ঢাকা, সোমবার, ৩০ আষাঢ় ১৪৩২, ১৪ জুলাই ২০২৫, ১৮ মহররম ১৪৪৭

বাংলানিউজ স্পেশাল

যাত্রাবাড়ী আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজ

১৩ মাস বেতন বঞ্চিত শিক্ষকরা, দুর্নীতির অভিযোগ অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে

সুব্রত চন্দ, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১:৪০, জুলাই ১৩, ২০২৫
১৩ মাস বেতন বঞ্চিত শিক্ষকরা, দুর্নীতির অভিযোগ অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে যাত্রাবাড়ী আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজ

রাজধানীর যাত্রাবাড়ী আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মরিয়ম বেগমের বিরুদ্ধে অনিয়ম, দুর্নীতি ও প্রতিষ্ঠানের অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে। এসব অভিযোগ তদন্তে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) কাছে লিখিত অভিযোগও দিয়েছেন গত ১৩ মাস ধরে বেতন-ভাতা বঞ্চিত প্রতিষ্ঠানটির শতাধিক শিক্ষক।

বিভিন্ন অনিয়মের কারণে ঢাকা দক্ষিণের এই বিদ্যাপীঠের সুনাম যেমন ক্ষুণ্ণ হচ্ছে, তেমনি শিখন ঘাটতিতে পড়ছেন শিক্ষার্থীরা।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০০৪ সালে যাত্রাবাড়ী আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন মরিয়ম বেগম। তবে ২০০৮ সালে তিনি চাকরি ছেড়ে দেন। পরে ২০১৩ সালে সহকারী প্রধান শিক্ষক হিসেবে আবার যোগ দেন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটিতে। ২০২০ সালে দায়িত্ব নেন ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের।

অভিযোগ রয়েছে, ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হওয়ার পর বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন মরিয়ম বেগম। এমনকি সহযোগীদের নিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির অর্থ আত্মসাতের মতো গুরুতর অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে। তার এসব অনিয়মের কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটিতে প্রতিনিয়ত শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমছে বলে জানিয়েছেন একাধিক শিক্ষক। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটিতে ২ হাজার ১০০ এর বেশি শিক্ষার্থী রয়েছে।



জানা যায়, বিগত সরকারের আমলে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে পৃষ্ঠপোষকতা করেন মরিয়ম বেগম। যে কারণে নানা অনিয়ম ও দুর্নীতি করেও স্বপদে বহাল থাকেন তিনি। আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হলে গত ১৯ আগস্ট ছাত্র-জনতার দাবির মুখে মরিয়ম বেগম পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। তার জায়গায় বসানো হয় জুনিয়র এক শিক্ষককে। তবে কয়েকদিনের মধ্যেই হাইকোর্টে রিট আবেদন করে তিনি আবার ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের চেয়ারে বসেন।

মরিয়ম বেগমের আর্থিক অনিয়মের বিরুদ্ধে গত ১৬ জুন দুদক চেয়ারম্যানের কাছে অভিযোগ করেন যাত্রাবাড়ী আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের সহকারী শিক্ষক সৈয়দা আরিফুন নাহার। সেই অভিযোগের আবেদনপত্রে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির আরও শতাধিক শিক্ষকের স্বাক্ষর রয়েছে। বাংলানিউজের কাছে সেই অভিযোগপত্রের কপি রয়েছে।

দুদকে করা সেই অভিযোগে বলা হয়, যাত্রাবাড়ী আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মরিয়ম বেগম ২০১৯ সাল থেকে ধারাবাহিকভাবে একাধিক আর্থিক অনিয়ম ও অপশাসনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানের স্বাভাবিক প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক কাঠামোকে ধ্বংস করে চলেছেন। এই অনিয়মের ফলে শিক্ষক-কর্মচারীদের দীর্ঘ ১২ মাসের বেতন-ভাতা বকেয়া রয়েছে, যা তাদের পরিবারসহ মানবেতর জীবনযাপনের দিকে ঠেলে দিয়েছে।

অভিযোগে আরও বলা হয়, শিক্ষকদের ন্যায্য পাওনা পরিশোধ না করে উন্নয়নের নামে উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে ভাউচার তৈরির মাধ্যমে মোটা অঙ্কের অর্থ আত্মসাৎ করা হয়েছে এবং এখনও হচ্ছে। কেউ বেতন দাবি করলেই চাকরিচ্যুতির হুমকি দেওয়া হয়। ফলে প্রতিষ্ঠানে ভয় ও অনিশ্চয়তা বিরাজ করছে। ২০১৯ সাল পরবর্তী সময়ে প্রতিষ্ঠানের আয়-ব্যয়ের কোনো স্বচ্ছতা বা জবাবদিহিতা বিদ্যমান নেই। তিনি একক কর্তৃত্বে স্বৈরাচারীভাবে প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করছেন, যা একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জন্য অত্যন্ত অশোভন ও অগ্রহণযোগ্য।

