খুলনা: খুলনার দৌলতপুর থানা যুবদলের বহিষ্কৃত সহ-সভাপতি মাহবুবুর রহমান মোল্লা হত্যাকাণ্ড নিয়ে নানা আলোচনা তৈরি হয়েছে। কী কারণে তিনি খুন হয়েছেন, তাকে হত্যার পেছনে কারা, এর উত্তর খুঁজছেন মাহবুবের স্বজন ও দলীয় সহকর্মীরা।
পুলিশ বলছে, তারা হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদঘাটনে ব্যাপক তৎপর। এরই মধ্যে মাহবুব মোল্লার অবস্থান ঘাতকদের জানিয়ে দেওয়া প্রতিবেশী সজলকে (২৭) গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তার কাছ থেকে আরও তথ্য পেতে নেওয়া হয়েছে রিমান্ডেও।
গত শুক্রবার (১১ জুলাই) দুপুর দেড়টার দিকে মহানগরীর দৌলতপুর থানাধীন মহেশ্বরপাশা পশ্চিম পাড়া এলাকায় নিজ বাসার সামনে হত্যাকাণ্ডের শিকার হন মাহবুব। ঘটনার পরদিন শনিবার (১২ জুলাই) তার বাবা করিম মোল্লা বাদী হয়ে একটি মামলা করেন।
মাহবুব হত্যার পেছনে যেসব ‘সন্দেহ’
পুলিশ জানিয়েছে, বিশেষ তিনটি টিম হত্যার নেপথ্যে বেশ কিছু কারণ সামনে রেখে তদন্ত শুরু করেছে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (কুয়েট) ছাত্রদের সঙ্গে মারামারির ঘটনা, চরমপন্থীদের সঙ্গে কানেকশন, মাদক ব্যবসা, দলীয় কোন্দল, এলাকায় আধিপত্য বিস্তার, প্রতিপক্ষের মামলা ও চাঁদাবাজির অভিযোগ। এরই মধ্যে ঘটনাস্থলের আশপাশের সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ ও খুনিদের চিহ্নিত করে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।
জানা যায়, গত ১৮ ফেব্রুয়ারি খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (কুয়েট) সংঘর্ষের সময় রামদা হাতে দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় যুবদল নেতা মাহবুবুর রহমানের একটি ছবি ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে। পরের দিন তাকে বহিষ্কার করে যুবদলের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটি। বহিষ্কারের পরও দলীয় সব কর্মকাণ্ডে মাহবুরের সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল।
তার আগে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর এলাকায় বেপরোয়া আচরণ, দখল, জমি বিক্রির সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণসহ নানা বিষয়ে মাহবুবের বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলে প্রতিপক্ষ। বিএনপির এক প্রভাবশালী নেতার ঘনিষ্ঠ ছিলেন তিনি। পাশাপাশি এক চরমপন্থী নেতা মাহবুবের আত্মীয়। মাহবুব যে প্রাইভেটকার পরিষ্কার করার সময় খুন হন, কিছুদিন আগে সেটি এক যুবলীগ নেতার কাছ থেকে অল্প দামে কিনেছিলেন। তবে তিনি দলের জন্য নিবেদিতপ্রাণ ছিলেন বলে জানা যায়।
মাহবুবের স্বজনরা যা বলছেন
মাহবুবের স্বজনদের মতে, পুরোনো কিছু বিরোধ তার হত্যাকাণ্ডের কারণ হয়ে থাকতে পারে। তবে যারা খুন করেছে, তাদের সর্বোচ্চ শাস্তি চান মা-বাবা।
মাহবুবের মা রাবেয়া বেগম বিলাপ করতে করতে বলেন, ‘আমার বাবাকে যারা খুন করেছে সেসব খুনিদের বিচার চাই, তাদের সর্বোচ্চ শাস্তি ফাঁসি চাই। ’
তার বাবা করিম মোল্লা বলেন, ‘মাহবুবকে মাঝেমধ্যে অজ্ঞাতনামা মোবাইল থেকে হুমকি দিতো। আমি চাই আমার ছেলের হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু বিচার হোক। প্রকৃত যে দোষী তাকে শাস্তি দেওয়া হোক। ’
মাহবুবের চাচা আব্দুল শহীদ মোল্লা বলেন, মাহবুব এই এলাকার চাঁদাবাজদের বিরুদ্ধে, নানা অপরাধের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াত। ওই কারণেই তাকে খুন করেছে দুর্বৃত্তরা। আমি আমার ভাতিজা হত্যার বিচার চাই। ’
মাহবুব সংগঠনকে অনেক ভালোবাসতেন উল্লেখ করে তার স্ত্রী এরিনা সুলতানা বলেন, আমার স্বামী দলের নির্দেশে কুয়েটে গেছিল। সে ছিল প্রতিবাদী। দলের বিপদে মাহবুব সবার আগে থাকতো। দৌলতপুর থানা বিএনপির সুধী সমাবেশকে কেন্দ্র করে আমার স্বামীকে হুমকি-ধমকি দেওয়া হয়েছে অনেকবার।
মাহবুবের শ্বশুর মহানগর শ্রমিক দলের সাবেক নেতা আজাদ বেগ বলেন, কুয়েট ক্যাম্পাসে ছাত্রশিবিরের সঙ্গে ছাত্রদলের সংঘাতে যুবদলের নেতা হিসেবে মাহবুব পাশে দাঁড়িয়েছিল। এ ঘটনা তার হত্যাকাণ্ডের একটি কারণ হতে পারে। এছাড়া ৫ আগস্টের পর দলীয় অফিস ভাঙচুরের ঘটনায় আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে বাদী হয়ে মামলা করেন মাহবুব। মানিকতলার যুবদলের একটি সুধী সমাবেশে মারামারির ঘটনায় তার বন্ধু জাকির মামলা করলে আসামিরা মাহবুবের ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে।
হত্যাকাণ্ডের জট খুলবে?
