ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৫ আষাঢ় ১৪৩২, ১০ জুলাই ২০২৫, ১৪ মহররম ১৪৪৭

বাংলানিউজ স্পেশাল

যুক্তরাষ্ট্রের ৩৫ শতাংশ শুল্কে যে সংকটে পড়বে পোশাকশিল্প

জাফর আহমদ, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১:২৮, জুলাই ৮, ২০২৫
যুক্তরাষ্ট্রের ৩৫ শতাংশ শুল্কে যে সংকটে পড়বে পোশাকশিল্প সংগৃহীত ছবি

বাংলাদেশ থেকে তৈরি পোশাক আমদানিতে ৩৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। এতে দেশের পোশাকশিল্পে নতুন করে আতঙ্ক তৈরি হয়েছে।

আগের ১৫ শতাংশ শুল্কের সঙ্গে নতুন আরোপিত শুল্কসহ মোট শুল্কের পরিমাণ দাঁড়াবে ৫০ শতাংশ। এই শুল্ক বাংলাদেশের তৈরি পোশাকশিল্পকে বড় ধরনের সংকটের মুখে ফেলে দেবে বলে আশঙ্কা করছেন উদ্যোক্তারা।

চলতি বছরের এপ্রিল মাসে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের ওপর ৩৭ শতাংশ শুল্ক আরোপের পর বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশের আবেদনের ফলে ৯০ দিনের তা জন্য স্থগিত করে যুক্তরাষ্ট্র। সোমবার (৭ জুলাই) মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বাংলাদেশের পণ্য আমদানিতে ২ শতাংশ কমিয়ে ৩৫ শতাংশ শুল্ক নির্ধারণ করেন। আরোপিত নতুন শুল্ক আগস্ট মাস থেকে কার্যকরের ঘোষণা দিয়েছেন তিনি।

বাংলাদেশের পোশাক আমদানিতে ৩৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করলেও প্রতিযোগী দেশ ভিয়েতনামের পোশাকে মার্কিন শুল্ক বসেছে ২০ শতাংশ। অর্থাৎ বাংলাদেশের চেয়ে ১৫ শতাংশ কম দামে ভিয়েতনামের পোশাক কিনতে পারবেন যুক্তরাষ্ট্রের ক্রেতারা। এর ফলে যুক্তরাষ্ট্রের ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলো সংগত কারণেই ভিয়েতনামের দিকে ঝুঁকবে। আর এতে কমবে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রে পোশাক রপ্তানি।

যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশ তৃতীয় পোশাক রপ্তানিকারক দেশ। প্রতি বছর দেশটি গড়ে প্রায় ৭০ বিলিয়ন ডলারের তৈরি পোশাক আমদানি করে সারা বিশ্ব থেকে। দেশটিতে ২০২৪ সালে ৭.৩ বিলিয়ন ডলারের পোশাক রপ্তানি করেছে বাংলাদেশ। ২০২০ সালে যুক্তরাষ্ট্রে ৫.২ বিলিয়ন ডলার; ২০২১ সালে ৭.১ বিলিয়ন ডলার; ২০২২ সালে ৯.৭ বিলিয়ন ডলার এবং ২০২৩ সালে ৭.৩ বিলিয়ন ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি করেছিল বাংলাদেশ।

একক দেশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বাজার। দেশের মোট তৈরি পোশাক রপ্তানির প্রায় ২০ শতাংশ রপ্তানি হয় দেশটিতে। বিদায়ী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জুলাই-মে ১১ মাসে দেশের মোট ৩৬.৫৫ বিলিয়ন ডলার তৈরি পোশাক রপ্তানি আয়ের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি হয়েছে ৭.৩১ বিলিয়ন ডলার। দেশটি তৈরি পোশাক রপ্তানির ক্রমবর্ধমান বাজার। গত কয়েক দশকে প্রতি বছর দেশটিতে ক্রমান্বয়ে তৈরি পোশাক রপ্তানি বেড়েছে। বাড়তি শুল্ক বসানোর ফলে দেশটিতে তৈরি পোশাক রপ্তানিতে সংকট তৈরি হবে।

