ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে স্বৈরাচারী আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দলবদ্ধভাবে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার ঘটনা বেড়ে যায়। এসব ঘটনা ঘিরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ গণমাধ্যমে ‘মব জাস্টিস’ শব্দবন্ধটি আলোচনায় আসে।
ইংরেজি শব্দ ‘মব’-এর অর্থ ‘উচ্ছৃঙ্খল জনতা’। এই উচ্ছৃঙ্খল জনতা আইন নিজের হাতে তুলে নিয়ে সহিংসতা করলে তাকে বলা হয় ‘মব জাস্টিস’ বা ‘উচ্ছৃঙ্খল জনতার বিচার’।
একটি মানবাধিকার সংগঠনের হিসাব মতে, গত ৯ মাসে মব বা উচ্ছৃঙ্খল জনতার হাতে নিহত হয়েছেন ১৪৩ জন।
এদিকে অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্বের ৯ মাস পূর্ণ হওয়ার পরও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে মব সৃষ্টিকারীদের শুধু প্রতিরোধের ঘোষণা ছাড়া উল্লেখযোগ্য আইনগত কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি। এরই মধ্যে কয়েকদিন আগে ধানমন্ডিতে মব প্রতিরোধে ভূমিকা পালন করায় ধানমন্ডি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে (ওসি) পুরস্কারে ভূষিত করেন ডিএমপি কমিশনার।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে বরাবরই বলা হচ্ছে, মব সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে কঠোরভাবে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
মব জাস্টিসের শিকার
রাজধানীর ভাটারা এলাকায় গত ৪ মার্চ ছিনতাইকারী তকমা দিয়ে ইরানের দুই নাগরিককে মারধর করে উচ্ছৃঙ্খল জনতা। এতে ওই দুজন আহত হন। তাদের উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করে পুলিশ। পুলিশের ভাষ্য, ইরানের এই দুই নাগরিক ছিনতাইকারী ছিলেন না। বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার নিয়ে তর্কে জড়িয়ে পড়েছিলেন তারা। একপর্যায়ে ছিনতাইকারী তকমা দিয়ে তাদের মারধর করা হয়।
গত ১ মার্চ রাজধানীর লালমাটিয়ায় চায়ের দোকানে ধূমপান করাকে কেন্দ্র করে দুই তরুণীকে লাঞ্ছিত করা হয়। এ ঘটনায় রিংকু নামের এক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হয়। পুলিশ বলছে, এক তরুণীর ধূমপান নিয়ে আপত্তি তুললে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। পরে আশপাশের লোকজন ঘটনাস্থলে জড়ো হন। একপর্যায়ে রিংকু নামের ব্যক্তি তরুণীদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার ও তাদের শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করার চেষ্টা করেন।
গত ৯ মাসে দেশে ‘মব’-এর অনেক ঘটনার মধ্যে গত সোমবার (১৯ মে) ধানমন্ডির ৪ নম্বর রোডে দিবাগত রাতে একজন প্রকাশককে ফ্যাসিবাদের দোসর আখ্যা দিয়ে তার বাসায় কিছু লোক ঢোকার চেষ্টা করে। সংবাদ পেয়ে পুলিশ সেখানে গেলে উপস্থিত থাকা মব সৃষ্টিকারীদের সাথে তর্কাতর্কির একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে।
ওই ভিডিওতে দেখা যায়, ধানমন্ডি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার (ওসি) উদ্দেশে এক যুবক বলেন—‘আপনি কেন এইখানে কথা বলতেছেন এইভাবে? আপনি ওসি, আপনি গ্রেপ্তার করলেন না কেন? আমি বলছি, আপনি গ্রেপ্তার করেন। ’ তখন ওসি বলেন, ‘ওনার নামে মামলা নেই’। যুবক বলেন, ‘মামলা আমি করব, আপনি গ্রেপ্তার করেন’। ওসি জবাবে বলেন, ‘আমার সিনিয়র কর্মকর্তারা বলেছেন, মামলা না থাকলে গ্রেপ্তার করা যাবে না’।
