ঢাকা, মঙ্গলবার, ২৮ আশ্বিন ১৪৩২, ১৪ অক্টোবর ২০২৫, ২১ রবিউস সানি ১৪৪৭

বাংলানিউজ স্পেশাল

লুট হওয়া চাইনিজ রাইফেল-এসএমজি-আড়াই লাখ গুলি, নির্বাচনে নিরাপত্তা শঙ্কা

আবাদুজ্জামান শিমুল, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০০:০৬, অক্টোবর ১৪, ২০২৫
লুট হওয়া চাইনিজ রাইফেল-এসএমজি-আড়াই লাখ গুলি, নির্বাচনে নিরাপত্তা শঙ্কা ফাইল ফটো

জুলাই গণঅভ্যুত্থানে ৫ আগস্ট সরকার পতনের দিন থানা ও পুলিশের অন্যান্য স্থাপনা থেকে লুট হওয়া বিপুল সংখ্যক অস্ত্র ও গুলি এখনও উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। আইনশৃঙ্খলাবাহিনী অভিযান চালিয়ে বেশিরভাগ অস্ত্র উদ্ধার করলেও বাইরে রয়ে গেছে চাইনিজ রাইফেল, চাইনিজ এসএমজিসহ প্রায় দেড় হাজার অস্ত্র ও প্রায় আড়াই লাখ রাউন্ড গুলি।

 

বিশ্লেষকরা উদ্বেগ প্রকাশ করে বলছেন, লুট হওয়া এসব অবৈধ অস্ত্র–গুলিই আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও সাধারণ জনজীবনে নিরাপত্তাহীনতার বড় কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে।

পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া অ্যান্ড পিআর) এ এইচ এম শাহাদাত হোসাইন জানিয়েছেন, ২০২৪ সালের আন্দোলনের সময় দেশে মোট ৪৬০টি পুলিশ স্থাপনা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল—তার মধ্যে ১১৪টি থানা (ভাঙচুর ৫৮, অগ্নিসংযোগ ৫৬) এবং বিভিন্ন ধরনের ১,০২৪টি যানবাহন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ সময় মোট ৫,৭৫৬টি অস্ত্র লুট হয়েছে; এর মধ্যে উদ্ধার করা হয়েছে ৪,৪১৩টি। এখনও বাকি আছে ১,৩৪৩টি অস্ত্র।

মোট লুট হওয়া গুলির সংখ্যা ৬,৫২,০৮২ রাউন্ড, যার মধ্যে ৩,৯৪,৪৩৪ রাউন্ড উদ্ধার করা হয়েছে। প্রাথমিক রিপোর্টে উল্লেখ রয়েছে, চাইনিজ রাইফেল, পিস্তল ও কিছু চাইনিজ এসএমজি উদ্ধার হয়নি; তবে সি ক্যাটাগরির সব এসএমজি উদ্ধার করা হয়েছে।

সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, সম্প্রতি এক মাসের অভিযানে মোট ৬৫টি অবৈধ অস্ত্র ও ২৯৭ রাউন্ড গোলাবারুদ উদ্ধার করা হয়েছে; একই সময় ৯,৭৯৪টি অস্ত্র এবং ২,৮৭,৩৫৯ রাউন্ড গুলিও উদ্ধার হয়েছে।  

কারাগার থেকে বন্দি পলায়ন ও অস্ত্র লুটকারা অধিদপ্তরের সহকারী মহাপরিদর্শক মো. জান্নাত-উল ফরহাদ জানিয়েছেন, গণঅভ্যুত্থানের সময় নরসিংদী, সাতক্ষীরা, কুষ্টিয়া, শেরপুর ও কাশিমপুর হাই সিকিউরিটি কারাগার থেকে মোট ২,২৪৭ বন্দি পালিয়ে যায়; সেই সময়ে ৬৭টি অস্ত্রও লুট হয়—সেগুলোর মধ্যে ২৭টি উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। আনুমানিক দেড় হাজার বন্দিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এদের মধ্যে প্রায় ৭০০ বন্দি স্বেচ্ছায় কারাগারে ফেরত আসে। পালিয়ে যাওয়ার মধ্যে ৯৩ জন বিশেষ প্রকৃতির বন্দি ছিলেন—এদের মধ্যে ৬০ জন গ্রেপ্তার হয়েছেন। বাকিদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।

