ঢাকা: রাজধানীর মিটফোর্ড হাসপাতালের সামনে ঘটে যাওয়া নারকীয় হত্যাকাণ্ড নাড়িয়ে দিয়েছে গোটা দেশকে। বুধবার (৯ জুলাই) চকবাজারের ব্যস্ত সড়কে ভাঙারি ব্যবসায়ী লাল চাঁদ ওরফে সোহাগকে প্রকাশ্যে পিটিয়ে এবং ইট-পাথর দিয়ে মাথা ও শরীর থেঁতলে হত্যার এই ঘটনায় স্তব্ধ পুরো দেশ।
নিহত সোহাগকে হত্যার অভিযোগে অভিযুক্তরা বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত বলে জানা যায়। সোহাগও এক সময় যুবদলের কর্মী ছিল জানায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এরই মধ্যে এ ঘটনায় জড়িত ৫ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। মামলাটি দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে স্থানান্তর করে দ্রুততম সময়ের মধ্যে বিচারের কথা জানিয়েছেন সরকারের আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল।
প্রথমে এ ঘটনাকে "চাঁদা না দেওয়ায়" হত্যার ঘটনা হিসেবে উল্লেখ করলেও র্যাবের পক্ষ থেকে জানানো হয়, ব্যবসায়িক কোন্দল থেকে এই হত্যাকাণ্ড ঘটেছে বলে প্রাথমিকভাবে তারা জানতে পেরেছে। এই ঘটনার দুই দিন পর এর ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার পর দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে আবারও প্রশ্ন উঠেছে।
অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ এগারো মাস পার হওয়ার পরও প্রকাশ্য দিবালোকে এমন ঘটনা ঘটায় বিস্ময় প্রকাশ করছেন সাধারণ জনগণ থেকে শুরু করে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। পুলিশ, আনসার, র্যাব এবং সেনাবাহিনী মাঠে উপস্থিত থাকার পরও জনবহুল একটি স্থানে এমন নারকীয় হত্যাকাণ্ড কীভাবে ঘটতে পারে, তা নিয়ে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছে ক্ষোভ।
৫ আগস্টের পর বিএনপির কিছু উচ্ছৃঙ্খল নেতাকর্মীদের চাঁদাবাজির সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ সারা দেশ থেকেই পাওয়া গিয়েছে। দল থেকে তাৎক্ষণিকভাবে সেসব ঘটনায় শাস্তিমূলক পদক্ষেপ নিয়ে বহিষ্কারের নজিরও মিলেছে। ইতোমধ্যেই নানা ঘটনায় দুই হাজারেরও বেশি নেতাকর্মী বহিষ্কারের কথা জানা গেছে।
মিটফোর্ডের ঘটনাতেও ৫ জনকে আজীবন বহিষ্কার করেছে যুবদল। তবে প্রশ্ন উঠেছে, ১৭ বছর নির্যাতিত-নিগৃহীত হয়ে ফ্যাসিবাদের পতন ঘটানোর পরও কেন দলটি পতিত ফ্যাসিবাদ থেকে এখনো শিক্ষাগ্রহণ করলো না? কেন এখনো প্রতিদিনই দলের হাইকমান্ডকে দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের দায়ে কাউকে না কাউকে বহিষ্কার করতে হচ্ছে? দলীয় হাইকমান্ডকেও কেন অগ্রাহ্য করে এমন ঘটনাগুলোতে জড়িয়ে যাচ্ছে নেতাকর্মীরা?