ওসি তখন যুবকদের অপ্রীতিকর পরিস্থিতি তৈরি না করার অনুরোধ জানান। তারপরও মব চেষ্টাকারী যুবকরা ওই প্রকাশককে গ্রেপ্তার করার জন্য চাপ দিচ্ছিলেন। তারা ওসিকে বারবার বলছিলেন, ওসি টাকা খেয়েছেন।
পুলিশ জানিয়েছে, ঘটনাটি ছিল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা পরিচয়ে কয়েকজন সেখানে মব সৃষ্টির চেষ্টায় লিপ্ত ছিলেন। পরে সেখান থেকে তিনজনকে হেফাজতে নেওয়া হয়।
পুলিশ আরও জানায়, তাদের হেফাজতে নেওয়ার পর থেকেই বৈষম্যবিরোধী ছাত্রনেতা পরিচয়ে অনেকেই থানা-পুলিশকে আলটিমেটাম (ছেড়ে দেওয়ার দাবি পূরণে সময় বেঁধে দেওয়া) দেন ও অনেকেই থানায় আসেন।
পরে জানা যায়, ধানমন্ডিতে পুলিশের সঙ্গে তর্কে জড়ানো ব্যক্তিদের মধ্যে একজন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মোহাম্মদপুর থানার আহ্বায়ক সাইফুল ইসলাম রাব্বি।
ধানমন্ডিতে মব চেষ্টার পরের দিন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ফেসবুকে দেওয়া এক বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, নৈতিক স্খলনজনিত কারণে সাইফুল ইসলাম রাব্বিকে সাংগঠনিক কার্যক্রম থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। ঘটনার পর দিন বিকেলে সাইফুলসহ তিনজনকে থানা হেফাজত থেকে নিজ জিম্মায় ছাড়িয়ে নেন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মুখ্য সমন্বয়ক আবদুল হান্নান মাসউদ। ভবিষ্যতে তারা এ ধরনের কাজে জড়িত হবেন না, এই মর্মে তারা মুচলেকা দেন।
মব প্রতিরোধে ডিএমপির হুঁশিয়ারি
১৯ মে ধানমন্ডিতে মব সৃষ্টিকারীদের ঘটনার পরদিন ২০ মে ডিএমপির মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) মুহাম্মদ তালেবুর রহমানের পাঠানো এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে হুঁশিয়ারি দিয়ে বলা হয়, ভবিষ্যতে কেউ আইন নিজের হাতে তুলে নিয়ে কোনো নৈরাজ্য সৃষ্টি করলে তা কোনোভাবেই বরদাশত করা হবে না।
বিজ্ঞপ্তিতে ধানমন্ডি ৪ নম্বর সড়কের ঘটনা উল্লেখ করা হয়। পেশাদারত্ব ও ধৈর্য সহকারে মব নিয়ন্ত্রণে অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপনের স্বীকৃতি হিসেবে ধানমন্ডি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ক্যশৈন্যু মারমাকে বিশেষভাবে পুরস্কৃত করেছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি)। গত বুধবার (২১ মে) ধানমন্ডি থানার ওসির হাতে পুরস্কার তুলে দেন ডিএমপি কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী।
এদিকে নাম প্রকাশ করতে অনিচ্ছুক আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উচ্চ পর্যায়ের এক কর্মকর্তা বলেন, মব সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে আর কোনো ছাড় নেই। দেশের জনগণের শান্তির জন্য মব-সহ যেকোনো অপরাধীদের বিরুদ্ধে পুলিশ কঠোর থেকে কঠোরতম হচ্ছে পুলিশ। গণঅভ্যুত্থানের পরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মনোবল কেমন ছিল, এটা দেশবাসী সকলেই জানে। সেই মনোবল কাটিয়ে পুলিশ ইতোমধ্যে কাজ শুরু করেছে। পুলিশের মনোবল কাটিয়ে ওঠার অন্যতম কারণ হচ্ছে, সব রাজনৈতিক দলই মবের বিরুদ্ধে অবস্থান নিচ্ছে, পুলিশকে সহযোগিতা করছে।
তিনি আরও বলেন, আপনারা দেখেছেন, গত সোমবার ধানমন্ডি এলাকায় মব সৃষ্টিকারীদের কীভাবে প্রতিহত করেছে ধানমন্ডি থানার ওসিসহ তার পুলিশ বাহিনী। এতে পুলিশ প্রশংসিত হয়েছে সাধারণ মানুষের কাছে। ব্যক্তিগত কারণে অথবা যে কোনো কারণেই কিছু লোকজন মবের নাম করে সমাজে অশান্তি সৃষ্টির চেষ্টা করলেই আইন অনুযায়ী তাদের কঠোরভাবে দমন করা হবে। এই মবের কারণে নিহত-আহত হওয়ার ঘটনা আছে।