ভুক্তভোগী শিক্ষকদের অভিযোগ, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের জন্য যাত্রাবাড়ী আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের একাংশ ভেঙে ফেলা হয়। এর ক্ষতিপূরণ হিসেবে সরকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটিকে দুটি চেকে প্রায় ৮ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দিয়েছে। তবে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগে দপ্তর সম্পাদক রিয়াজ উদ্দিন রিয়াজের সঙ্গে মিলে সেই টাকা আত্মসাৎ করেছেন ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মরিয়ম বেগম। রিয়াজ উদ্দিন রিয়াজ সে সময় প্রতিষ্ঠানটির গভর্নিং বডির সভাপতি ছিলেন।

এ ছাড়া মরিয়ম বেগমের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে, ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হওয়ার পর ২০১৯ সাল থেকে ২০২৫ সালের মে মাস পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে নেওয়া সেশন চার্জ, বেতন, পরীক্ষার ফি, জেনারেটর ফি ও সনদ বিতরণ ফি বাবদ প্রাপ্ত বিপুল অর্থের কোনো হিসাব তিনি উপস্থাপন করেননি। শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায়ও অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।

যাত্রাবাড়ী আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজ সংলগ্ন তিনটি দোকান বরাদ্দের ৩০ লাখ টাকা ও মাসিক ভাড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাবে মরিয়ম বেগম জমা দেননি বলেও অভিযোগ রয়েছে। এমনকি সাধারণ শিক্ষকদের গ্রাচুইটি ফান্ড থেকে তাদের টাকা উত্তোলন করে নেওয়ারও অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। আবার, শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন থেকে নিয়মিত প্রভিডেন্ট ফান্ড কর্তন করা হলেও, তা সংশ্লিষ্টদের ব্যাংক হিসাবে জমা দেওয়া হচ্ছে না বলে অভিযোগ করেছেন ভুক্তভোগী শিক্ষকরা। এসব অভিযোগের পাশাপাশি মরিয়ম বেগমের বিরুদ্ধে প্রতিষ্ঠানের অর্থ ব্যবহার করে মামলা চালানোরও অভিযোগ রয়েছে।

এদিকে প্রতিষ্ঠানের ফান্ড থেকে কোটি কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ থাকলেও গত ১৩ মাস ধরে বেতন-ভাতা পাচ্ছেন না শতাধিক শিক্ষক। পাশাপাশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটিতে নিয়মিত পাঠদানও হচ্ছে না। চলতি বছরের সিলেবাস তৈরি করা হয়েছে গত জুন মাসে। এর ফলে শিক্ষার্থীদের শিখন বিঘ্নিত হচ্ছে।

বেতন না পাওয়া শিক্ষকদের অভিযোগ, মরিয়ম বেগমের অনিয়ম ও দুর্নীতির বিষয়ে কথা বললে এবং পাওনা বেতন চাইলে তার রোষানলে পড়তে হচ্ছে শিক্ষকদের। সম্প্রতি এমন তিন শিক্ষককে বিভিন্ন অপরাধ দেখিয়ে কারণ দর্শনোর নোটিশও দেওয়া হয়েছে। দুদকে অভিযোগ করা শিক্ষক সৈয়দা আরিফুন নাহারকে কারণ দর্শনোর নোটিশের পাশাপাশি পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত শিক্ষপ্রতিষ্ঠানটিতে প্রবেশ না করারও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

সৈয়দা আরিফুন নাহার বাংলানিউজকে বলেন, আমার ওপর অন্যায় করা হয়েছে। আমি ১৫ বছর ধরে এই প্রতিষ্ঠানে রয়েছি। আমি কোনোদিন প্রতিষ্ঠানে উশৃঙ্খল আচরণ করিনি এবং প্রতিষ্ঠানের সুনাম ক্ষুণ্ন হয় এমন আচরণ করিনি। তারপরও আমার বিরুদ্ধে বিভিন্ন ধরনের অন্যায় পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। কারণ আমি অনিয়মের বিরুদ্ধে কথা বলেছি, নিজের প্রাপ্য চেয়েছি।

তিনি আরও বলেন, আমরা ১৩ মাস বেতন পাই না। একদিকে যেমন আমরা মানবেতর জীবন-যাপন করছি, অন্যদিকে সামাজিকভাবে হয়রানির শিকার হচ্ছি। টাকার জন্য মানুষের দ্বারে দ্বারে যেতে হচ্ছে। প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন উন্নয়ন কাজ দেখিয়ে টাকা হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে, কিন্তু শিক্ষকদের বেতন দেওয়া হচ্ছে না। যাত্রাবাড়ী আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজে শিক্ষকদের বাকস্বাধীনতা নেই। ভীষণরকম কষ্টে তারা আছে, মানবেতর জীবন-যাপন করছে।

