শক্তিশালী সিন্ডিকেটের কারণে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা কঠিন হয়ে উঠেছে।
পুলিশ জানিয়েছে, সড়ক ও দোকানগুলোতে সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপন ও পেট্রোলিং টিমের মাধ্যমে অপরাধ দমন করার চেষ্টা চালানো হচ্ছে। কিন্তু সিসিটিভি ক্যামেরা ও টহল পুলিশের উপস্থিতির পরও কিছু অপরাধী দ্রুত পালিয়ে যায়। চট্টগ্রামে সড়কদ্বারে পুলিশের টহল চললেও ছিনতাইকারীরা বিভিন্ন কৌশলে অপরাধ করে নিরাপদে পালিয়ে যাচ্ছে।
অপরাধ বিশ্লেষকেরা বলছেন, সরকার পরিবর্তনের পর থেকে চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর টহল কমে যাওয়ায় অপরাধীরা বেশি সক্রিয় হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে রাতের বেলায় বের হয়ে জীবনও যাচ্ছে। ডাকাতি ও দস্যুতার মামলা দিয়ে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির প্রকৃত চিত্র সবসময় বোঝা যায় না। পুলিশ যে ঘটনাগুলোতে তাদের কাছে অভিযোগ যায় কিংবা মামলা হয়, সেগুলোই নথিবদ্ধ করে। অনেক ক্ষেত্রে ভুক্তভোগী পুলিশের কাছে যান না ঝামেলার ভয়ে। থানাগুলো কখনো কখনো চুরি-ছিনতাইয়ের ঘটনায় মামলা না নিয়ে মূল্যবান জিনিসপত্র বা টাকা হারানোর সাধারণ ডায়েরি (জিডি) নেয়।
গত ২২ এপ্রিল মধ্যযুগীয় কায়দায় লোহাগাড়া উপজেলার সদর ইউনিয়নের দক্ষিণ সুখছড়ি বাকর আলী পাড়ায় ভোররাতে সংঘবদ্ধ একটি ডাকাত দল তিন পরিবারের সদস্য ও পথচারীসহ মোট ১৬ জনকে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অফিস কক্ষে হাত, পা, মুখ রশি দিয়ে বেঁধে তিন পরিবারের গোয়াল ঘরের তালা ভেঙ্গে ৪টি গরু, পথচারীর একটি মোটরসাইকেল, বিদ্যালয়ের একটি ল্যাপটপসহ নগদ অর্থ নিয়ে পালিয়ে যায়।
২৪ মার্চ উপজেলার কলাউজান ইউনিয়নের কানুরাম বাজারে ইফতারের আগে প্রকাশ্যে গাঁজা সেবনে বাধা দেওয়ায় নিজ চেম্বারে খুন হন বলিপাড়ার বাসিন্দা আজিজুর রহমানের ছেলে স্থানীয় পল্লী চিকিৎসক নুরুল হক। ২৫ ফেব্রুয়ারি উপজেলার পদুয়া ইউনিয়নের আলী সিকদারপাড়া গ্রামে জমি বিরোধকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট সংঘর্ষে পদুয়া ইউনিয়নের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান লেয়াকত আলী চৌধুরীর সামনেই ভাতিজা মুজিবর রহমানের লাঠির আঘাতে খুন হন তারই আপন চাচা মাহমুদুল হক (৭৪)।
১৪ জানুয়ারি রাতে কলাউজান ইউনিয়নের উত্তর কলাউজান রসুলাবাদ গ্রাম থেকে অনলাইন জুয়া খেলার কথা বলে বাড়ি থেকে জাহেদ (২০) নামক এক যুবককে তার দুই বন্ধু ইমন ও আসিফ ডেকে নিয়ে আসে। পরদিন সকালে চরম্বা রাবারড্যাম সংলগ্ন কালীবাড়ির পাশের জমি থেকে জাহেদের মরদেহ উদ্ধার করে থানা পুলিশ।
৫ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় পুটিবিলা ইউনিয়নের তাঁতীপাড়া নামক এলাকায় মাদ্রাসার সভা থেকে ফেরার পথে তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে বখাটেদের ছুরিকাঘাতে খুন হন পুটিবিলা উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির ছাত্র মোমিনুল ইসলাম। এ ঘটনায় নিহতের মা খুরশিদা বেগম বাদী হয়ে ৬ জনকে আসামি করে লোহাগাড়া থানায় মামলা দায়ের করেন। আসামিদের মধ্যে শাকিল নামক এক আসামিকে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল থেকে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আটক করে পুলিশের হাতে তুলে দেয় স্থানীয় জনতা।
