ঢাকা, সোমবার, ২৯ আষাঢ় ১৪৩২, ১৪ জুলাই ২০২৫, ১৮ মহররম ১৪৪৭

বাংলানিউজ স্পেশাল

জলবায়ু তহবিল অপচয়, উন্নয়ন দেখিয়ে বরাদ্দ লুট

পিংকি আক্তার, সিনিয়র রিপোর্টর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫:৪৮, জুলাই ১৩, ২০২৫
জলবায়ু তহবিল অপচয়, উন্নয়ন দেখিয়ে বরাদ্দ লুট কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে তৈরি করা ছবি

জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট তহবিলের অর্থ দিয়ে পার্ক তৈরির বিষয়টি অবিশ্বাস্য মনে হলেও খুলনা অঞ্চলে এমন ঘটনাই ঘটিয়েছে বিগত ফ্যাসিস্ট সরকার। শেখ হাসিনার প্রয়াত ছোট ভাই শেখ রাসেলের নামে এই পার্ক তৈরি করা হয়।

‘শেখ রাসেল ইকো পার্ক’ নামে ওই পার্ক তৈরি করা হয় ২৯ কোটি টাকা ব্যয়ে। এর মধ্যে জলবায়ু তহবিল থেকে বরাদ্দ দেওযা হয় ৮ কোটি ৬৭ লাখ ৫৮ হাজার টাকা। হাসিনা সরকারের পতনের পর ওই পার্কের নাম রাখা হয়েছে ‘খুলনা রিভারভিউ পার্ক’।

যেখানে সুপেয় পানির সংকটে মানুষের হাহাকার আছে, যেখানে লবণ পানি গ্রাস করছে পরিবেশ, কৃষি, মানুষের স্বাস্থ্য; সেখানে জলবায়ু তহবিলের টাকায় পার্কের মতো প্রকল্প অসঙ্গতিপূর্ণ ও অন্যায় অপচয় বলে মনে করছে পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো।

এ প্রকল্পে চার কর্মকর্তা প্রকল্প পরিচালক হিসেবে কাজ করেছেন। তবে কেউই বলতে পারেননি কেন জলবায়ু তহবিলের টাকায় এমন একটি প্রকল্প করা হয়েছে। সবশেষ প্রকল্প পরিচালক ছিলেন সুন্দরবন পশ্চিম বন বিভাগের সাবেক বিভাগীয় বন কর্মকর্তা আবু নাসের মোহসিন হোসেন। শেখ হাসিনা ক্ষমতায় থাকতে গত বছরের জুন মাসে এ প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়।

‘আমরা নোনা জলে দুঃখ করি, আমাদের জমিজমা সব কেড়ে নেয় এই লবণ পানি, শরীরে রোগ বাসা বাঁধছে, খাওয়ার জন্যও পানি নাই, পানির কষ্টে আমরা মরি আর সরকার বানায় পার্ক। এই পার্ক আমাদের কী উপকারে আসবে’, দীর্ঘশ্বাস নিয়ে প্রশ্ন করেন খুলনার দাকোপ এলাকার আবু সায়েম।  

১৯টি জেলায় বাংলাদেশের উপকূলীয় জেলায় প্রায় ৩.৫ থেকে ৪ কোটি মানুষের বাস, যা দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ২১.২৪ শতাংশ, যারা প্রতিবছর ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস ও লবণাক্ততার মতো জলবায়ু বিপদের মুখোমুখি হন।

বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) খুলনা বিভাগীয় সমন্বয়কারী মাহফুজুর বলেন, জলবায়ু ট্রাস্ট ফান্ডের টাকা মূলত খরচ করার কথা জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বিপন্ন মানুষের সহায়তায় বা বিপন্নতার সঙ্গে তাদের খাপ খাইয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা করার জন্য। এই টাকা দিয়ে পার্ক তৈরি হতে পারে না। পার্কের নামে জলবায়ু ফান্ডের টাকা অপচয় করা হয়েছে। যেখানে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সঙ্গে আলোচনা করে প্রকল্প গ্রহণ করতে হয়, পার্ক তৈরির এই প্রকল্পের ক্ষেত্রে এমন কিছুই করা হয়নি। পার্ক করার নামে প্রকল্পের টাকা লুটপাট করা হয়েছে।

পানির টাংকি বিতরণে জলবায়ু তহবিল লুটপাট
পার্কসহ আরও ৭টি প্রকল্পে জলবায়ু তহবিল থেকে মোট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৬০ কোটি ৩২ লাখ ৫৬ হাজার টাকা। তবে জলবায়ু ফান্ডের টাকা সবচেয়ে বেশি লুটপাট হয়েছে পানির টাংকি বিতরণের কাজে।