সৈয়দা আরিফুন নাহার বলেন, শিক্ষকদের বেতন না হওয়ার কারণ আর্থিক অনিয়ম, জবাবদিহিতা না থাকা ও দুর্নীতি। আর্থিক দুর্নীতি যদি না হতো তাহলে শিক্ষকদের ঠিকমতো বেতন হয়। কারণ প্রতিনিয়ত শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে বিভিন্ন ফি নেওয়া হচ্ছে। এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের জন্য ক্ষতিপূরণ হিসেবে ৮ কোটি টাকা পেয়েছে প্রতিষ্ঠান। সেসব টাকা দিয়েই অনায়াসে শিক্ষকদের বেতন দেওয়া সম্ভব।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক যাত্রাবাড়ী আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের আরেকজন প্রভাষক বলেন, আমরা দেখছি ছাত্র-ছাত্রীরা বেতন দিচ্ছে। কিন্তু প্রশাসন বলে শিক্ষার্থী নেই। আসলে তা না। যতদূর জানি তারা (মরিময় বেগম ও তার সহযোগীরা) ভাউচার বানিয়ে নিজেরা নিচ্ছে টাকাগুলো। অনেক রাত পর্যন্ত অফিস খোলা থাকে। সেখানে ভাউচার বানানো হয়। আর টাকাগুলো তারা ব্যক্তিগতভাবে নিয়ে নেয়। প্রতিষ্ঠানের ব্যাংকে আর জমা দেয় না। তা না হলে আমরা বেতন পাই না কেন? শিক্ষর্থীদের তিন মাসের ফি দিয়ে শিক্ষকদের দুই মাসের বেতন দেওয়া সম্ভব।

তিনি আরও বলেন, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের জন্য আমাদের প্রতিষ্ঠানের স্কুল ও কলেজের দুটি ভবন ভাঙা হয়। সেই দুই ভবনের জন্য পৃথকভাবে ২ কোটি ও ৬ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দেয় সরকার। সেই টাকাও নেই। এমনকি সেসব ওইসব ভবনে যেসব বেঞ্চ, চেয়ার, টেবিল ও ফ্যান ছিল, সেগুলোও তারা সাড়ে ৪ লাখ টাকায় বিক্রি করে আত্মসাৎ করেছে মরিয়ম বেগম ও তার লোকজন।

এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে মোবাইল ফোনে যাত্রাবাড়ী আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মরিয়ম বেগমের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি ফোনে কথা বলতে অস্বীকৃতি জানান। পরবর্তীতে তার অফিসে গেলে তিনি বেশিরভাগ অভিযোগের বিষয়ে কোনো কথা বলেননি। তবে কয়েকটি অভিযোগের বিষয়ে তিনি তার ব্যাখ্যা দেন।

শিক্ষকরা কেন ১৩ মাস ধরে বেতন বঞ্চিত জানতে চাইলে মরিয়ম বেগম বলেন, প্রতি মাসে প্রতিষ্ঠানের আয় হয় ১৩ লাখ টাকা, আর শিক্ষকদের বেতন দিতে হয় ২৬ লাখ টাকার বেশি। আয়ের থেকে ব্যয় বেশি। আয় না থাকলে ব্যয় করবেন কীভাবে? আর গত ১৭ বছর যদি অনেক অনিয়ম হয়ে থাকে এর দায় কে নেবে? এসব বিষয়ে ইতোমধ্যে মন্ত্রণালয়ে তদন্ত চলছে।

এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের জন্য ক্ষতিপূরণ হিসেবে সরকারের কাছ থেকে ৮ কোটি টাকা পাওয়ার পরও শিক্ষকদের কেন বেতন দেওয়া হচ্ছে না জানতে চাইলে তিনি বলেন, সরকারের কাছ থেকে ৫ কোটি ৯০ লাখ টাকা পেয়েছি। সেখান থেকে ২ কোটি টাকা প্রতিষ্ঠানের ফান্ডে জমা রাখা হয়েছে। আর এই টাকা তো শিক্ষকদের বেতন দেওয়ার জন্য নয়। এটা প্রতিষ্ঠানের উন্নয়নের জন্য। তারপরও সেখান থেকে শিক্ষকদের ১১ মাসের বেতন দেওয়া হয়েছে।

এরপর অন্যান্য অভিযোগের বিষয়ে বিষয়ে জানতে চাইলে মরিয়ম বেগম সেগুলো এড়িয়ে যান এবং প্রমাণসহ লিখিত অভিযোগ দিতে বলেন।

এসসি/এমজেএফ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।