লুট হাওয়া অস্ত্র ও গুলি বিক্রি অনেকে অভিযোগ করছেন, লুট হওয়া এসব অস্ত্র বাজারে বিক্রি হচ্ছে—চট্টগ্রামে গত মে মাসে গ্রেপ্তার মো. পারভেজ ও রিয়াজুর রহমানের কাছ থেকে লুট হওয়া রিভলবার ও গুলি উদ্ধার হয়; ঢাকায় খিলগাঁও থেকে আটক রাজিব হোসেনের কাছে চাইনিজ রাইফেলের ১২ রাউন্ড গুলি পাওয়া যায়; তিনি স্বীকার করেছেন এসব গুলি বিক্রি করতেন।

সীমান্তে অবৈধ অস্ত্র দেশের বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে অবৈধ অস্ত্র প্রবেশ করার ঘটনা ঘটছে। বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) জানিয়েছে, সীমান্ত এলাকায় নিয়মিত অভিযানে বিভিন্ন অবৈধ সামগ্রী উদ্ধার করা হচ্ছে—সাম্প্রতিক অভিযানে পাওয়া গেছে দেশীয় পিস্তল, ম্যাগাজিন ও গুলি। অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সীমান্ত দিয়ে অবৈধ অস্ত্রের প্রবাহ ও লুট হওয়া অস্ত্র অপরাধীদের কাছে থাকার কারণে তা আগামী নির্বাচনে অস্থিরতার কারণ হতে পারে।

সরকারি পদক্ষেপ ও পুরস্কার ঘোষণা গত বছর আগস্টে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় একটি প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পর্যন্ত বেসামরিকভাবে প্রদত্ত সব আগ্নেয়াস্ত্র লাইসেন্স স্থগিত করে। সেইসঙ্গে ৩ সেপ্টেম্বরের মধ্যে অস্ত্র ও গুলি থানায় জমা দিতে নির্দেশ দেওয়া হয়। এ সময় দেখা যায়, রাজধানীসহ ৬৪ জেলার থানায় মোট ৯,১৯১টি অস্ত্র জমা পড়েছে; কিন্তু ১,৬৫৪টি অস্ত্র জমা পড়েনি— তাই সেগুলো এখন অবৈধ বলে গণ্য হচ্ছে।

আইন-শৃঙ্খলা সংক্রান্ত কোর কমিটি অস্ত্র উদ্ধারে সর্বোচ্চ ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত পুরস্কার ঘোষণা করেছে। শর্টগান/পিস্তল উদ্ধারে ৫০ হাজার টাকা, চায়না রাইফেল/এসএমজি উদ্ধারে ১ লাখ টাকা, এলএমজির ক্ষেত্রে ৫ লাখ টাকা; আর প্রতি রাউন্ড গুলির জন্য ৫০০ টাকা পুরস্কার দেওয়া হবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের শিক্ষক ও অপরাধবিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক বাংলানিউজকে বলেন, লুট হওয়া অস্ত্র অপরাধের সঙ্গে জড়িত—তাই এগুলো যদি অপরাধীদের হাতে থেকেই যায়, তবে নির্বাচনের সময় বা অন্য কোনো সময়ে বড় ধরনের অশান্তি সৃষ্টির আশঙ্কা থেকে যায়। প্রযুক্তি ও গোয়েন্দা-তথ্য কাজে লাগিয়ে লুট হওয়া অস্ত্র দ্রুত উদ্ধার করতে হবে। পাশাপাশি কারাগার থেকে পালিয়ে যাওয়া দাগি আসামিদের গ্রেপ্তার করতে হবে। আর জাতীয় নির্বাচন হবে দেশ জুড়ে, শুধু ঢাকাকে প্রাধান্য দিলে হবে না। সারাদেশ থেকেই অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার করতে হবে।  

সরকার ও বাহিনীর প্রতিশ্রুতি স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী নির্বাচনী নিরাপত্তা নিয়ন্ত্রণে রাখার আশ্বাস দিয়ে বলেছেন, লুট হওয়া অস্ত্রের সবগুলো উদ্ধার করা সম্ভব নাও হতে পারে। তবে নির্বাচনে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি মোকাবিলায় সব ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। প্রয়োজনে বিশেষ প্রস্তুতি নেওয়া হবে।  

পুলিশ বলছে, দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রতিদিন অভিযান চালিয়ে অস্ত্র ও অবৈধ সরঞ্জাম উদ্ধার করা হচ্ছে। নির্বাচনে সুষ্ঠু পরিবেশ বজায় রাখতে বিশেষ প্রশিক্ষণ ও প্রস্তুতি চলমান রয়েছে।

জেএইচ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।