দাকোপ উপজেলার কৈলাশগঞ্জ ইউনিয়নের ১ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য মো. ফয়সাল আলম গাজী বলেন, আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য ননী গোপাল মণ্ডলের ছেলে দীপ্ত মন্ডল ভুক্তভোগীদের কাছ থেকে প্রতি টাংকি বাবদ ৫ থেকে সাড়ে ৫ হাজার টাকা করে নিয়েছেন। এ বিষয়ে গত বছরের ২৯ নভেম্বর খুলনার দাকোপে সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের আমলি আদালতে মামলা করেন বানীশান্তা ইউনিয়নের ভুক্তভোগী হাফিজুল শেখ। মামলায় খুলনা-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ননী গোপাল মণ্ডল ও তার ছেলে দীপ্ত মণ্ডলসহ চারজনকে আসামি করা হয়। অন্য আসামিরা হলেন- তিলডাঙ্গা ইউনিয়নের গড়খালী গ্রামের জনি সরদার ও একই গ্রামের ছবেদ আলী সরদার। হাফিজুলের অভিযোগ, আসামিরা এলাকার পরিবারগুলো থেকে ১০ লাখ ৮০ হাজার টাকা নিয়েও প্রতিশ্রুতি রাখেননি।
 
জানা গেছে, যারা টাকা বেশি দিয়েছে, তাদের বাড়িতে পানির টাংকি দেওয়া হয়েছে আগে। টাকার বিনিময়ে অনেকের বাড়িতে ২-৩টা করে টাংকিও দেওয়া হয়েছে। তবে হাসিনা সরকারের শেষের দিকে যারা টাংকির জন্য টাকা দিয়েছেন, তাদের টাকা মেরে দিয়ে ৫ আগস্টের পর পালিয়েছেন ননী গোপাল মণ্ডল ও তারা ছেলে দীপ্ত মন্ডল।

অন্যদিকে জলবায়ুর কষাঘাত সহ্য করা দাকোপের গরিব পরিবারগুলো কোনো টাংকি পায়নি।

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে লবণাক্ততা বাড়ায় উপকূলের ১৯টির মধ্যে ১৮ জেলার শতাধিক উপজেলায় খাওয়ার পানির সংকট রয়েছে। সুন্দরবনসংলগ্ন উপকূলীয় এলাকায় সুপেয় পানির তীব্র সংকট ক্রমাগত বাড়ছে। এসব কারণে সরকারিভাবে বিতরণের জন্য পানির টাংকি বরাদ্দ দেওয়া হয়। কিন্তু সেই পানির টাংকি পেতে এখনও পোহাতে হচ্ছে নানা ভোগান্তি, গুনতে হচ্ছে বাড়তি টাকা। বিগত সরকারের লোকজন পালিয়ে গেলেও অনিয়ম আর দুর্নীতির বেড়াজালে আটকে আছে উপকূলের মানুষের খাওয়ার পানির উৎস। রাজনৈতিক নেতা থেকে শুরু করে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী পর্যন্ত অনেকেই জড়িয়ে আছ্নে এই অবৈধ বাণিজ্যে।

খুলনার কয়রা, দাকোপ, পাইকগাছা, ডুমুরিয়া, বটিয়াঘাটা, তেরখাদা ও রূপসা উপজেলায় রেইন ওয়াটার হার্ভেস্টিং সিস্টেম (ঘরের চালের ওপর পড়া বৃষ্টির পানি পাইপ দিয়ে টাংকি বা পাত্রে ধরে রাখার পদ্ধতি) স্থাপনের কাজ চলছে।

প্রকল্পের আওতায় কয়রায় ৮ হাজার ১৯২, দাকোপে ৫ হাজার ৮২৬, পাইকগাছায় ৯ হাজার ৭৯২, ডুমুরিয়ায় ৫ হাজার ৪৯০, বটিয়াঘাটায় ২ হাজার ৫৩৪, তেরখাদায় ৪ হাজার ৯২৬, রূপসায় ৩ হাজার ২৪৫টি রেইন ওয়াটার হার্ভেস্টিং সিস্টেম স্থাপন করা হচ্ছে।  