বিএনপির নেতৃত্ব এখন মূলত পরিচালিত হচ্ছে লন্ডন থেকে। দলের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া শারিরীকভাবে দল চালানোর মতো সক্ষম নন। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান দীর্ঘদিন নির্বাসিত রয়েছেন লন্ডনে। দলের নেতাকর্মীরা ১৭ বছর যাবত নানাভাবে অত্যাচারিত, নিপীড়িত হয়েছেন। দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাইরে থাকার কারণে কেন্দ্র ও তৃণমূলের মধ্যে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে আছে। স্থানীয় নেতৃত্ব কার্যত স্বেচ্ছাচারী হয়ে উঠেছে। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বেপরোয়া এই নেতাকর্মীদের সামলাতে তৃণমূল থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখছেন দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান। তবে তার সশরীরে দেশের মাটিতে উপস্থিত না থাকাতে দলের নেতাকর্মীরা থেকে যাচ্ছেন নিয়ন্ত্রণের বাইরে।
যদিও মিটফোর্ডের ঘটনায় তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে দৃষ্টামূলক শাস্তি দাবি করেছে বিএনপি। দলের পক্ষ থেকে এ ঘটনায় জড়িত ৫ জনকে আজীবন বহিষ্কারের পাশাপাশি তৃণমূল থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত শুদ্ধি অভিযান চালানোরও সিদ্ধান্ত নিয়েছে তারা। হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরও।
শুক্রবার (১১ জুলাই) গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে বিএনপির মহাসচিব বলেন, এই পৈশাচিক ঘটনা কেবল একটি জীবনহানিই নয়, এটি রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা, নাগরিক অধিকার ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় গভীর হতাশার বহিঃপ্রকাশ। আমাদের সংগঠনের নীতি, আদর্শ ও রাজনীতির সঙ্গে সন্ত্রাস এবং বর্বরতার কোনো সম্পর্ক নেই। অপরাধী যেই হোক, তার স্থান কখনোই আইন ও ন্যায়বিচারের ঊর্ধ্বে হতে পারে না। বিবৃতিতে, অন্তর্বর্তী সরকারকে অবিলম্বে নিরপেক্ষ ও বিশ্বাসযোগ্য তদন্ত নিশ্চিত করে এবং প্রকৃত অপরাধীদের আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দৃষ্টান্ত স্থাপন করার আহ্বান জানান তিনি।
এদিকে মিটফোর্ড হত্যাকাণ্ডে যুবদল থেকে ৫ জনকে বহিষ্কার করা প্রসঙ্গে কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরার অনুসন্ধানী সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মী জুলকারনাইন সায়ের বিএনপিকে উদ্দেশ্য করে তার ফেসবুকে লিখেছেন, "এসব না করে পুরো টপ-টু-বটম ঢেলে সাজান। আগা এবং গোঁড়ায় টক্সিন রেখে এসব বহিষ্কার-বহিষ্কার খেলা এক প্রকারের 'মকারী' বৈ কিছুই না। "
দেশে এখন দৃশ্যত কোনো রাজনৈতিক সরকার না থাকলেও কোনো ঘটনার দায় চাপানোর পুরোনো রাজনৈতিক কৌশল দেখা যাচ্ছে এই হত্যাকাণ্ডেও। হত্যাকাণ্ডে বিএনপির কর্মীরা যুক্ত থাকার অভিযোগ উঠায় 'সাধারণ শিক্ষার্থীদের' নামে শুক্রবার (১১ জুলাই) রাতে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মিছিল বের করা হয়। এসব মিছিলে বিএনপি ও দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বিরুদ্ধে স্লোগানে দেওয়া হয়েছে।
এসব স্লোগানের ভাষা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। অশ্লীল শব্দে মোড়ানো এসব স্লোগানকে রাজনৈতিক অঙ্গনের জন্য অশনিসংকেত হিসেবে উল্লেখ করছেন তারা। তারেক রহমানকে ঘিরে এসব মিছিল এবং স্লোগানকে অনেকটাই পরিকল্পিত বলেও মনে করছেন বিএনপির নেতারা এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের কেউ কেউ। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকেও তারেক রহমানের নাম উল্লেখ করে কেউ কেউ ক্ষোভ প্রকাশ করে পোস্ট দিয়েছেন।
শুক্রবার (১১ জুলাই) জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম এক ফেসবুক পোস্টে তারেক রহমানকে উদ্দেশ্য করে লিখেছেন, "সবাই খারাপ আর উনি ভালো, বাংলাদেশে এই নাটক আর চলবে না। আপনার দলের নেতাকর্মী নামক কতিপয় নরপিশাচকে সামলান, জনাব তারেক রহমান। যে নিয়মে আওয়ামী লীগের করা হত্যার দায় খুনী হাসিনার উপর বর্তায়, সেই একই নিয়মে বিএনপি, যুবদল, ছাত্রদলের নেতা-কর্মীদের করা খুনের দায় আপনার উপরেও বর্তায়। "
একই দিনে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় এবং যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়াও নিজের ফেসবুকে লেখেন, “প্রস্তর যুগে স্বাগতম। কেউ ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিবেন না, ধন্যবাদ। ” তার এমন স্ট্যাটাস নিয়ে এরই মধ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সমালোচনার ঝড় উঠেছে। সরকারের একজন উপদেষ্টা পদে থেকে এই সরকারের আমলে এমন একটি হত্যাকাণ্ডের দায় না নিয়ে বরং এ সময়কে তিনি প্রস্তর যুগের সঙ্গে তুলনা করে অথবা অতীত থেকে শিক্ষা না নেওয়ার কথা উল্লেখ করে আদতে বিএনপির উপরই দায় চাপানোর চেষ্টা করছেন বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
দায় চাপানোর এই রাজনৈতিক চর্চাও বেশ পুরোনো বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। তারা প্রশ্ন তুলছেন, সমসাময়িক সময় ঘটে যাওয়া খুলনায় যুবদল কর্মীকে গুলি করে ও রগ কেটে হত্যা কিংবা চাঁদপুরে মসজিদে ইমামকে কুপিয়ে আহত করার ঘটনাগুলো নিয়ে নীরব থেকে কেন কিছু বিশেষ দল এবং গোষ্ঠীর সমর্থক এবং নেতারা শুধুমাত্র মিটফোর্ডের হত্যাকাণ্ড নিয়েই সরব হয়ে উঠেছেন?
রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টরা সন্দেহ প্রকাশ করছেন- বিএনপিকে কোণঠাসা করার লক্ষ্যে এবং রাজনৈতিক ফায়দা নেওয়ার উদ্দেশ্যেই কি মিটফোর্ডের ঘটনাকে হাতিয়ার বানানো হচ্ছে? পরিকল্পিতভাবে দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্য একটি হত্যাকাণ্ডকে রাজনৈতিক দুরভিসন্ধি বাস্তবায়নে ব্যবহৃত হচ্ছে কি?
এ প্রসঙ্গে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বাংলানিউজকে বলেন, "অপরাধীর ক্ষেত্রে আমাদের দলের অবস্থান জিরো টলারেন্স। তবে এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা হিসেবে বহিষ্কার করার পরও সমস্ত দায় যেভাবে বিএনপির উপর চাপানো হচ্ছে, এটা নোংরা রাজনৈতিক চর্চা। দল হিসেবে যেটুকু আমাদের এখতিয়ারে আছে, আমরা করেছি। সরকারকেও সহযোগিতা করছি। আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার দায়িত্ব তো এখন সরকারের। বিএনপি বা তার অঙ্গসংগঠন কোনো অপরাধীকে প্রশ্রয় দেয়নি, ভবিষ্যতেও দেবে না। "
এদিকে এই হত্যাকাণ্ডে ঘটনায় সিসিটিভি ফুটেজে যাদের জড়িত দেখা গেছে, তাদের তিনজনকে বাদ দিয়ে পুলিশ নিরপরাধ তিনজনকে আসামি করেছে বলে অভিযোগ করেছেন যুবদল সভাপতি আবদুল মোনায়েম মুন্না। শনিবার (১২ জুলাই) স্বেচ্ছাসেবক দল ও যুবদলের এক যৌথ সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, "কারা কেন এ তিনজন আসামিকে বাদ দিয়ে নতুন করে অন্য তিনজনকে আসামি করলো, এটা জানতে চাই। বুধবারের ঘটনা, প্রচার হলো শুক্রবার। দুদিন পর কেন? সেটাও আমাদের প্রশ্ন। সিসিটিভি ফুটেজে যাদের দেখা যাচ্ছে, তাদের সবাইকে গ্রেফতার করা উচিত। "
এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনা রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির জন্য ব্যবহার হচ্ছে কি না? অথবা তারেক রহমানের দেশে ফেরার পথে বাধা সৃষ্টি করতে এবং জাতীয় নির্বাচনের পরিবেশকে বিঘ্নিত করার জন্য এই ঘটনাটিকে অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে কি না- এমন সন্দেহও উড়িয়ে দিচ্ছে না রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। শিক্ষক, সাংবাদিক ও কলামিস্ট আনিস আলমগীর এ প্রসঙ্গে বাংলানিউজকে বলেন, "বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মিছিল থেকে যে ধরনের স্লোগান দেওয়া হলো, রাজনৈতিক স্লোগানের এত অশ্লীল বিবর্তন আমরা আশা করি না। যারা ক্ষোভ প্রকাশ করছিল, এরা কারা? ড. ইউনূসের সরকার দেশ পরিচালনা করছে, তাদের সময়ে এমন ঘটনা ঘটলো। তাদের দায়-দায়িত্বটা কোথায়? দেশে কি আদৌ সরকার আছে?"