তবে মবের শিকার হয়ে এ পর্যন্ত কতজন নিহত ও আহত হয়েছেন, সেই সংখ্যা জানাতে পারেননি পুলিশের এই কর্মকর্তা।
মানবাধিকার সংগঠন যা বলছে
মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির (এইচআরএসএস) নির্বাহী পরিচালক ইজাজুল ইসলাম বলেন, গত নয় মাসে গণপিটুনিতে অন্তত ১৪৩ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন ১৩৯ জন। আর গত ১০ বছরে গণপিটুনিতে মোট ৭৯২ জন প্রাণ হারিয়েছেন। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি গণপিটুনির ঘটনা ঘটেছে ২০২৪ সালে। গত বছর এ ধরনের ঘটনায় ১৭৯ জন নিহত হয়েছেন।
মব নিয়ে তথ্য উপদেষ্টা যা বলেন
গত ৯ মার্চ সচিবালয়ের আইন মন্ত্রণালয়ে এক সংবাদ ব্রিফিংয়ের সরকারের তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মাহফুজ আলম বলেন, জনগণকে জানাতে চাই, যেখানেই ‘মব জাস্টিস’ পরিস্থিতি হবে, সে যেই হোন না কেন, যে ধর্মের, লিঙ্গের, বর্ণের, জাতের হোন না কেন, আমরা এখন থেকে কঠোর ভূমিকায় অবতীর্ণ হব। এখন থেকে যেকোনো ধরনের ‘মব জাস্টিসের’ বিরুদ্ধে সরকার কঠোর অবস্থানে যাবে। যিনিই ‘মব জাস্টিস’ করেন না কেন, তাকে আইনের আওতায় আনতে আজ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
পুলিশ সদর দপ্তর যা বলছে
গত বুধবার (২১ মে) পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশনস) ইনামুল হক সাগর বলেন, আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। যেকোনো প্রয়োজনে পুলিশকে অবগত করুন, পুলিশ তাৎক্ষণিক আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
অপরাধ বিশেষজ্ঞের অভিমত
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের সময়কাল ৯ মাস অতিক্রম করলেও দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এখনও স্বাভাবিক হয়নি। বরং মব ও ব্যক্তিগত স্বার্থে সংঘটিত নানা অনিয়ম, হয়রানি ও মিথ্যা মামলার প্রবণতা উদ্বেগজনক হারে বেড়েছে।
“মব সৃষ্টিকারীরা কিংবা অপরাধপ্রবণ ব্যক্তিরা পুলিশের বা আইনের ভয় না পেয়ে বরং নিজেদের অধিক শক্তিশালী মনে করছে। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, পুলিশ তাদের কথামতোই কাজ করছে, মামলা দিচ্ছে, এমনকি কখনও কখনও মিথ্যা ও গায়েবি মামলাও হচ্ছে। ”
এই অপরাধ বিশেষজ্ঞ মনে করেন, পুলিশের মধ্যে এক ধরনের দ্বিধা বা ভয় কাজ করছে, যার ফলে তারা আইন প্রয়োগে কঠোরতা দেখাতে পারছে না। তার ভাষায়, “নোটিশ দিয়ে কিছু হবে না, পুলিশকে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। মব সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে দৃশ্যমান ব্যবস্থা নিতে হবে। পুলিশের কার্যকর ভূমিকা ছাড়া আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন সম্ভব নয়। ”
তৌহিদুল হক আরও বলেন, অপরাধীরা যখন বুঝে ফেলে যে তারা পার পেয়ে যাচ্ছে, তখন সমাজে এক ধরনের ভয় ও অনিশ্চয়তা তৈরি হয়। যদি ব্যক্তিগত, রাজনৈতিক বা সামাজিক শত্রুতার ভিত্তিতে কেউ সহজেই কাউকে মব দিয়ে হয়রানি করতে পারে, তাহলে তা সমাজে দীর্ঘস্থায়ী আতঙ্কের জন্ম দেবে।
তিনি মনে করেন, পুলিশের কার্যক্রমে পেশাদারত্বের ঘাটতি রয়েছে এবং মাঠপর্যায়ে সঠিকভাবে নির্দেশনা বাস্তবায়ন হচ্ছে না।
ড. হক বলেন, পুলিশ যদি ‘যাত্রাপালার বিবেক’ হিসেবে নিষ্ক্রিয় ভূমিকায় থাকে, তাহলে বাস্তবতা পরিবর্তন হবে না। বরং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় শক্ত, সুসংগঠিত ও জনবান্ধব পুলিশি পদক্ষেপ এখন সময়ের দাবি।
এজেডএস/এমজেএফ