খুলনা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের ২০২৫ সালের এপ্রিলের তথ্য অনুযায়ী, জেলায় বিভিন্ন ধরনের মোট ৭৬ হাজার ৫৫৯টি পানির উৎস আছে। এর মধ্যে ২৪ হাজার ১১২টি গভীর নলকূপ, ১৩ হাজার ৪২৬টি অগভীর নলকূপ, ১ হাজার ৩৯০টি পিএসএফ, ৩২ হাজার ৬৩৬টি রেইন ওয়াটার হার্ভেস্টিং ইউনিট করা হয়েছে। এর বাইরে অন্যান্য উৎসের মধ্যে রয়েছে রিভার্স অসমোসিস (আরও) ইউনিট, সোলার ডি-স্যালানাইজেশন ইউনিট, এসএসটি, সোলার পিএসএফ, পুকুর খনন, সারফেস ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট ইত্যাদি। এর মধ্যে সরকারি হিসাবে ১২ হাজার ৭৩টি খাওয়ার পানির উৎস অকেজো হয়ে আছে। বর্তমানে জলাধার শুকিয়ে যাওয়ায় বেশিরভাগ পিএসএফ-পন্ড স্যান্ড ফিল্টার ঠিকভাবে কাজ করছে না।

পানির টাংকি বিতরণের অনিয়ম প্রসঙ্গে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. বাহার উদ্দীন মৃধা বলেন, সম্প্রতি আমি খুলনায় যোগদান করেছি। এ বিষয়ে আমার কাছে কোনো তথ্য নেই।
 
ক্লাইমেট চেঞ্জ তহবিলে দুর্নীতির চিত্র
জলবায়ুর পরিবর্তন মোকাবিলায় তিনটি তহবিল গঠন করে সরকার। ২০০৫ সালে গঠন করা হয় ‘ন্যাশনাল অ্যাডাপটেশন প্রোগ্রাম অব অ্যাকশন’ (NAPA)। এরপর ২০০৯ সালে গৃহীত হয় ‘বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ স্ট্র্যাটেজি অ্যান্ড অ্যাকশন প্ল্যান’ (BCCSAP)। এই পরিকল্পনার ভিত্তিতে ২০১০ সালে গঠিত হয় ‘বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ ট্রাস্ট ফান্ড’ (BCCTF)। একই বছর চালু হয় ‘বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ রেজিলিয়েন্স ফান্ড’ (BCCRF) ও পাইলট প্রজেক্ট ফর ক্লাইমেট রেজিলিয়েন্স (PPCR), যেগুলোর তত্ত্বাবধানে রয়েছে বিশ্বব্যাংক।

বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ ট্রাস্ট ফান্ডের মাধ্যমে এখন পর্যন্ত প্রায় ৪৫০ মিলিয়ন ডলার ব্যয় করা হয়েছে। সরকার প্রতিবছর প্রায় ১ বিলিয়ন ডলার জলবায়ু খাতে বরাদ্দ দেয়। বিশ্বব্যাংকসহ অনেক সংস্থা এসব খাতে কাজ করছে।  

২০২০ সালে বাংলাদেশে জলবায়ু প্রকল্পের দুর্নীতি ও অর্থনৈতিক অপচয় নিয়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) এবং SOAS ইউনিভার্সিটি অব লন্ডন যৌথভাবে একটি গবেষণা প্রকাশ করে।  

গবেষণা অনুযায়ী, অভিযোজন প্রকল্পে বরাদ্দ অর্থের প্রায় ৩৫ শতাংশ অর্থ আত্মসাৎ হয়েছে, যার কারণে অনেক বাঁধ, ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্রসহ গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো অসম্পূর্ণ বা নিম্নমানের হয়েছে।
 
উপকূলীয় এলাকা বরগুনা, সাতক্ষীরা ও পটুয়াখালীর চারটি প্রকল্পে ১৪ থেকে ৭৭ শতাংশ পর্যন্ত দুর্নীতি হয়েছে। পাশাপাশি, সাতটি প্রশমন প্রকল্পে প্রায় ৫৪.৪ শতাংশ অর্থ অপচয় বা আত্মসাতের ঘটনা ধরা পড়েছে, যার পরিমাণ প্রায় ৩৭ কোটি টাকা। এছাড়া এনজিওগুলোকে ক্লাইমেট ট্রাস্ট ফান্ড থেকে অর্থ পেতে ২০ শাতংশ পর্যন্ত ঘুষ দিতে হয়েছে বলে গবেষণায় উল্লেখ রয়েছে। উপকূলীয় জেলা সাতক্ষীরায় বাঁধ নির্মাণসহ জলবায়ু অভিযোজন প্রকল্পগুলোতে সবচেয়ে বেশি দুর্নীতির প্রমাণ পেয়েছে টিআইবি। গবেষণা অনুযায়ী, এসব প্রকল্পে ৭৭ শতাংশ পর্যন্ত অর্থ আত্মসাৎ হয়েছে, যা দেশের সর্বোচ্চ।