জানা গেছে, হত্যাকাণ্ডের আগে ঘাতকদের মাহবুব মোল্লার অবস্থান জানিয়ে দিয়েছিলেন তার প্রতিবেশী সজল (২৭)। শনিবার (১২ জুলাই) রাত সোয়া ২টার দিকে দৌলতপুর থানাধীন মহেশ্বরপাশা এলাকা থেকে তাকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। নেওয়া হয়েছে দুদিনের রিমান্ডে।
তদন্ত সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, সজলকে রিমান্ডে নিলে মাহবুব হত্যার চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে আসবে।
দৌলতপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মীর আতাহার আলী বাংলানিউজকে বলেন, মাহবুবুর মোল্লাকে হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকায় প্রতিবেশী সজলকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তিনি সরাসরি হত্যাকাণ্ডে অংশ নেননি। তবে মাহবুবের অবস্থান সম্পর্কে হত্যাকারীদের যাবতীয় তথ্য দিয়েছেন। তার তথ্যের ওপর নির্ভর করে দুর্বৃত্তরা মাহবুবকে নির্মমভাবে গুলি এবং পায়ের রগ কেটে হত্যা করে। এ হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে সজল অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছেন।
খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশে উপ-পুলিশ কমিশনার (উত্তর) তাজুল ইসলাম বলেন, হত্যাকাণ্ডের সময়ে সজল খুব কাছাকাছি থেকে দুর্বৃত্তদের খবর আদান-প্রদান করেছেন, এটা নিশ্চিত হয়েই তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার আবু সালেহ মো. রায়হান বাংলানিউজকে বলেন, খুনের রহস্য উদঘাটনে আমরা কাজ শুরু করেছি। একটি ভিডিও ফুটেজ পেয়েছি, ওই ফুটেজের সূত্রে ধরে তদন্ত চলছে। কিলিং মিশনে তিনজন ছিলেন, তাদের কাছে একাধিক অস্ত্র ছিল।
যেভাবে হত্যা করা হয় মাহবুবকে
গত শুক্রবার (১১ জুলাই) দুপুর দেড়টার দিকে মহানগরীর দৌলতপুর থানাধীন মহেশ্বরপাশা পশ্চিম পাড়া এলাকায় নিজ বাসার গেটে প্রাইভেটকার ধোয়ামোছার কাজ করছিলেন মাহবুব। ওই কাজে তাকে সাহায্য করছিলেন একই এলাকার ভ্যানচালক গাজী সোলায়মান নামের এক যুবক। তখন মোটরসাইকেলে করে আসা তিন ব্যক্তি গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মাহবুবকে লক্ষ্য করে গুলি ছুড়তে থাকে। এতে তিনি গুলিবিদ্ধ হয়ে মাটিতে পড়ে যান। এ সময় মৃত্যু নিশ্চিত করতে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে তার পায়ের রগ কেটে দেয় ঘাতকরা।
গুলির শব্দ শুনে মাহবুবের সঙ্গে থাকা ভ্যানচালক পালিয়ে গেটের ভেতর গেলে তাকেও লক্ষ্য করে গুলি ছোঁড়ে দুর্বৃত্তরা। সন্ত্রাসীদের গুলি মাহবুবের বাড়ির প্রাচীর, মূল প্রবেশদ্বারসহ আশপাশের ভবনে গিয়ে লাগে।
অবশ্য মাহবুব মোল্লার বিরুদ্ধে দৌলতপুরসহ বিভিন্ন থানায় মাদক, মারামারিসহ বিভিন্ন অপরাধে আটটি মামলা রয়েছে।
এমআরএম/এইচএ/