তথ্য বলছে, যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশের মোট রপ্তানি আয়ের ৯০ ভাগ আসে তৈরি পোশাক রপ্তানি থেকে। দেশটি থেকে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে মোট ৭.৫৯ বিলিয়ন ডলারের রপ্তানি আয়ের মধ্যে ৭.৪৩ বিলিয়ন ডলার এসেছে তৈরি পোশাক থেকে। যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাকি ১০ ভাগ রপ্তানি আয় এসেছে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, ফার্মাসিউটিক্যালস, প্লাস্টিক পণ্য ও বিভিন্ন কৃষিপণ্য থেকে। ফলে তৈরি পোশাক রপ্তানি সংকটে পড়া মানে দেশের মোট রপ্তানিতে ব্যাঘাত ঘটা।

পোশাক খাতের উদ্যোক্তারা বলছেন, বাংলাদেশ থেকে তৈরি পোশাক আমদানিতে যুক্তরাষ্ট্র ৩৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করলেও প্রতিযোগী দেশ ভিয়েতনামে শুল্ক বসিয়েছে ২০ শতাংশ। বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের চেয়ে ১৫ শতাংশ কম দামে ভিয়েতনামের তৈরি পোশাক কিনতে পারবেন যুক্তরাষ্ট্রের ক্রেতারা। এর ফলে যুক্তরাষ্ট্রের ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলো সংগত কারণেই বাংলাদেশ থেকে ভিয়েতনামের দিকে ঝুঁকবে, কমবে বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি।

চলতি বছরের এপ্রিল মাসে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের ওপর ৩৭ শতাংশ শুল্ক আরোপের পর বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশের আবেদনের ফলে ৯০ দিনের তা জন্য স্থগিত করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ৭ জুলাই যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বাংলাদেশের পণ্য আমদানিতে ২ শতাংশ কমিয়ে ৩৫ শতাংশ শুল্ক নির্ধারণ করেন। এ শুল্ক আগস্ট মাস থেকে কার্যকরের ঘোষণা দেন তিনি। পাশাপাশি আলোচনার দ্বার খোলা রাখার কথা বলেন। আর ভিয়েতনাম সফল আলোচনার মাধ্যমে ১৭ শতাংশ কমিয়ে ২০ শতাংশে নামিয়ে আনতে সমর্থ হয়।

এ বিষয়ে তৈরি পোশাক রপ্তানিকারকরা ক্ষুব্ধ। তারা বলছেন, বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানিতে শুল্ক বাড়ানোতে যতটা সংকট তৈরি হয়েছে, তার চেয়ে বেশি সমস্যা হয়েছে প্রতিযোগী দেশ ভিয়েতনামের ওপর কম শুল্ক বসানোয়। একই পণ্য ভিয়েতনাম ১৫ শতাংশ কম দামে রপ্তানি করতে পারবে, আমরা পারব না। ভিয়েতনামের সমান দামে পণ্য রপ্তানি করতে আমাদের ১৫ শতাংশ লোকসান গুনতে হবে। এর ফলে বাংলাদেশে তৈরি পোশাক রপ্তানি প্রথম দিন থেকে কমাতে হবে।

তৈরি পোশাক শিল্পের উদ্যোক্তারা বলছেন, এপ্রিলে শুল্ক আরোপের পর ৯০ দিন সময় পাওয়া গিয়েছিল। এ সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের নেগোসিয়েশন চলাকালে তৈরি পোশাক শিল্পের উদ্যোক্তাদের অন্ধকারে রাখা হয়েছিল। একাধিক উদ্যোক্তা এমন অভিযোগ মন্তব্য করেছেন।