প্রতিবেদন অনুসারে, প্রকল্পগুলোতে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ, অদক্ষ সাব-কন্ট্রাক্ট প্রদান ও মান নিয়ন্ত্রণের অভাবের কারণে বাঁধ ও অবকাঠামোগুলো টেকসই হয়নি। এর ফলে দুর্যোগ মোকাবিলায় স্থানীয় জনগণ ঝুঁকিতে রয়েছে।

আর সে সময় হাছান মাহমুদ ছিলেন আওয়ামী লীগ সরকারের বন ও পরিবেশ মন্ত্রী (২০০৯-২০১৩)। আর তার অধীনেই এসব প্রকল্পে দুর্নীতির উৎসব চলে।

টিআইবির প্রতিবেদনে দেখা যায়, সাইক্লোন শেল্টার তৈরি প্রকল্পে বরিশাল এলাকায় অনিয়ম দুর্নীতি বেশি হয়েছে। সেই তুলনায় বরগুনা জেলায় কিছুটা কম। তবে সাতক্ষীরা এলাকায় বাঁধ প্রকল্পে দুর্নীতি ছিল সর্বাধিক।  

গবেষণায় বলা হয়েছে, ২০১১ সালে বরিশালে পরিচালিত জল ব্যবস্থাপনা প্রকল্পে মোট ৯৭৫ কোটি টাকার মধ্যে প্রায় ১৪০ কোটি টাকা দুর্নীতি হয়েছে, যা প্রকল্পের মোট বাজেটের ১৪.৩৬ শতাংশ। এরপর ২০১৬ সালে বরগুনা ও পটুয়াখালীর পোল্ডার নির্মাণ প্রকল্পে ৭২ কোটি টাকার মধ্যে ১৬.৮ কোটি টাকা অর্থ আত্মসাতের ঘটনা ধরা পড়েছে, যা ২৩.৩৭ শতাংশ।

আরও উদ্বেগজনক হলো, ২০১৯ সালের মনু নদীর পাম্প হাউজ প্রকল্পে প্রায় ৬৩ শতাংশ অর্থ দুর্নীতির কবলে পড়ে। এই প্রকল্পের বাজেট ছিল ৫৪.৮৩ কোটি টাকা, যেখানে ৩৪.৪ কোটি টাকা দুর্নীতি হয়েছে।

২০২০ সালে কয়রা বাঁধ সংস্কার প্রকল্পে প্রায় ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা ব্যয় ধরা হয়। এই প্রকল্পে মোট বাজেটের ৭৬.৯২ শতাংশ  অর্থের অপচয় ও দুর্নীতি ধরা পড়ে।

এই প্রকল্পগুলোতে দুর্নীতির মূল কারণ হিসেবে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ, দুর্বল তদারকি, নিম্নমানের উপকরণ ব্যবহার এবং ঠিকাদারদের সঙ্গে যোগসাজশকে চিহ্নিত করা হয়েছে। এসব দুর্নীতির ফলে প্রকল্পগুলো সময়মতো সম্পন্ন হয়নি বা নিম্নমানের হয়ে পড়েছে, যার প্রভাব পরবর্তী সময়ে স্থানীয় জনগণের ওপর পড়েছে।

এ বিষয়ে চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভের প্রধান নির্বাহী এম জাকির হোসেন খান বলেন, নিজেদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য পূরণ করতে অনেক সময় উন্নয়নমূলক কার্যক্রমের জন্য জলবায়ু তহবিল থেকে অন্যায়ভাবে প্রকল্প নেওয়া হয়েছে, উপকূলে যেখানে নিরাপদ পানির সংকট সেখানে পার্ক তৈরির প্রকল্প কীভাবে সরকার অনুমোদন করতে পারে! বিশেষ করে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ভোট বাড়াতে এসব ভুল-ভাল প্রকল্প অনুমোদন করা হয়।  