কেন এই ঘটনায় সরাসরি তারেক রহমানকে দায়ী করা হবে প্রশ্ন রেখে তিনি বলেন, "তারেক রহমান তো ক্ষমতায় নাই। যে ক্ষমতায় নাই, তাকে কীভাবে বলা যাবে- আপনি দায়ী? গণ অভ্যুত্থানের পর আমরা আশা করেছিলাম তারেক রহমান দেশে আসবেন, উনার দলকে নেতৃত্ব নেবেন এবং যেসব পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে তার দলের মধ্যে- চাঁদাবাজি, মারামারি, মব, দলের প্রধান হিসেবে সে জায়গায় আমি তাকে দায়ী করি। ৫ আগস্টের পরই উনার দেশে আসা উচিত ছিল। পৃথিবীর বহু রাষ্ট্রের নেতা এভাবে দেশের বাইরে থাকেন, কিন্তু রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর দেশে ফিরে আসেন। তারেক রহমানও আসতে পারতেন। উনি দেশে এসে তার দলের হাল ধরার সুযোগটা নিতে পারতেন। নেতাকর্মীদের মধ্যে যে খাই খাই ভাব আছে, সেটাকে কন্ট্রোল করতে পারতেন এবং দলটাকে গুছিয়ে আগামী নির্বাচনে তারা কীভাবে সরকারে যেতে পারেন, সেটা ঠিক করতে পারতেন। তার উচিত ছিল দলের লাগাম টেনে ধরা, কিন্তু সেটা হচ্ছে না।
এখন যে পরিস্থিতি বিরাজ করছে, তাতে তারেক রহমানের দেশে ফেরা নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করে তিনি বলেন, "তার বিরুদ্ধে যে ধরনের নোংরা স্লোগান দেওয়া হচ্ছে, তাতে মনে হচ্ছে, তাকে ভিক্টিম করার আরেকটা প্ল্যান বাস্তবায়নের পর্ব চলছে, যেন সে দেশে না আসতে পারেন। এখন তিনি ফিরবেন কি না, আমি নিশ্চিত না। এর আগে সরকার বলেছিল তার নিরাপত্তা দিতে পারবে না। কিন্তু ১৩ জুন ড. ইউনূসের সঙ্গে তার বৈঠকের পর ভেবেছিলাম তিনি ফিরে আসবেন। ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের প্রক্রিয়া এগিয়ে যাবে। "
সামনে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি কোন অবস্থানে যাবে, তা নিয়েও আশঙ্কা প্রকাশ করেন আনিস আলমগীর। তিনি বলেন, "জামায়াতে ইসলামী এখন যেই সুরে কথা বলছে, এই পরিস্থিতে নির্বাচন কীভাবে হওয়াবে? এই মাসের ১৯ তারিখ ঢাকায় জামায়াতের সমাবেশ করার কথা রয়েছে। রাজনীতির গতিপ্রকৃতি তখন কোনদিকে যায়, জানি না। আওয়ামী লীগ তো এখন দৃশ্যের বাইরে। বাকি যারা আছে, তারা এখন একজোট হয়ে নেমেছে তারেক রহমান এবং বিএনপির বিরুদ্ধে। তাহলে কি তারা জোট বেঁধে বিএনপির বিরুদ্ধে ইলেকশন করবে কি না?"
৫ আগস্টের পর যে মব ভায়োলেন্সের ঘটনাগুলো ঘটেছে, সেখানে বিএনপি একা শুধু নয়, জামাত-শিবিরের লোক ছিল, এনসিপির লোক ছিল জানিয়ে তিনি আরও বলেন, "মিটফোর্ডের এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় ছাত্রদল, যুবদল ও স্বেচ্ছাসেবক দলের সদস্যরা জড়িত ছিল, যিনি মারা গেছেন, তিনিও বিএনপির লোক। কিন্তু এখানে শুধু বিএনপিকে দায়ী করা হচ্ছে। কেন? ৫ আগস্টের পর এই সংস্কৃতি তো সবাই মিলে চালু করেছে। এই মবের কালচার ড. ইউনূস সরকার যে চালু করেছিল, এরই সর্বশেষ ধারাবাহিকতা হচ্ছে মিটফোর্ডের ঘটনা। এটা এখনো চলমান, আগামীতেও ঘটবে। পুলিশ, আনসার, র্যাব, সেনাবাহিনী রাস্তায় থাকার পরও দিবালোকে এমন ঘটনা কীভাবে ঘটতে পারে? এর মানে সরকারের কোথাও না কোথাও দুর্বলতা রয়ে গেছে। সরকার এগুলোকে প্রশ্রয় দিচ্ছে। "