যুক্তরাষ্ট্রের এমন পদক্ষেপের ফলে তৈরি পোশাকশিল্পের ওপর আবারও ধাক্কা লাগবে। এর ফলে ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্বলতার সুযোগ নেবে। এপ্রিলে ৩৭ শতাংশ বৃদ্ধি ও পরে ১০ শতাংশ রেখে বাকিটা ৯০ দিনের জন্য স্থগিত করা হলে সে সময়ও ক্রেতারা সুযোগ নিয়েছিল। আগের ১৫ শতাংশ ও নতুন আরোপ করা ৩৫ শতাংশসহ এখন মোট ৫০ শতাংশ শুল্ক গুনতে হবে। এতে তৈরি পোশাক শিল্পে নতুন আরেক প্রতিবন্ধকতা তৈরি হবে বলে মনে করেন বাংলাদেশ তৈরি পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজেএমইএ) সাবেক পরিচালক শোভন ইসলাম।

বাংলানিউজকে তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের নতুন এই পদক্ষেপের ফলে ভিয়েতনাম সুবিধা পেলো। নেগোশিয়েশনের মাধ্যমে বাংলাদেশেরও সেটা প্রয়োজন ছিল। ভিয়েতনাম এগিয়ে গেলো। ভারতের ওপর ২৬ শতাংশ শুল্ক রয়েছে। ব্রিকসভুক্ত দেশগুলোতে ১০ শতাংশ শুল্ক আরোপের হুমকি দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে ভারতের পণ্যের ওপর ৩৫ শতাংশ শুল্ক বসতে পারে। কিন্তু পাকিস্তান ও ভিয়েতনাম যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে সুবিধা পাবে। অন্যদিকে বাংলাদেশ এক অসম প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হবে। তবে নোগেশিয়েশনের এখনো সময় আছে, দেখা যাক কী হয়!

বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশে রূপান্তরের প্রক্রিয়া চলছে। তারই অংশ হিসেবে বেশ কিছু প্রণোদনা প্রত্যাহার করা হয়েছে। অন্যান্য প্রণোদনা ধাপে ধাপে তুলে নেওয়া হবে। এ সময় শ্রমিকের মজুরি বৃদ্ধিসহ কর্মপরিবেশের  উন্নয়নে পোশাক শিল্পে বাড়তি খরচ হচ্ছে। উদ্যোক্তারা বলছেন, যুক্তরাষ্টের মতো একক বাজারে এত বেশি শুল্ক আরোপ এই উত্তরণের পথে হোঁচট লাগতে পারে।

যুক্তরাষ্ট্র কোনো ব্যবস্থাই মানছে না। তারা বিশ্ব বাণ্যিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) ব্যবস্থা ভেঙে দিল। কোনো নীতি নৈতিকতার ধার ধারছে না। যাকে ইচ্ছা বন্ধু ভাবছে, তার ওপর শুল্ক কমাচ্ছে; যাকে মিত্র মনে করছে না তার ওপর শুল্ক আরোপ করছে। এ অবস্থায় এখনো নেগোশিয়েশনের যতটা সুযোগ আছে, তা কাজে লাগানোর তাগিদ দেন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) সাবেক মহাপরিচালক তৌফিক আহমেদ চৌধুরী।

বাংলানিউজকে তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দরকষাকষি চলছে; যতদূর পারা যায় সর্বোচ্চ সক্ষমতা দিয়ে শুল্ক কমিয়ে নিতে হবে। তারপরও যদি শুল্ক না কমানো যায়, যুক্তরাষ্ট্রর বাজারে প্রতিযোগিতার সক্ষমতা ধরে রাখতে স্থানীয় বা বাজার সুবিধার আওতায় তৈরি পোশাকের বাজারে টিকে থাকতে হবে। আর অতীতে এ ধরনের প্রতিকূলতা মোকাবিলা করার অভিজ্ঞতা আমাদের আছে। নিশ্চই এবারও মোকাবিলা করা হবে।

জেডএ/এমজেএফ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।