রাজনৈতিক হস্তক্ষেপে প্রকল্প অনুমোদন
২০২৯ সাল থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে মোট ২৮১টি জলবায়ু প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়েছে, যার মধ্যে উপকূলীয় অঞ্চলে (যেমন বরিশাল, চট্টগ্রাম, খুলনা) প্রকল্পের সংখ্যা ১৩৮টি। অপরদিকে, ঝুঁকিপূর্ণ বরেন্দ্র অঞ্চল (রাজশাহী ও রংপুর) ও অভ্যন্তরীণ জেলাগুলোতে প্রকল্প সংখ্যা মাত্র ১৪৩টি। এর মধ্যে বরেন্দ্র অঞ্চলে প্রকল্প সংখ্যা কমে সাম্প্রতিক বছরে মাত্র ৬৩টিতে নেমে এসেছে, যা দেশজুড়ে ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর প্রকৃত চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল বলছে সেন্টার ফর পার্টিসিপেটরি রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট- সিপিআরডির গবেষণা।  
 
গবেষণায় বলা হয়, ক্লাইমেট চেঞ্জ ট্রাস্ট ফান্ড (BCCTF) এবং পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন ইউনিট (ECCU)-এর মাধ্যমে বাস্তবায়িত বহু প্রকল্পে স্থানীয় সংসদ সদস্য ও রাজনৈতিক নেতাদের প্রত্যক্ষ প্রভাব রয়েছে। যখন যে ক্ষমতায় ছিল, বিশেষ করে পরিবেশ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে, তখন সংশ্লিষ্ট পদে আসীন ব্যক্তির এলাকাকে প্রাধান্য দিয়েই প্রকল্প বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে দেখা গেছে, তুলনামূলকভাবে কম ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা বরাদ্দ পেয়েছে, অথচ প্রকৃত ঝুঁকিতে থাকা অঞ্চল বঞ্চিত হয়েছে। প্রকল্পের ৪৫ শতাংশ ক্ষেত্রেই প্রকৃত ঝুঁকিতে থাকা জনগণ বাদ পড়েছে, কারণ প্রকল্প বরাদ্দ ছিল রাজনৈতিকভাবে প্রভাবিত। ৩৫ শতাংশ প্রকল্পে স্থানীয় প্রশাসনের পক্ষপাতদুষ্ট সিদ্ধান্ত দেখা গেছে।

সবচেয়ে বেশি দুর্নীতি অনিয়ম ঘটে বাঁধ নির্মাণ প্রকল্পে। কেননা এসব প্রকল্পে টাকা আত্মসাতের সুযোগ থাকে। তাই যে এলাকায় বাঁধ দরকার নেই, সেখানেও বাঁধ প্রকল্প নেওয়া হয়, বলেন সিপিআরডির প্রধান নির্বাহী মো. শামসুদ্দোহা।

বেশিরভাগ প্রকল্প রাজনৈতিক স্বার্থ সিদ্ধিতে দেওয়া হচ্ছে কিংবা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে। এমনকি জলবায়ু তহবিল থেকে বেশিরভাগই ননক্লাইমেট প্রজেক্টে অর্থ দেওয়া হচ্ছে, যা জলবায়ু ভুক্তভোগীদের ভাগ্য পরিবর্তন করাচ্ছে না। এতে করে দেশে দিনকে দিন জলবায়ু ভালনারেবেলিটি (দুর্বলতা) আরও বাড়ছে, যুক্ত করেন তিনি।

তবে প্রকল্প সঠিকভাবে ভুক্তভোগীদের সহায়তায় বণ্টনের জন্য বিসিসিটিএফ বোর্ডে মন্ত্রী, সচিব, রাজনৈতিক ব্যক্তি ছাড়াও পরিবেশ বিশেষজ্ঞদের রাখার পরামর্শ দেন শামসুদ্দোহা। তিনি মনে করেন, এই বোর্ডে যতদিন রাজনৈতিক সদস্য সংখ্যা বেশি থাকবে, ততদিন প্রকল্প সুষ্ঠুভাবে বণ্টন সম্ভব হবে না।

আর তাই ইন্ডপেনডেন্ট (স্বাধীন) কমিশন গঠন করে ফান্ড ডিসবার্স (তহবিল বিতরণ) করা ও সঠিক পর্যবেক্ষণ করার পরামর্শও দেন তিনি।  

প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হলেও কাজ শেষ হয় না
২০২০ সালে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের পুনর্বাসন প্রকল্পের আওতায় কয়রা বাঁধ প্রকল্পটি হাতে নেয় হাসিনা সরকার। প্রকল্পের কাজ শুরু হয় ২০২২ সালের ডিসেম্বরে। দুই বছর মেয়াদি এ প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০২৪ সালের ৩০ ডিসেম্বর। এরপর এক বছর প্রকল্প মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। এ পর্যন্ত কাজের অগ্রগতি হয়েছে মাত্র ৩০ শতাংশ। আর এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন ভুক্তভোগী স্থানীয় বাসিন্দারা।