গত বছরের ১৪ সেপ্টেম্বর লোহাগাড়ার চুনতি মিরিখীল এলাকায় চুনতি বাজার থেকে বাড়ি ফেরার পথে নিখোঁজ হন মিরিখীল এলাকার বাসিন্দা ইসহাক সওদাগরের পুত্র চুনতি বাজারের পান ব্যবসায়ী মো. হাসান উদ্দীন (৪৬)। নিখোঁজের দুদিন পর মিরিখীল রেললাইনের পাশের ব্রীজের নিচ থেকে হাসানের অর্ধগলিত মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ ও স্থানীয় জনতা। এ ঘটনায় নিহতের পরিবারের পক্ষে থেকে একটি হত্যা মামলা দায়ের করা হয়েছিল। এ মামলায় জোবাইর ও বাবু নামক দুজনকে গ্রেপ্তার করে থানা পুলিশ।
গত জানুয়ারিতে চুনতি বাজারে নিজ দোকান থেকে অপহৃত হন চুনতি বাজারের ব্যবসায়ী মো. ইসমাইল। পরে পরিবারের পক্ষ থেকে মুক্তিপণ দিয়ে কক্সবাজার থেকে উদ্ধার করে আনা হয় তাকে। ৬ মার্চ উপজেলার চরম্বা ইউনিয়নের ৩টি ইটভাটায় বেশ কয়েকটি মোটরসাইকেল নিয়ে চাঁদাবাজি করতে আসে পার্বত্য এলাকার সন্ত্রাসীরা। চাঁদা না পেয়ে অন্তত ৩০জন শ্রমিককে বেধড়ক মারধর করে গুরুতর জখম করে পালিয়ে যায় তারা।
একাধিক সূত্রে জানা গেছে, বিগত ছয়মাসে অন্তত ২০টি মোটরসাইকেল চুরি করে নিয়ে গেছে সংঘবদ্ধ চোরের দল। এছাড়াও বিভিন্ন এলাকায় গরু চুরি, মহিষ চুরি এবং প্রকাশ্যে ও গোপনে বেপরোয়া চাঁদাবাজির ঘটনা এক প্রকার অসহনীয় পর্যায়ে এসে ঠেকেছে। অন্যদিকে সামাজিক অস্থিরতা ও পারিবারিক কলহের কারণে আত্মহত্যার প্রবণতাও বেড়েছে। গত ছয় মাসে পাঁচজনের আত্মহত্যা এবং বেশ কয়েকটি ইভটিজিংয়ের ঘটনা ঘটেছে। লোকলজ্জার ভয়ে অনেকে আইনের আশ্রয় নিতে চায় না।
১০ এপ্রিল বোয়ালখালী উপজেলার পোপাদিয়া ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের আকলিয়া গ্রামের এক প্রবাসীর পাকা ঘরের দরজা ভেঙে পরিবারের সদস্যদের জিম্মি করে নগদ টাকা, স্বর্ণের গয়না লুট করে নিয়ে যায় ডাকাত দল। বাড়ির মালিক তানজিনা আক্তার তুহিন বলেন, ডাকাত দলের এক সদস্য সীমানা প্রাচীর টপকে বাড়িতে প্রবেশ করে প্রধান ফটকের তালা ভেঙে ফেলে। এরপর ঘরের কাঠের দরজা শাবল দিয়ে ভেঙে ৬-৭ জন ডাকাত ঘরে প্রবেশ করে। ঘরের সকল সদস্যকে ধারালো অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে হাত বেঁধে ফেলে। তারপর ওয়াশরুমে অবরুদ্ধ করে রাখে। আলমিরায় রক্ষিত নগদ ২ লাখ টাকা এবং ২৫-৩০ ভরি ওজনের স্বর্ণের গয়না ও একটি মোবাইল সেট নিয়ে গেছে ডাকাতদল। ডাকাত দলের সদস্যদের বয়স আনুমানিক ৩০-৩২ হবে। তাদের মুখে মাস্ক ছিল। এর মধ্যে একজন মুখোশ পরিহিত ছিল। ঘরে এই প্রবাসীর স্ত্রী তিন মেয়ে ও এক ছেলেকে নিয়ে থাকেন। ডাকাতদল প্রায় দুই ঘণ্টা ধরে ঘরটিতে তল্লাশি চালিয়ে সব জিনিসপত্র তছনছ করে ফেলে।
এ বিষয়ে জানতে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম অ্যান্ড অপস্) মো. সিরাজুল ইসলামের মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও তিনি সাড়া দেননি। পরে চট্টগ্রাম জেলা পুলিশ সুপার মো. সাইফুল ইসলাম সানতু’র সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করেও সাড়া মিলেনি।
বিই/টিসি