দিনের আলোয়, অসংখ্য মানুষের সামনে হাসপাতালের প্রবেশপথ, যেখানে সাধারণত সবসময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উপস্থিতি থাকে, সেই স্থানেও এই হত্যাকাণ্ড ঘটার সময় কোনো প্রতিরোধ দেখা যায়নি। এহেন নিষ্ক্রিয়তা কি কেবল ব্যর্থতা, নাকি এর গভীরে আছে সচেতন নীরবতা? বিশ্লেষকরা আশঙ্কা প্রকাশ করে বলছেন, এতটা নৃশংস হত্যাকাণ্ডের ভিডিওটি কেবল সহিংসতার প্রমাণ নয়, বরং এটি একটি বার্তা- যা হয়তো ভয় ছড়াতে, কিংবা জনমত প্রভাবিত করতে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ব্যবহৃত হয়েছে।
ঠিক এক বছর আগে ঘটে যাওয়া জুলাই গণঅভ্যুত্থানের বিপরীতে রাষ্ট্রীয় শৃঙ্খলা ও আইনের শাসনের পতনের এমন আভাস দেশের জন্য অশনিসংকেত বলে মনে করছেন তারা। দেশ যখন একটি সুষ্ঠু রাজনীতির ধারা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণের দিকে এগিয়ে যাওয়ার পথে হাঁটছিল, বহু বছর পর জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের সরকার গঠনের স্বপ্ন দেখছিল, ঠিক সেসময় এমন নৃশংস হত্যাকাণ্ডের ঘটনা এবং এর মাধ্যমে রাজনৈতিক কাদা ছোড়াছুড়ির পুরোনো সংস্কারের চর্চাতে ফ্যাসিস্টের ফিরে আসার পথ সুগম করতে কোনো ষড়যন্ত্র চলছে কি না- এমন প্রশ্নও ছুড়ছেন রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টরা।
একই আশঙ্কা জানিয়েছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানও। শনিবার (১২ জুলাই) গুলশানে হোটেল লেকশোরে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের এক অনুষ্ঠানে তিনি সবাইকে সজাগ থাকার আহ্বান জানিয়ে বলেন, "দেশে ষড়যন্ত্র শেষ হয়নি, ষড়যন্ত্র আবারও শুরু হয়েছে, জোরেশোরে শুরু হয়েছে। সবার কাছে আহ্বান থাকবে আবারও আপনাদের সোচ্চার এবং সচেতন হতে হবে। কারা কীভাবে ষড়যন্ত্র করছে, কারা কীভাবে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন কথা বলছে এবং ক্ষণে ক্ষণে অবস্থান পরিবর্তন করছে, এসব বিষয়ে সচেতন থাকতে হবে। আমাদের সবাইকে চোখ-কান খোলা রাখতে হবে। আমাদের যে যুদ্ধ ছিল গণতান্ত্রিক অধিকার, মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার, সেই যুদ্ধ কিন্তু এখনো শেষ হয়ে যায়নি। "
এই দেশ সবার উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, "কারা কী করছে, কারা কী ভূমিকা রাখছে, কারা কী বর্তমানে বলছে? বলার মধ্যে পার্থক্য কী? তাদের অবস্থান ঘনঘন পরিবর্তন করছে, এই সকল বিষয়ে আপনারা নজরে রাখবেন। প্রশাসনের মধ্যে এখনো বিগত স্বৈরাচারের ভূত লুকিয়ে আছে। কাজেই সেই ভূত এবং বর্তমানের নতুন কোনো ভূত যদি থাকে, তারা কী ষড়যন্ত্র করছে, সেই ষড়যন্ত্র সম্পর্কে সবাই সচেতন থাকতে হবে। যদি আমরা সচেতন না হই, এ দেশকে টিকিয়ে রাখা মুশকিল হবে। "
বিএনপি দেশ চালাচ্ছে না উল্লেখ করে তারেক রহমান বলেন, "বিএনপি তো চালায় না! চালাচ্ছে তো সরকার। তাহলে সরকার কেন ব্যবস্থা নিচ্ছে না খুনিদের বিরুদ্ধে। দলের হোক বা অন্য কেউ হোক, কেন ব্যবস্থা নিচ্ছে না? আমাদের পক্ষ থেকে তো একবারও বলা হয়নি অমুককে ধরা যাবে না, তমুককে ধরা যাবে না। আমরা বরাবরই বলেছি, অন্যায়কারীর আইন অনুযায়ী বিচার হবে। দলের সঙ্গে তার কী সম্পর্ক কিচ্ছু যায় আসে না তাতে। কেউ যদি কোনো অন্যায় করে থাকে, তাকে দল কোনো রকম প্রশ্রয় দেবে না। "
এসবিডব্লিউ/জেএইচ