মদিনাবাদ গ্রামের ইমদাদুল হক বলেন, এক হাজার ২০০ কোটি টাকায় কয়রায় উপকূলীয় বেড়ি বাঁধ সংস্কার কাজের কথা থাকলেও ঠিক মতো দৃশ্যমান নয়। প্রকল্পের কাজ ঠিকঠাক বাস্তবায়ন হচ্ছে না। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলেও যেমন কাজ হচ্ছিলো, ৫ আগস্টের পরেও তাতে গতি আসেনি। বৃষ্টির সময় নদীতে অতিরিক্ত জোয়ারের পানি বাড়ে। এতে বেড়ি বাঁধ ভেঙে যাওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে। এখনো কয়রার বহু বেড়িবাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ। সরকার টাকা দেবে আর সবাই লুটপাট করে খাবে। এমনটি হতে দেওয়া যাবে না। আমরা দ্রুত প্রকল্পের বাস্তবায়ন চাই।

সাতহালিয়া গ্রামের বাসিন্দা মকবুল আহমেদ বলেন, ঝড় কিংবা জলোচ্ছ্বাস হলেই চোখের সামনে ভেসে গেছে বাঁধ, ভেঙেছে রাস্তা-ঘাট, ঘর-বাড়ি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, ক্ষেতের ফসল, মাছের ঘের সবকিছুই তছনছ হয়ে গেছে। আমরা চাই দ্রুত টেকসই বেঁড়িবাধ। আমরা আর পানিতে ভাসতে চাই না। টেকসই বেড়িবাঁধ হলে আমাদের আর লবণ পানিতে ভাসতে হবে না। খেতের ফসল, সবজি আর ঘেরের মাছ দিয়েই আমাদের সংসার ভালোভাবে চলে যাবে।

কয়রা উন্নয়ন সংগ্রাম সমন্বয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক ইমতিয়াজ উদ্দিন বলেন, ২০২১ সালের ২৩ নভেম্বর কয়রার দুটি ইউনিয়নে জন্য ১ হাজার ১৭২ কোটি ৩১ লাখ টাকার টেকসই বেড়িবাঁধ প্রকল্প অনুমোদনের পর আশার আলো দেখেছিল কয়রার মানুষ। কিন্তু সেই প্রকল্পের কাজ কচ্ছপ গতিতে চলছে।
 
পাউবো সূত্রে জানা যায়, ১ হাজার ১৭২ কোটি ৩১ লাখ ২৫ হাজার টাকা ব্যয়ে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য যৌথভাবে দায়িত্বে আছে খুলনার পাউবো ও সাতক্ষীরা-২ বিভাগ। এ দুই বিভাগ থেকে দরপত্রের মাধ্যমে ২৫টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কাজ করার অনুমতি পায়। তারা কয়রার কপোতাক্ষ ও শাকবাড়িয়া নদীতীরবর্তী প্রায় ৩২ কিলোমিটার স্থায়ী বাঁধ নির্মাণকাজ করছে। তবে জমি অধিগ্রহণে ধীরগতি ও জটিলতা তৈরি হওয়ায় ঠিকাদার ও এলাকাবাসীর মধ্যে দ্বন্দ্ব দেখা দেয়।

অভিযোগ রয়েছে, কচ্ছপ গতিতে প্রকল্পের কাজ চলছে। বেঁড়িবাঁধ নির্মাণ ও পুনর্বাসন প্রকল্পের জন্য অধিগ্রহণ না করে ব্যক্তিমালিকানাধীন জমির ওপর বাঁধের কাজ করা হচ্ছে।  

কয়রার বাঁধ সংস্কার ও টেকসইকরণ প্রকল্প অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে চাইলে পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আশরাফুল আলম বলেন, ১১৭২ কোটি টাকার প্রকল্প। অর্থ পাওয়া গেছে ২০ থেকে ২২ শতাংশ। কাজের ভৌত অগ্রগতি হয়েছে ৩০ শতাংশ। এ প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য আরো সময় বাড়ানো হবে। প্রকল্পের মেয়াদ আছে এই বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত। কোনো নতুন ঠিকাদার নিয়োগ করা হয়নি। যারা ছিল তারাই আছে।

পিএ/এজে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।